যুক্তি তর্ক গল্প-ব্যর্থতার দায় শিক্ষিত সমাজেরই বেশি by আবুল মোমেন

বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সত্ত্বেও তা কাটেনি। সবারই প্রত্যাশা হলো বিরোধী দল সংসদে ফিরে আসুক এবং গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে অর্থপূর্ণ করুক।

কিন্তু বিরোধী জোট ফিরে আসার পরে সংসদের পরিবেশ দূষিত হয়েছে, কার্যকারিতা কমেছে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের পরস্পরের বিরোধিতা করার মনোভাবে কোনো হেরফের ঘটেনি। ১৯৯১ থেকে ধরলে মাঝে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের দুই বছর বাদ দিয়ে—দুই দশক ধরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রেখেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি খুব বেশি নেই। চারটি নির্বাচন, চারবার সরকার পরিবর্তন, প্রধান দুই দলের দুই দফা করে সরকার গঠন সত্ত্বেও সংসদ ও গণতন্ত্র সচল হয়েছে বলা যাবে না।
উভয় দলেই ব্যবসায়ী ও কালোটাকার মালিকদের ভিড় বেড়েছে, সৎ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর চেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নৈতিকতার মানুষজন ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে, উপদলীয় কোন্দল বেড়েছে, রাজনীতির যে মূল লক্ষ্য—দেশ ও দশের সেবা করা—তা রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের অগ্রাধিকারের বিষয় আর নেই। রাজনীতি, বলা উচিত বড় দলের রাজনীতি, অনেকের জন্য বিনা পুঁজির ভালো বিনিয়োগ। এ পথে ক্ষমতা ও বিত্ত সহজেই অর্জিত হয়। অনেক উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে এভাবে ব্যবহার করছে।
এই অবস্থা সমাজে হতাশার সৃষ্টি করছে, নতুন প্রজন্ম ও মেধাবী সৎ মানুষদের রাজনীতিবিমুখ করে তুলছে। তাতে দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয় ও অধোগতি দ্রুততর হচ্ছে। রাজনীতির সঙ্গে সমাজের দূরত্ব বাড়ছে—যদিও দৃশ্যত রাজনীতিবিদদের দাপট ও প্রভাব বাড়বাড়ন্ত। দুটি বড় ও শক্তিশালী দল বস্তুত পরস্পরের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালাচ্ছে। যুদ্ধকালীন যেমন অনেক স্বাভাবিক মানবিক বিবেচনা বাদ পড়ে যায়, একটা অস্বাভাবিক জরুরি অবস্থা তৈরি হয়, আমাদের রাজনৈতিক ময়দানের বাস্তবতা প্রায় সে রকম। প্রত্যেকেই নিজ নিজ সমর্থন বাড়াতে চাইছে, অর্থ-সম্পদ বাড়াতে চাইছে, এমনকি সৈন্যসামন্ত (ক্যাডার) ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহেও পিছু হটেনি। সর্বাত্মক শক্তি বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে নীতিনিয়ম-আইন কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না কেউ কেউ।
যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তাঁরা যদি রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে ভাবেন তাহলে ভুল করবেন। আমার তো মনে হয়, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের এই পরিণতির জন্য দেশের শিক্ষিত নাগরিক সমাজের দায় সবচেয়ে বেশি। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের শিক্ষিত সমাজ তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করল—তাদের একটি অংশ সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য নিজেদের স্বাধীন অবস্থান ত্যাগ করেছে, অপর অংশ দেশের কল্যাণচিন্তা বা অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে সরকারের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে। এই শেষোক্তদের মধ্যে একটি অংশ সুবিধাবাদী আরেকটি অংশ স্বাধীন গণতান্ত্রিক অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশকে আদর্শিকভাবেই গ্রহণ করেনি।
দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পরপর জাসদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগবিরোধীরা একজোট হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিচালনায় বাধা দিচ্ছিল। তাদের কার্যক্রম ক্রমেই বৈধ ও নিয়মতান্ত্রিক পথ ছেড়ে দেশে সংঘাতময় পরিবেশ ও অস্থিরতা তৈরি করে। তখন দেশের শিক্ষিত সমাজ স্পষ্টভাবে কোনো অবস্থান যেমন নেয়নি, ন্যায়ের পথে সক্রিয় ভূমিকা যেমন নেয়নি, তেমনি আজ এত বছর পরও সে আমলের সঠিক মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি তৎকালীন জাসদের অনেক নেতা-কর্মী যখন নিজেদের ভুলভ্রান্তি ও অন্যায়ের কথা স্বীকার করছেন, যখন অনেকে আওয়ামী লীগ বা সে ধারার রাজনীতিতে শরিক হচ্ছেন, তখন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই রক্ষীবাহিনীর কথা তুলে জাসদ-আওয়ামী লীগের মূল্যায়নে দুই দলের মধ্যে সমতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন।
শিক্ষিত সমাজের মারাত্মক দেউলিয়াত্বের প্রকাশ ঘটে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়নে। ফলে পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও হত্যকারীদের প্রতি জেনারেল জিয়ার আচরণকে তাঁরা অপরাধ ও আইনি বিবেচনায় নিলেন না। কারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, সেটা সবাই জানেন। এবং জিয়া যে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, সেটাও অস্পষ্ট নয়। আর এমন জঘন্য অপরাধীদের বিচারের পথ বন্ধ করে রাখা সত্ত্বেও যদি শিক্ষিত সমাজ চুপ থাকে, রাজনৈতিক অপব্যাখ্যার ঘোলাজলে হাবুডুবু খেতে থাকে, তাহলে তাঁদের ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতা হয়ে পড়ে সীমাহীন। এভাবে বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর অন্যায় ও অবিচারকে শোষণ ও ধারণ করার দায় এসে পড়ে এবং এভাবে নীতি, আদর্শ, এমনকি আইনের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বহু অঘটন ঘটেছে। তার কয়েকটি উল্লেখ করছি—
