ফুটপাত উন্মুক্ত রাখার আদেশ by এ এম এম শওকত আলী

৫ মার্চ হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্তৃপক্ষকে ফুটপাত উন্মুক্ত রাখার আদেশ দিয়েছেন। আদেশে আরো বলা হয়, ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল চালানোও বন্ধ করতে হবে। মোটরসাইকেল চালকদের ফুটপাত ব্যবহার করার প্রবণতা সাম্প্রতিক দৃশ্য। আগে ফুটপাত হকাররাই ব্যবহার করতেন। তবে এ নির্বাহী আদেশ প্রদানের নজির আগেও ছিল।

যেমন- সামরিক শাসনামলে ও পরবর্তী সময় সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও। হকারদের ফুটপাত ব্যবহার করার দৃশ্য কেবল মেট্রোপলিটন এলাকায় সীমাবদ্ধ নয়। ছোট-বড় জেলা শহরসহ মফস্বলেও এ বিষয়টি এখন দৃশ্যমান। বিগত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে বড় শহরের বাইরেও হকার বা দোকান উচ্ছেদ অভিযানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিছুদিন পর তা বন্ধ করা হয়। কারণ গরিব মানুষের জীবিকা নির্বাহের পথ উন্মুক্ত রাখাই ভালো হবে। সত্তরের দশকে সামরিক শাসনামলে এ ধরনের সিদ্ধান্তেরও নজির ছিল। এ কারণে ঢাকা শহরে হকারদের জীবিকা অর্জনের পথ বন্ধ না করার বিষয়ে এদের সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে সংসদের কাছাকাছি মানিক মিয়া এভিনিউর আশপাশে ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে এ বিষয়টি স্থায়ী হয়নি। এ সত্ত্বেও বহুদিন ধরেই এ চওড়া রাস্তার ফুটপাত বা তার আশপাশে ফুচকা বিক্রির ভ্যানগাড়ির দৃশ্য কারো অজানা নয়। এদের সঙ্গে কিছু হকারও রয়েছেন। ঢাকার অন্যান্য রাস্তার ফুটপাতে প্রথমে খাবার দোকান, পরে ভ্যানগাড়ি ব্যবহার করে কিছু দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে সাদা ভাত, তরকারি ও ডাল বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণত রিকশাচালক ও দিনমজুররাই এসব অস্থায়ী দোকানের ক্রেতা। এগুলোও বন্ধ করা হলে দিনমজুরসহ রিকশাচালকদের দুপুরের খাবার খাওয়ার সুযোগও বন্ধ হবে। অন্যদিকে দরিদ্র বিক্রেতাদের আয়ের সুযোগও বন্ধ হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা বিঘি্নত হবে।
হাইকোর্টের আদেশ পালনে কতটুকু সাফল্য অর্জিত হয়েছে বা হবে, তা নিয়ে অনেকেরই কিছু সংশয় রয়েছে। বুয়েটের একজন নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ আদেশকে স্বাগত জানিয়েও কিছু নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন, যা সম্পূর্ণ বাস্তববিবর্জিত নয়। তিনি ফুটপাতের ডিজাইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। ডিজাইন একই ধরনের নয়, যে কারণে পথচারীরা ফুটপাত ব্যবহার করে না। তারা ফুটপাতের নিচের অংশ, যা মূল রাস্তারই অংশ সেটাই ব্যবহার করে। এ কারণে চলমান গাড়ি বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে যানজট বৃদ্ধি পায়। ওই বিশেষজ্ঞ আরো বলেছেন, একমাত্র আদেশ নির্দেশ দিয়েই পথচারীদের নির্বিঘ্নে ফুটপাত ব্যবহার করানো যাবে না। এ কারণেই তিনি ডিজাইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। সব সিটি করপোরেশনের উচিত হবে সুযোগ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ডিজাইন পুনর্বিন্যাস করা। মূলত নগর পরিকল্পনা একটি জটিল বিষয়। বিষয়টি বহুমাত্রিক। বিষয়টি ফুটপাত, পার্ক, উন্মুক্ত স্থানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যে আরো রয়েছে : বাসস্থান, পয়োনিষ্কাশন ও নিরাপদ পানি ব্যবহারের সুযোগ। বলা বাহুল্য, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে শেষোক্ত বিষয়গুলোই নগর পরিকল্পনার দুর্বলতম ক্ষেত্র। এ দুর্বলতা আরো প্রকট হওয়ার কারণ গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শহরমুখী হওয়া, বিশেষ করে ঢাকামুখী। এ জনগোষ্ঠী জীবিকা অর্জনের জন্যই শহরে আসেন। তাঁরা বাঁচতে চান। তবে অপেক্ষাকৃত বিত্তবানরাও শহরে আসেন। তাঁরা উন্নত জীবনযাত্রার সুযোগ নিতেই শহরমুখী হন, তবে তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি হবে না।
