যৌন কেলেঙ্কারি-কী করবেন সাবেক আইএমএফ-প্রধান? by মুহম্মদ মাছুম বিল্লাহ

কয়েক দিন ধরে বিশ্বের সবচেয়ে মুখরোচক ঘটনা বা টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক প্রধান নির্বাহী স্ত্রস কানের যৌন কেলেঙ্কারি। নিউইয়র্কের হোটেলে এক নারী কর্মীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে ১৪ মে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিউইয়র্কের রাইকার্স দ্বীপের একটি কারাগারে তাঁকে

পাঠিয়ে দেন আদালত। পরে তাঁকে শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে কানের ৪০ লাখ ডলার মূল্যের একটি বাড়ি আছে, অতএব তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়া তেমন কোনো ব্যাপার নয় বলে অনেকে বলছেন। তাঁকে কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। ঝাড়ু দেওয়ার কাজে নিযুক্ত এক নারী পেশাগত কাজে তাঁর কক্ষে ঢুকলে তিনি তাঁর ওপর চড়াও হন বলেঅভিযোগ। পরে ওই নারী অন্যদের তা জানান এবং পুলিশে ফোন করেন। পুলিশ কানকে প্যারিসগামী বিমানে আরোহণের পরপরই আটক করে নামিয়ে আনে। সেদিন তাঁর বার্লিনে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ছিল। পরের দুই দিন ব্রাসেলসে ইইউর অর্থমন্ত্রীদের সভায় তাঁর অংশ নেওয়ার কথা ছিল। সবই হঠাৎ করে বাতিল হয়ে যায়।
অনেক রাজনীতিক ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন তুলছেন, স্ত্রস কানের অতিরিক্ত যৌনতাড়নার ব্যাপারটা মানসিক সমস্যা। যদি তা-ই হয়, তাহলে এমন একজন মানসিক রোগী বা প্রকৃতিস্থ ব্যক্তি কী করে আইএমএফের প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। কীভাবে ফ্রান্সের মতো বৃহৎ শক্তির অর্থ মন্ত্রণালয় চালিয়েছেন? কেমন করেই বা তিনি ফরাসি সমাজতন্ত্রী দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আর কীভাবে তিনি ২০১২ সালের ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এবং সমর্থন কুড়িয়েছিলেন? একজন সফল, বুদ্ধিমান, চৌকস বিশ্বনেতার বিরুদ্ধে একজন হোটেল-পরিচারিকার যৌন নির্যাতনের অভিযোগ, যা এখনো প্রমাণিত হয়নি। ‘সন্দেহের সুবিধা’ বা বেনিফিট অব ডাউট থেকে বোঝা যায়, এটি সাজানো ও অতিরঞ্জিত ঘটনা। অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বাজারে এ ঘটনার বিরাট প্রভাব পড়বে। এতে কেউ কেউ লাভবান হবেন, আবার কেউ কেউ অনেক কিছুই হারাবেন। গ্রিসের আর্থিক ধসে কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য এটি একটি সাজানো পন্থা হতে পারে। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে তাঁকে সোশ্যালিস্ট পার্টির সমর্থন বা নমিনেশন আদায় করতে হবে এবং নিকোলা সারকোজিকে হারাতে হবে। ফরাসি জনমত বলছে, কান নির্বাচনে জয়লাভ করবেন, যদি সোশ্যালিস্ট পার্টি তাঁকে নমিনেশন দেয়। তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নমিনেশন দেওয়ার জন্যই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে—এমনটিও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের হর্তাকর্তা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সংস্থার প্রধানের দায়িত্ব কখনো কোনো উন্নয়নশীল দেশের কেউ পাননি। এবার কে হবেন সংস্থাটির প্রধান? তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে ফরাসি অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিন লাগার্দের নাম বেশ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। প্রধান নির্বাহীর তালিকায় আছেন সাবেক তুর্কি অর্থমন্ত্রী কামাল দারবিশ, ফরাসি অর্থমন্ত্রী ক্রিস্তা লাগাদি, জার্মানির সেন্ট্রাল ব্যাংকের সাবেক প্রধান আলেক্স ভেবার, দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অর্থমন্ত্রী ট্রেভর ম্যানুয়েল, মেক্সিকোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও সাবেক অর্থমন্ত্রী অগাস্টিন কার্সটেন্স, ভারতীয় পরিকল্পনাবিদ ও বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা মানতেক সিং অহলুয়ালিয়া, ব্রাজিলের অমিওন ফ্রাগা। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো দাবি করছে, এবার তাদের দেশের মধ্য থেকে আইএমএফের প্রধানের নিয়োগ দেওয়া হবে। আবার জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল ককেসো বলছেন, আইএমএফ-প্রধান ইউরোপীয় কোনো দেশ থেকেই হওয়া উচিত। প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মহাসচিব মেক্সিকান বংশোদ্ভূত অ্যাঙ্গেল সুরিয়া আইএমএফের প্রধান হিসেবে এবার ইউরোপের বাইরের দেশ থেকে হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করার পরই লাগার্দের নাম শোনা গেল। আইএমএফ প্রতিষ্ঠার পর বরাবরই সংস্থাটির প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন ইউরোপের দেশ থেকে। তাই সুরিয়া বলেন, প্রথাটি পরিবর্তন করার এখনই মোক্ষম সময়। এবার অপেক্ষার পালা। তবে তৃতীয় বিশ্ব বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্য থেকে কাউকে নির্বাচন করা হলে আমরা খুশি হব। কারণ, উন্নয়নশীল বিশ্বের সমস্যা এসব দেশের অর্থনীতিবিদেরাই ভালো বুঝবেন, তাঁরা এসব দেশের প্রয়োজনীয়তা ও কনটেক্সট বুঝবেন। সংস্থাটির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে, তা-ও অনেকটা ঘুচবে।
আইএমএফের বর্তমান পদের জন্য ১৪টি দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। অইএমএফ-প্রধানের অনুপস্থিতিতে সংস্থাটির কর্মসূচি অনেকটাই বিঘ্নিত হচ্ছে। ধর্ষণের প্রয়াস এবং বলপূর্বক আটকে রাখার অভিযোগ প্রমাণিত হলে কানকে ২৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে যৌনতা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করা হয়। তার পরও যৌন কেলেঙ্কারি পশ্চিমা বিশ্বেই বেশি পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় এটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কানের মতো উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির পায়ে বৈদ্যুতিক তার লাগিয়ে তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা, হঠাৎ বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা—এসবই অনেকের মনে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই একে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করছেন। এ অবস্থায় ২০১২ সালের নির্বাচনে কান কি সত্যিই এই অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন এবং দেশের সর্বোচ্চ পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন?
মুহম্মদ মাছুম বিল্লাহ: উন্নয়নকর্মী।
mmbillah2000@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.