পরিবেশ-বন্যপ্রাণী ব্যবসা রুখতে হবে এখনই by সীমান্ত দীপু

বাংলাদেশের সবচেয়ে বিপন্ন প্রাণীগুলোই এখন সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে। গবেষকরাও বলছেন, বন্যপ্রাণী হারিয়ে যাওয়ার পেছনে পাচারই একটি বড় কারণ। আমাদের যে প্রচলিত আইন আছে সেই বন্যপ্রাণী আইনের প্রচলন এখনও ভালোভাবে শুরু হয়নি। প্রতিনিয়ত হরিণ,

পাখি, সাপ পাচারকারী চোখের সামনে ঘুরে বেড়ালেও দেখার যেন কেউ নেই


এ দেশে বন্যপ্রাণী নিয়ে কোনো ব্যবসা হতে পারে তা সাধারণ মানুষের কাছে একরকম অজানাই বলা চলে। অনেক বন্যপ্রাণী আছে যা মানুষের চোখে পড়ার আগেই হারিয়ে গেছে। বন্যপ্রাণী নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম বিধায় এই ব্যবসার গালগল্প কম শোনা যায়। কিন্তু গোটা পৃথিবীতে বন্যপ্রাণী ব্যবসা সবচেয়ে বড় অবৈধ ব্যবসা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। কিছুদিন আগের ঘটনা। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে দু'জন ব্যবসায়ী এ দেশে এসে বাজপাখি সংগ্রহের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। যত টাকায় হোক বাজপাখি তাদের চাই। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের কয়েক ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর আইনের প্রয়োগ কম। তাই অবৈধ বন্যপ্রাণীর রুট হিসেবে বাংলাদেশকে চোরাকারবারিরা অভয়ারণ্য জোন হিসেবে ব্যবহার করে। বাংলাদেশের পাহাড়ি ময়নার বড় একটি চালান হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে ধরা পড়েছিল কিছুদিন আগে। ধারণা করা হয়েছিল এ ব্যবসা বহুদিন ধরেই এ পথে চলে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি আমাদের বিমানবন্দরে ঘুষের লেনদেনে ঝামেলা হওয়ায় ওই চালান যেতে পারেনি। এত পাহাড়ি ময়না একসঙ্গে সংগ্রহ অথবা পাচার হলেও বাংলাদেশের প্রশাসন জানেই না তাদের কী করণীয়। শুধু পাহাড়ি ময়না নয়, যে কোনো দিন কাঁটাবনের বাজারে গেলে বাংলার বিপন্ন পাখি চোখে পড়ে। টিয়া, ধনেশ, মুনিয়া থেকে শুরু করে মদনটাক পর্যন্ত এখানে পাওয়া যায়। যে কোনো পাখি অর্ডার করলেই এখান থেকে সরবরাহ করা হয়_ এ রকম খবর শোনা যায়।
বেশ কয়েক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে ঘড়িয়াল হারিয়ে গেছে। কিন্তু এখন ঘড়িয়ালের বাচ্চা চোরাশিকারিদের কাছে আছে বলে শোনা যায়। আর লোনা পানির কুমিরের বাচ্চা তো যখন-তখনই সংগ্রহ করা যায়। বন্য পরিবেশ বলতে সুন্দরবন থেকেই প্রতিবছর লোনা পানির কুমিরের বাচ্চা আহরণ করে পাচারকারীরা। এর সঙ্গে একটা মুখোশধারী মহলও জড়িত আছে। কুমির পাচারের জন্য সবচেয়ে ভালো রুট হলো মংলা বন্দর। শুধু বন্য অবস্থায় থেকে এ কুমিরগুলো পাচার হয় তা নয়; এ দেশে এখন কুমিরের খামারও হয়েছে। সেখান থেকেও কুমিরের চালান যাচ্ছে কি-না সেদিকে নজর রাখা জরুরি।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশি একজন শিক্ষার্থী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশে এসেছেন সাপ গবেষণা করতে। বন্য অবস্থায় অজগরের গবেষণা করবেন তিনি। কোনো অজগর তিনি বনে পাননি; কিন্তু কাঁটাবনের ব্যবসায়ীদের কাছে গিয়ে জানা গেল, যে কোনো দিন তারা যে কোনো বয়সের অজগর দিতে পারবে। গবেষক অবাক হয়ে তাদের কথা শুনলেন; হতাশ হয়ে ভাবলেন কীভাবে একটা বিপন্ন প্রাণীকে এ দেশের বাজারে সহজেই পাওয়া যায়।
রাজধানীর শাঁখারীপট্টিতে প্রতি শুক্রবারই বসে কচ্ছপের হাট। বাংলাদেশের বহু জায়গায় কচ্ছপের হাট বসলেও এই হাটটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একদিন খুব সকালেই এই কচ্ছপের হাটে গেলাম। একটু দূর থেকেই দেখতে পেলাম একটি বাটাগুড়কে চাপাতি দিয়ে কোপ মারার জন্য প্রস্তুত কসাই। আমার কথা তার কান পর্যন্ত পেঁৗছার আগেই বাটাগুড় নামের এই বিপন্ন কচ্ছপটির শিরশ্ছেদ হলো। বাজারমূল্যে এই কচ্ছপের প্রতিটির দাম ৬০-৮০ হাজার টাকা। শুধু টাকা দিয়ে বিচার করলেই চলবে না; গোটা পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন এই কচ্ছপটি এখন বাংলাদেশের সীমানা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। শুধু বাটাগুড়ই নয়; বাংলাদেশের কচ্ছপের বাজাগুলো ঘুরে দেখা যায়, মোট ৭-৮ বিপন্ন প্রজাতির কচ্ছপের বেচাকেনা হয়।