সংশ্লিষ্ট আদেশ পালনের বিষয়ে বলা যায়, প্রথম কয়েক দিন এ আদেশ কেউ মানেনি। এমনকি রমনা পার্কসংলগ্ন হেয়ার রোডেও মোটরসাইকেল চালকরা ব্যবহার করছেন। তাঁদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যসহ সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন। হয়তো হাইকোর্টের আদেশ সম্পর্কে তাঁরা জ্ঞাত ছিলেন না। আদেশ সম্পর্কে অবহিত না হলেও বলা যায় যে এ ধরনের কার্যক্রম যে বেআইনি, তা তাঁরা নিশ্চয়ই অবগত ছিলেন। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, বর্তমানে এ প্রবণতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এ জন্য হাইকোর্টকে জানাই সাধুবাদ। তবে এ দৃশ্যপট স্থায়ীরূপ লাভ করবে কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ যে বিষয়টি দৃশ্যমান তা হলো, মোটরসাইকেলের আধিক্য। প্রতিদিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণত স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীই মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। অফিসে বা নিজস্ব কর্মস্থলে সময়মতো পৌঁছার তাগিদেই তাঁরা মোটরসাইকেল ক্রয় করেন। রাস্তা যানজটমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত হয়তো বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চক্ষু এড়িয়ে তাঁরা সুযোগ পেলেই ফুটপাত ব্যবহার করবেন।
ফুটপাত হকারদের দখলমুক্ত করার বিষয়টির দৃশ্যপট ভিন্নতর। কারণ বিষয়টি জটিল। এর সঙ্গে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রও যুক্ত। ১৭ মার্চ শনিবার একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে আদেশের কার্যকারিতার বিষয়ে কিছু তথ্য প্রণিধানযোগ্য। প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল 'শহরের ফুটপাতে হকার ও চাঁদাবাজদের আধিক্য'। উপশিরোনাম ছিল 'হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘন'। আদেশ লঙ্ঘনের বিষয়টি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে এ ক্ষেত্রে অপরাধী হবেন নির্বাহী বিভাগের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। কারণ হাইকোর্ট তাঁদেরই নির্দেশ পালনের আদেশ দিয়েছেন বা কেন দেওয়া হবে না তার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কারণ দর্শাতে বলেছেন। প্রকাশিত এ সংবাদে দেখা যায় যে বিষয়টি বিভিন্ন শ্রেণীর জনমানুষের স্বার্থবিষয়ক দ্বন্দ্বের আবর্তে ঘুরপাকবিদ্ধ। পথচারীদের আক্ষেপ, তাঁরা ফুটপাত ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছেন না হকারদের কারণে। হকারদের যুক্তি হলো- তাঁরা নিয়মিত চাঁদা দিয়েই ফুটপাত ব্যবহার করে থাকেন। চাঁদাবাজরা বিভিন্ন শ্রেণীভুক্ত। তাঁদের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ক্যাডারের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, এমনকি বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষের কিছু লোক। এ শ্রেণীভুক্তদের জন্য এটাও একটি ভিন্নধর্মী জীবিকা উপার্জনের বা বাড়তি আয়ের সুযোগ, যা নিঃসন্দেহে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
