নোবেল বিজয়ীর প্রতি এ কেমন আচরণ? ব্য মাহফুজ আনাম

মুহাম্মদ ইউনূস

তাহলে ‘রক্তচোষা’ আর ‘কোটি কোটি টাকা তছরুপ’ করা নিয়ে এত কথাবার্তার পর আমাদের একমাত্র নোবেলজয়ী ও বিশ্ববাসীর প্রশংসাধন্য ক্ষুদ্রঋণের দিশারি ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূসের আসল দোষ হলো ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে থাকার বয়স পেরিয়ে গেছে আর তাঁর পুনর্নিয়োগ অনুমোদন করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক? গতকালই কি তাঁর বয়স পেরোল, নাকি সাম্প্রতিক অতীতে? মুহাম্মদ ইউনূসের বয়স এখন ৭০। তাহলে এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং কয়েকটি সরকার, যারা এল-গেল, তারা এত বছর কী করছিল? তাঁর পুনর্নিয়োগের তথাকথিত অনিয়ম কেন আগেই ঠিক করা হলো না? প্রশাসনিকভাবে অথবা আদালতে কেন সেই প্রক্রিয়াটিকে চ্যালেঞ্জ করা হলো না? গত ১০ বছর যা কোনো ইস্যু ছিল না, তা কেন হঠাৎ ইস্যু হয়ে উঠল?
জবাবটা সোজা। সরকার তাঁর বিদায় চায় আর তাই তাঁকে যেতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি খোলাসা করে বলেছিলেন সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে। সেখানে তিনি ইউনূস ও ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কে বলেছিলেন, গরিবের ‘রক্তচোষা’, আর বলেছিলেন, গরিবের নামে ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না। হঠাৎ ইউনূস ভিলেনে পরিণত হলেন। আর গণমাধ্যমের একাংশ মিথ্যা ও অত্যন্ত অবমাননাকর প্রচারণা চালিয়ে তাঁর চরিত্রে কালিমা লেপন করল। উদ্ভট অভিযোগে উদ্ভট মামলা হতে লাগল।
নিশ্চয়ই একসময় অধ্যাপক ইউনূসকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটির নেতৃত্বের দায়িত্ব ছাড়তে হবে। নোবেল জয়ের বুদ্ধি যেহেতু তাঁর আছে, তাঁর নিশ্চয়ই এই বুদ্ধিও আছে যে তিনি আজীবন গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকতে পারবেন না। সুতরাং তাঁর উত্তরসূরির প্রশ্নটি খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত যে পথে হাঁটল, তাতে পরিষ্কার যে সরকারের দুরভিসন্ধির পেছনে গ্রামীণ ব্যাংকের লাখ লাখ ঋণগ্রহীতার স্বার্থ কিংবা ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা ভালো করার ব্যাপার নয়, বরং রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির এবং দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার হিসেবে ক্ষুদ্রঋণের খ্যাতির মারাত্মক ক্ষতিসাধন করবে।
পুনর্নিয়োগের বিষয়টি এখন যেহেতু আদালতে বিচারাধীন, তাই এখন আমরা আইনগত বিষয়ে আদালতের নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকব। আমরা আজ নজর দেব, ইউনূসের কাজ কিসের প্রতিনিধিত্ব করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দারিদ্র্য বিমোচনে বহু প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনোটাই ক্ষুদ্রঋণের মতো বিশ্ববাসীর মন কাড়তে পারেনি। এখন সব মহাদেশের অনেক দেশের দরিদ্রতম অংশের জন্য ঋণ দেওয়ার এই বিশেষ মডেলটি চর্চিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেনসহ পশ্চিমা উন্নত পুঁজিবাদী বিশ্বের দেশ থেকে শুরু করে চীনসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো, সৌদি আরব ও উপসাগরীয় কয়েকটি রাজতান্ত্রিক দেশ, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ এখন ক্ষুদ্রঋণকে গ্রহণ করে নিয়েছে। এই দারিদ্র্য বিমোচন মডেলের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ও ইউনূসের খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলস্বরূপ ইউনূস ও তাঁর তৈরি করা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতে আমাদের জনগণের জন্য অসীম গর্ব বয়ে এনেছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ কতটুকু সফল হয়েছে, তা নিয়ে তর্ক আছে। কিন্তু কোনো না-কোনোভাবে এটা যে গরিবদের সহায়তা করেছে, সে ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই। বহু অনুসন্ধানে তা প্রমাণিত।
ক্ষুদ্রঋণ ঋণগ্রহীতাকে ঋণের জালে আটকে ফেলে—এমন যুক্তি দিচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা নজর দিয়েছেন কয়েক শ (হয়তো কয়েক হাজার) ব্যর্থ ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতার ওপর; আর যে লাখ লাখ মানুষ ক্ষুদ্রঋণের সুবিধাভোগী, তাদের তারা উপেক্ষা করছেন। শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতার সংখ্যা এখন ৮০ লাখ। অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার সঙ্গে মিলে দুই কোটি ঋণগ্রহীতা। ঋণের জালে তাদের কত জন পড়েছে—হয়তো কয়েক হাজার। দুই কোটির তুলনায় তা কত শতাংশ? এই বিতর্ক ভাবাদর্শ কিংবা অনুমানভিত্তিক না হয়ে আরও বেশি তথ্যনির্ভর হওয়া দরকার।