ক. জেল হত্যা, যাতে তাজউদ্দীন আহমদের মতো মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকসহ চার জাতীয় নেতা নিহত হন;
খ. বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার হত্যাকারীদের দীর্ঘকাল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান;
গ. দেশে পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্তৃত্বে অসংখ্য গোপন ঘাঁটি গড়তে দেওয়া, যেখানে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিরোধী জঙ্গিদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে;
ঘ. একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা যার মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা ইত্যাদি।
আমি জিয়া হত্যার প্রসঙ্গটি এখানে আনিনি। কারণ—১. সেটি ছিল সামরিক বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার কাজ, ২. এ হত্যাকাণ্ডের বিচার ও শাস্তি কার্যকর হয়েছে ঘটনার পরপরই এবং ৩. এ ঘটনায় অপর বড় দলের দিক থেকে হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দানের বা বিচারপ্রক্রিয়া বিঘ্নিত করা কিংবা রাজনৈতিক ফায়দা উসুলের ঘটনা ঘটেনি।
দেখা যাচ্ছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া পঁচাত্তরে প্রথম ঘটেছে, তা সেখানেই শেষ হয়নি, প্রায় ২৫ বছর পরে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে তা অব্যাহত ছিল। দেখা যাচ্ছে, এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার বিএনপি করেনি, চালু বিচারপ্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিয়েছে, এমনকি হত্যাকারী ও হত্যা প্রচেষ্টাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছে।
এভাবে দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি ছড়িয়ে পড়েছে, রাজনীতি বেপরোয়া ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে, কালোটাকা বা অবৈধ অস্ত্র এর অংশ হয়ে গেছে, সংসদকে অর্থবহ ও কার্যকর রাখা মুশকিল হয়ে পড়ছে, অসহিষ্ণু অনুদার রাজনীতি সর্বত্র অবক্ষয় ছড়াচ্ছে।
এ অবস্থায় কি রাজনীতি কি সরকার, কেউই সমাজকে তেমনি কিছু দিতে পারছে না। বরং বাংলাদেশ হতাশার বৃত্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। এর মধ্যেই কৃষি, তৈরি পোশাক আর বিদেশে কর্মরত শ্রমিক—এই তিন খাতে কর্মরত সমাজের তিন দরিদ্র অভাগা গোষ্ঠী দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। বিপরীতে বিত্তবান ও শিক্ষিতসমাজের নেতৃত্বে ও দৌরাত্ম্যে সর্বত্র অবক্ষয় চলছে।
কেবল অর্থনীতির জোরে ষোলো কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ সেই স্থিতিশীলতা অর্জন ও বজায় রাখতে পারবে না, যা দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে একটা বিভ্রান্তি জিইয়ে রেখে কোনো মানবসমাজ এগোতে পারে না। সমাজের একটি অংশ ইসলাম ও স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যে বিরোধ দেখিয়ে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাসের বিষবৃক্ষের বীজ বপন করে তাতে জল হাওয়া দিয়ে চলেছে। সেই ধারার রাজনীতিকে পোক্ত করতে গিয়ে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেল হত্যা, গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনাকে হালকাভাবে নিতে চায়। এসব ঘটনায় যে ধারাবাহিকতা রয়েছে ও মূল অনুসারীদের রাজনৈতিক পরিচয়ে সাজুয্য আছে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে মূলধারার রাজনীতিকে জোরদার করতে হতো।
সর্বশেষ শাসনামলে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামিকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে সরকারে থেকে জেএমবি, বাংলা ভাই, হুজির মতো গোষ্ঠীদের মদদ দিয়েছেন সেসব তো পরিষ্কার ঘটনা। কিন্তু শিক্ষিত সমাজ সে কথা বলছেন না।
যেখানে শিক্ষিত সমাজ নৈতিকভাবে দুর্বল, অপরাধ ও অপরাধীর সঙ্গে আপস করে চলে কিংবা ইতিহাসের সঠিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়, সে সমাজ কেবল রাজনীতির জোরে উদ্ধার পাবে না। এই যে বিপুল গৌরবময় রাজনৈতিক অর্জন সত্ত্বেও আমরা মূল কাজ দেশ পরিচালনায় হোঁচট খাচ্ছি ও ব্যর্থ হচ্ছি, তার মূল রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার মধ্যে নয়, খুঁজতে হবে শিক্ষিত সমাজের ব্যর্থতার মধ্যে, যার একটি অংশ রাজনীতিকেও নষ্ট করার কাজ করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সমাজের সর্বক্ষেত্রে যোগ্য দক্ষ নেতৃত্ব সরবরাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যাহত ও ব্যর্থ হচ্ছে এখানে। শুধু রাজনীতি নয়, প্রশাসনসহ বিভিন্ন পেশা কিংবা সমাজ-জীবনে আমরা দেখছি স্বার্থচালিত মানুষদের খেয়োখেয়ির প্রতিযোগিতা। সমাজকে জাগাতে হলে, এগিয়ে নিতে হলে ইতিহাসের সঠিক ব্যাখ্যা এবং ইতিহাসের যাত্রাপথে সঠিক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। পঞ্চাশ-ষাটের দশক থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আমরা সেভাবেই তো এগিয়েছি। কিন্তু এখন আমাদের শিক্ষিত সমাজ এ কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ফলে রাজনীতি অনেক আশা জাগিয়েও বারবার বিফল হচ্ছে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.