প্রকাশিত সংবাদে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা সুষ্ঠু নগরজীবনের একটি জটিল চিত্র। তবে এসব বন্ধ করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। প্রশ্ন হলো, হাইকোর্টের নির্দেশটি আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না। সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু নগরজীবন নিশ্চিত করার অনাগ্রহ বা অক্ষমতা নগরবিষয়ক অন্যান্য ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান। গৃহনির্মাণের বিষয়ে এ সম্পর্কিত বিল্ডিং কোড বা আইনের কোনো তোয়াক্কাই করা হয় না। অবাধে তা অমান্য করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ রাজউক এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অথচ আইনে ওই কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ অক্ষম কেন তা নিয়ে মিডিয়া অনেক অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করেছে এবং এখনো করছে। মনে হয়, মিডিয়া পরাজয়মুখী একটি সংগ্রামে লিপ্ত।
হাইকোর্ট ইতিপূর্বে নদীতীরবর্তী জমি অবৈধ দখলমুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর সঙ্গে ছিল, এসব জায়গায় যেসব অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো ভেঙে দিতে হবে। জোরেশোরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করে। ক্রমেই এ তৎপরতা স্তিমিত হয়ে যায়। হাইকোর্ট ঢাকার সব নদীকে দূষণমুক্ত করারও নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। একই সঙ্গে ছিল নদীতীরবর্তী জমির সীমানা চিহ্নিত করার। এ কাজটি শুরু হলেও এক বছরের বেশি সময়েও শেষ করা হয়নি। সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে বলা সম্ভব যে সব ক্ষেত্রেই জটিলতা রয়েছে। মূল জটিলতা হলো, চার দশক ধরে সব ক্ষেত্রেই করণীয় বিষয় উপেক্ষা করা হয়েছে। উপেক্ষিত হওয়ার জন্য চার দশকের পুঞ্জীভূত সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। ৪০ বছরের জঞ্জাল দু-তিন সপ্তাহ বা এক বছরে সাফ করা যাবে না, তবে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। পরিকল্পনা সঠিক হতে হবে। হাইকোর্ট এসব নির্দেশ না দিলে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা বৃদ্ধি পাবে। নগরজীবনে দুর্ভোগ আরো বৃদ্ধি পাবে।
এ দুর্ভোগ হ্রাস করার সরাসরি দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। কর্তৃপক্ষ যদি সে বিষয়ে উদাসীন হয়, সমস্যা অধিকতর জটিল হবে। এমন একটা সময় আসবে যখন যত নির্দেশই দেওয়া হোক না কেন, তা বাস্তবায়িত হবে না। সেদিন আসুক তা কারো কাম্য নয়। এ বিষয়টি নির্বাহী কর্তৃপক্ষের উপলব্ধি করা অতীব জরুরি। অন্যদিকে জনস্বার্থবিষয়ক মামলায় হাইকোর্ট তার অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হোক- এটাও কাম্য নয়। নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতার জন্যই এ ধরনের আদেশ-নির্দেশ জরুরি। কারণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার অন্য রাষ্ট্রীয় অঙ্গ অর্থাৎ সংসদ তিন বছর ধরেই সম্পূর্ণ অচল না হলেও বহুলাংশে অকার্যকর। কমবেশি এ দৃশ্যপট ১৯৯১ সাল থেকেই ছিল। সার্বিক বিষয়টি সুশাসনের বিষয়ভুক্ত।
সুশাসনের অভাবের জন্য চলমান বিতর্কে রাজনৈতিক অস্থিরতাকেই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে সরকার বদলের দৃশ্যপট সত্ত্বেও সুশাসনের অভাব হয় না। কারণ ওই সব দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও ঠিকমতো নাগরিক সেবার অভাব হয় না। মূল কারণ স্থায়ী ও দক্ষ আমলাতন্ত্র। এ দেশে বহুবিধ কারণে এবং অনেক দিন ধরেই এ ক্ষেত্রে দক্ষতা হ্রাস পেয়েছে। আর একটি কারণ হলো, উন্নয়নের অজুহাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থের অপব্যবহার হয়। বিষয়টি রাজনৈতিক। কয়েক দিন আগে এ বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী কিছু তথ্য মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। মূল প্রতিপাদ্য ছিল রাজনৈতিক প্রভাবে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের এডিপিতে অন্তর্ভুক্তি। এ অর্থের অপচয় না করে সুষ্ঠু নগরসেবার সুযোগ ও মান বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিল।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.