তথ্যপ্রযুক্তি-আমাদের ছাত্রদের প্রোগ্রামিং দক্ষতা ও সাফল্য by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের মানুষ যে কম নয়, তা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বৈরী পরিবেশে জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা কালজয়ী আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রমাণ করে গেছেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশে অবশ্য মেধার লালন, স্বীকৃতি ও সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পাওয়ায় স্বাধীনতার পরশ পাথরের স্পর্শেও প্রতিভা জ্বলে উঠতে পারছে না।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তিও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। এই অঞ্চলের ১৮-১৯টি দেশের মধ্যে নিয়াজ মোর্শেদের গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করাটাও কিন্তু শ্রেয়তর মেধার স্বীকৃতি।
বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এ ক্ষেত্রেও সাফল্য অর্জন করতে চাইলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠিত ও লালন করতে হবে। আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো যদিও ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে এবং এই প্রযুক্তির জুতসই ব্যবহারের মাধ্যমে সর্ব ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে, তবেই বলা যাবে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হচ্ছি। ডিজিটাল প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট এই কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে কিন্তু আমাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে—সব সফটওয়্যার বিদেশ থেকে ক্রয় করে বিদেশি প্রকৌশলীদের দিয়ে ইনস্টল করলে যা পাব, তা হলো ডিজিটালি পরাধীন বাংলাদেশ। শুধু বিদেশি মেধা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেরা সাক্ষীগোপাল থেকে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ করার সুযোগ নেই।
সুখের বিষয়, এই প্রযুক্তির সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের মেধাবী তরুণেরা তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষায় তাদের আগ্রহ ব্যক্ত করেছে এবং স্বতঃস্ফূর্ত অনুশীলনের মাধ্যমে ঈর্ষণীয় দক্ষতা অর্জন করেছে। তরুণদের অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও উৎসাহকে নানা কর্মতৎপরতা ও উদ্যোগের মাধ্যমে বিকশিত করতে হয়। তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষা বাংলাদেশে সিকি শতাব্দী আগে শুরু হয়েছে। স্বভাবতই ভৌত অবকাঠামো, পরীক্ষণাগার এবং শিক্ষকস্বল্পতার মধ্যেও দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষা দিয়ে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা আমাদের দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন। তাই ছাত্রদের অফুরন্ত আগ্রহ সুষ্ঠু খাতে পরিচালনা করার জন্য সিএসই ডে, আইটি ফেস্ট, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা—ইত্যাকার নামের উদ্যোগ গ্রহণ করছি। ছাত্রদের প্রবল উৎসাহে, সমাজের নানা স্তরের জনসাধারণের আগ্রহে এই উদ্যোগগুলো সাফল্যের সঙ্গে আমাদের ছাত্রদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতা বিকশিত করছে। এই উদ্যোগগুলোকে কেন্দ্র করেই আজকের লেখা।
বাংলাদেশে ছাত্রদের জন্য প্রথম প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করে কম্পিউটার জগৎ ম্যাগাজিনটি। এরপর ১৯৯৭ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এশিয়া অঞ্চলীয় আইসিপিসি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশে তা জনপ্রিয় হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুমনকুমার নাথ, রেজাউল আলম চৌধুরী ও তারিক মেসবাউল ইসলামের দল ২২তম বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আটলান্টা শহরে। ওই প্রতিযোগিতায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়েরও একটি দল ছিল। প্রতিযোগিতায় বুয়েটের দল ৫৪ দলের মধ্যে সুবিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ২৪তম স্থান দখলের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো প্রয়োজনীয় সম্পদের অভাবেও এই নতুন প্রযুক্তির শিক্ষায় আমরা পিছিয়ে নেই। সেই থেকে প্রতিবছরই এই মর্যাদাকর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দল পরপর ১৪ বার অংশ নিয়েছে। শত শত কিংবা হাজার হাজার শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় পৃথিবীর ২ দশমিক ৪ শতাংশ জনসংখ্যা ধারণকারী বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকলেও আধুনিকতম এই প্রযুক্তির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ৫০ কি ১০০ দলের মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের নাম লিখিয়েছে। এই প্রোগ্রামিংয়ে হাজার হাজার ঘণ্টা সময় দেওয়ায় ছাত্রদের আমি অভিনন্দন ও অভিবাদন জানাই। ২০০০ সালে অরল্যান্ডোতে অনুষ্ঠিত ২৪তম বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে মুস্তাক, পাপ্পানা, ফেরদৌসের দল এমআইটি, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ডের দলগুলোকে পেছনে ফেলে ৬০টি দলের মধ্যে একাদশ স্থান দখল করে। আমাদের ছাত্রদের এই সাফল্যে আনন্দিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেক ছাত্রকে এক লাখ টাকা করে নগদ অর্থ পুরস্কার প্রদান করেন। জাতীয় সংসদ থেকেও ছাত্রদের অভিনন্দন জানানো হয়। এর আগে অবশ্য ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের নয়জন ছাত্রের সাফল্যে আনন্দিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে নগদ অর্থ পুরস্কার দেন।
এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বুয়েটের ছাত্ররা ১৩ বার অংশ নিয়ে নয়বার র্যাংক পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তথ্যপ্রযুক্তি থেকে দুই হাজার গুণ অধিক আয়কারী ভারতের দলগুলো থেকে শ্রেয়তর সাফল্য অর্জন করছে আমাদের ছাত্ররা, নিয়মিতই। তথ্যপ্রযুক্তির মর্যাদাকর এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের পাঁচ-পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় নাম লিখিয়েছে—বুয়েট, এআইইউবি, নর্থ সাউথ, ইস্ট-ওয়েস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৯ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় ভারতের ছিল দুটি দল এবং বাংলাদেশ থেকে তিনটি। আর যে দুটি উপমহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংক পেয়েছিল, তা-ও বাংলাদেশের—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট। শুধু তা-ই নয়, আইসিপিসি চ্যালেঞ্জ নামের প্রতিযোগিতায় বুয়েট রানার্সআপ হয়েছিল। এর সঙ্গে অবশ্য বলা দরকার, এই মর্যাদাকর প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহরিয়ার মঞ্জুর এক যুগ ধরে সম্মানিত বিচারক, যিনি বিশ্বের তরুণ শ্রেষ্ঠ কম্পিউটার জাদুকরদের প্রোগ্রামের শুদ্ধতা যাচাই করে থাকেন।
১৯৯৮ সালে তরুণ জাকারিয়া স্বপনের উদ্যোগে দেশে প্রথম জাতীয় কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় হোটেল শেরাটনে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এরপর অবশ্য নিয়মিতভাবে জাতীয় প্রতিযোগিতা আয়োজনে ব্যর্থ হয়েছি। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়কে সামনে রেখে গত বছর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়েছে, এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা আগামী ৩-৪ জুন আয়োজন করবে।
আমাদের ছাত্ররা অভিনবভাবে তাদের প্রোগ্রামিং-দক্ষতা বৃদ্ধি করছে। ভ্যালাদলিদসহ নানা স্থানে অনলাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, যাতে বাংলাদেশের ছাত্ররা নিয়মিত প্রতিযোগী। ভ্যালাদলিদ সাইটে যে ৬৪ হাজার প্রতিযোগী অংশ নিয়েছে, তার প্রায় সাত হাজার বাংলাদেশের। সাফল্যের বিচারে প্রায় আড়াই শ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের র্যাংক প্রথম।
এ ছাড়া আমাদের ছাত্ররা কোডজ্যাম, টপকোডার ইত্যাদি নামকরা প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়েছে। ২০০৬ সালে কোডজ্যাম প্রতিযোগিতায় ৫০ জন চূড়ান্ত প্রতিযোগীর মধ্যে ছয়জন ছিল বাংলাদেশ থেকে। ওই বছর গোটা পৃথিবী থেকে যে ১০০ জন ছাত্রকে নিউইয়র্কের প্রতিযোগিতায় নেওয়া হয়েছিল, তাতে বুয়েটের ইশতিয়াক আহমেদ ৮১তম স্থান দখল করে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০০ জন তরুণ প্রোগ্রামারের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে একজন রয়েছে। কী বিরল সাফল্য!
টপকোডার প্রতিযোগিতায়ও বাংলাদেশের ছাত্রদের অংশগ্রহণ নিয়মিত। এই প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগীদের বলা হয় রেড কোডার। বাংলাদেশে এমন কোডারের সংখ্যা চার—আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সতেজ, তানায়েম মুহাম্মদ মুসা, মনজুরুর রহমান খান, তাসনীম ইসরান সানি—এ বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিযোগী। বড়জোর ৪০টি দেশে রেড কোডার রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংক ২৫-৩০-এর মতো।
এ ছাড়া কোড ফোর্সেস প্রতিযোগিতায় বুয়েটের মাহবুবুল হাসান রেড কোডার হয়েছে। কোডসেফ প্রতিযোগিতায় মাহবুব শ্রেষ্ঠ কোডার হয়েছে।
আমাদের ছাত্ররা শুধু প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাতেই নয়, ২০০৪ সালে সাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব প্রকৌশলীদের কনভেনশনে টেলিফোন নিয়ন্ত্রিত ভোটিং সিস্টেম প্রকল্পের জন্য ইমরানুল হক ও সোনিয়া জাহিদ তৃতীয় পুরস্কার পায়। এই সাফল্য কিন্তু নানাভাবে স্বীকৃতও হয়েছে। আমাদের ছাত্ররা বাংলাদেশের ডিগ্রি নিয়ে মাইক্রোসফট ও গুগলের মতো নামীদামি কোম্পানিতে চাকরি করছে। শুধু বুয়েটের নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও রয়েছে। এ বছর বুয়েটের মনজুরুর রহমান ও তানায়েম এবং জাহাঙ্গীরনগরের আরিফ ইতিমধ্যে গুগলে যোগ দিয়েছে। এ ছাড়া বুয়েটের কয়েকজন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জানে আলম জানও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আমাদের ছাত্রদের গবেষণা-সাফল্যও সমধিক। শুধু বুয়েটের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের আন্তর্জাতিক প্রকাশনার একটি তালিকা www.csebuet.org-তে পাওয়া যাবে।
এবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বুয়েটের যে দল যাচ্ছে, এর সদস্য হচ্ছে তাসনীম ইমরান সানি (সিভিল), অনিন্দ্য দাস (ইলেকট্রিক্যাল) এবং মুনতাসির মাশুক (সিএসই)। এই প্রতিযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অরল্যান্ডো শহরে এ মাসের ২৭-৩১ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। তবে মূল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে ৩০ মে, স্থানীয় সময় সকাল নয়টা থেকে তিনটার মধ্যে। এই প্রতিযোগিতা অনলাইনে দেখা যাবে icpc.baylor.edu/icpc লিংকে।
এই মর্যাদাকর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সানি, অনিন্দ্য ও মাশুকের দল বাংলাদেশের তরুণদের মেধার শ্রেষ্ঠতর স্বীকৃতি এনে দেবে—এই কামনা আমাদের সবার।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.