যে বাঘ নিয়ে আমাদের এত গর্ব সেই বাঘই এখন হুমকির মুখে আছে। আবাসস্থল আর খাবারের চেয়ে চোরাশিকারিরাই এর প্রধান শত্রু। প্রতিবছরই দেশি-বিদেশি একটি চক্র বাঘ শিকারের সঙ্গে যুক্ত বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। বাঘ মেরে ফেলে তার চামড়া, মাথার খুলি, হাড়গোড় সবই বেচাকেনা চলে আন্তর্জাতিক বাজারে। কিছুদিন আগে বাঘের চামড়া পাচারের সঙ্গে খোদ বন বিভাগেরই সংশিল্গষ্ট থাকার প্রমাণ মিলেছে। শুধু সুন্দরবনেই নয়; পার্বত্য চট্টগ্রামেও বাঘের চামড়া বেচাকেনা হয় সমানভাবে। কথিত আছে, মাত্র বিশ হাজার টাকায় বাঘের চামড়া পাওয়া যায়।
একসময় এ দেশের বেদেপাড়া বেশ সরগরম ছিল। তাদের জীবিকার প্রধান মাধ্যম ছিল সাপ। বর্তমানে তাদের এই ব্যবসার বেশ মন্দাভাব। সাপের খেলা দেখানোর পরিবর্তে অনেক সাপুড়িয়া সাপ পাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। সাপ পাচারের একটা অন্যতম রুট হলো রংপুর বিভাগ। বাংলাদেশের সীমানায় অনেক সাপ চোখেই পড়ে না। যেমন লাল বোড়া কখনও এ দেশে বন্য অবস্থায় দেখা যায়নি। আমাদের সাপুড়িয়াদের কাছে গেলে এই সাপটি সহজেই দেখা যায়। অবশ্যই এই সাপগুলো আশপাশের দেশ থেকে আসে বলে ধরা হয়। ভারতে বন্যপ্রাণী আইন কড়াকড়ি বিধায় সাপ বাংলাদেশে খুব কম দামে পাচার হয়। শোনা যায় বাংলাদেশে বিষাক্ত সাপের চালানও আসে ভারত থেকে; আর এই সাপগুলো থেকে সাপের বিষ পাচার হয় ইউরোপে। কিছুদিন আগে সাপের বিষের একটি বড় চালান ধরা পড়েছিল আমাদের দেশে। এ থেকেই সাপের বিষের চালান যে বাংলাদেশ থেকে যায় তার প্রমাণ মেলে।
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীদের মধ্যে স্তন্যপায়ী শিকার সবচেয়ে বেশি হয়। উল্লুক থেকে শুরু করে বানর, বনবিড়াল, ভাল্লুক এমনকি বনরুইও বাদ যায় না। বানর বন থেকে ধরা হয় সবচেয়ে বেশি। এই প্রাণীটির কদর বাংলাদেশে বেশি বলেই একে ধরা হয়। খুব সহজেই বানর পাওয়া যায় বিধায় এই প্রাণী ধরাও পড়ে বেশি। এশিয়াটিক কালো ভাল্লুক বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের দেশের মিনি চিড়িয়াখানাগুলোতে এই জাতের ভাল্লুক দেখা যায়। আসলে কোথায় থেকে এই মূল্যবান প্রাণীটি আসছে তা সরকারের ভেবে দেখা উচিত। আসলেই এই চিড়িয়াখানাগুলো মানুষের আনন্দ-বিনোদনের জন্য নাকি বন্যপ্রাণী পাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা উচিত।
বাংলাদেশে বহু বিপন্ন পরিযায়ী পাখি শিকার করা হয়। শীতকালে পাখি শিকার ও ব্যবসা দারুণ জমজমাট হয়ে ওঠে। এ বছর কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে অনেক ছোট ছোট পাখির মাথা পাওয়া যায়। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন পাখি চামুচঠোঁটো বাটানের মাথাও এখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মহেশখালী বাজারে প্রতিদিই পরিযায়ী পাখির
বাজার বসে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বিপন্ন প্রাণীগুলোই এখন সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে। গবেষকরাও বলছেন, বন্যপ্রাণী হারিয়ে যাওয়ার পেছনে পাচারই একটি বড় কারণ। আমাদের যে প্রচলিত আইন আছে সেই বন্যপ্রাণী আইনের প্রচলন এখনও ভালোভাবে শুরু হয়নি। প্রতিনিয়ত হরিণ, পাখি, সাপ পাচারকারী চোখের সামনে ঘুরে বেড়ালেও দেখার যেন কেউ নেই। এমনকি যে হাটগুলোয় এসব পাচার হয় তা বন্ধের উদ্যোগও সরকার গ্রহণ করছে না। এরকম চলতে থাকলে বন্যপ্রাণী ব্যবসায়ীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। তাতে বড় ক্ষতি হবে আমাদের বন্যপ্রাণীরই। আর বনে যদি বন্যপ্রাণী না থাকে তবে বনগুলোরও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।

সীমান্ত দীপু : বন্যপ্রাণী গবেষক ও লেখক

No comments

Powered by Blogger.