অধ্যাপক ইউনূসের বিশাল কাজের শুধু একটি দিক অর্থনৈতিক। গ্রামীণ ব্যাংকের আগে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান নারীকে তাদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রাখেনি। বাংলাদেশের জন্য তা বৈপ্লবিক ফল বয়ে এনেছে। যে গ্রামীণ গরিব নারীদের কখনো আর্থিক লেনদেনের সুযোগ ছিল না, সেই সুযোগ তাদের দিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। প্রমাণিত হয়েছে, তারা বিচক্ষণ ও তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন বিনিয়োগকারী এবং অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ঋণগ্রহীতা, যাদের ঋণ ফেরত দেওয়ার হার ৯৯ শতাংশ। হাতে অর্থ আসায় নারীরা আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান অর্জন করেছে, পারিবারিক বিষয়ে তাদের কথা বলার জায়গা তৈরি হয়েছে, এত দিন যা ছিল পুরুষদের একচেটিয়া। তারা ভালোভাবে বিনিয়োগ করে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিয়েছে।
নারী আন্দোলন হয়তো লিঙ্গীয় প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে এসেছে, কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের কাজের ফলেই (পরে অন্যরা তা অনুসরণ করেছে) আমাদের গ্রামীণ নারীদের রূপান্তর ঘটেছে, তাদের মানসিকতা, বিশ্ববীক্ষা ও নেতৃত্বের সামর্থ্য চিরতরে বদলে গেছে। অর্থ যখন কথা বলে, বিশেষত দারিদ্র্যের পরিবেশে, তখন গ্রামীণ ব্যাংকের কল্যাণে নারীদের আর্থিক ক্ষমতায়ন আমাদের নারীদের কণ্ঠস্বর আরও জোরালো করে। এর ফলে তারা অধিক হারে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এবং স্থানীয় সংস্থাগুলোতে সংরক্ষিত আসন দাবি করার দিকে এগিয়েছে।
সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার হলো, গ্রামীণ ব্যাংক এবং বেশ কিছু এনজিওর কর্মকাণ্ড নারীদের ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে, তাদের অধিকতর সচেতন করে তোলার মাধ্যমে এবং এভাবে গ্রামাঞ্চলে সম্ভাব্য মৌলবাদী উত্থান প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। মৌলবাদ মোকাবিলায় আমাদের এনজিওগুলোর ভূমিকা আর এই প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ভূমিকা অস্বীকারের উপায় নেই।
নারীকে সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রেখে গ্রামীণ ব্যাংক নেতৃত্ব দিয়েছে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, ফতোয়ার অপব্যবহার ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। ঋণগ্রহীতাদের দল গঠনের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক একটি সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া চালু করে, যা নারীদের মধ্যে মিত্রতা তৈরি করে। পুরুষের নিপীড়ন এবং সামাজিক প্রয়োজনের সময়ে একে অন্যের পাশে দাঁড়ায়—বিদ্যমান গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোর ক্ষয় ঘটিয়ে এক ধরনের সামষ্টিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। এনজিও এবং বিশেষত গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের প্রতি ধর্মীয় চরমপন্থীরা যে বরাবর ঘৃণা প্রকাশ করে আসছে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
অনেকটা জায়গাজুড়ে নারী বিষয়ে আমরা লিখলাম শুধু এ কারণে যে নারীর মুক্তি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কেন্দ্রে অবস্থিত, আর এতে গ্রামীণের ভূমিকা পুরোপুরি উপলব্ধি করা প্রয়োজন।
ইউনূসের স্বাপ্নিক নেতৃত্বে গ্রামীণ ব্যাংক ডানোন, এডিডাস, ভায়োলা ইত্যাদি বৈশ্বিক কোম্পানির সঙ্গে উদ্ভাবনী অংশীদারিতে গেছে, যার মাধ্যমে পুষ্টিকর দই, সস্তা জুতা এবং নিরাপদ খাওয়ার পানি সস্তায় দেওয়া হবে। গ্রামীণের অপূর্ব অংশীদারি গড়ে ওঠে নরওয়ের টেলিনরের সঙ্গে, যা গ্রামীণফোন সৃষ্টি পর্যন্ত গড়ায়। গ্রামীণফোন দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন কোম্পানি, অন্যদের চেয়ে অনেক ব্যবধানে এগিয়ে। এটি এখন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় করদাতা কোম্পানি, যার বার্ষিক করের পরিমাণ ৯০০ কোটি টাকা।
এত কিছু ইউনূস করেছেন নিজের জন্য এক টাকাও মুনাফা না নিয়ে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তিনি যে বেতন পান (যা সরকারের সচিবের সমতুল্য, তবে অন্যান্য ভাতা নেই), তাতেই রয়ে গেছে, আর তাঁর গড়ে তোলা প্রায় দুই ডজন কোম্পানি থেকে তিনি কিছুই নেন না। তাঁর দপ্তর অনাড়ম্বর। বইয়ের তাক, কয়েকটি কাঠের চেয়ার আর নিজের জন্য একটা বর্গাকার ডেস্ক। ছোট একটি পাঁচতলা দালানে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের আরও চারজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে ভাগ করে বসবাস করেন। তাঁদের প্রত্যেকে একেক তলায় থাকেন। নোবেল পাওয়ার আগে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত বাহন ছিল না, কোথাও যেতে হলে ব্যাংকের মাইক্রোবাস ব্যবহার করতেন। সব সময় তাঁর পরনে থাকত গ্রামীণ চেকের পোশাক, যেটি এখন বৈশ্বিক ট্রেডমার্ক হিসেবে সুপরিচিত। তিনি যেখানেই যান, ইদানীং তো সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছেন, সেখানেই তা বাংলাদেশের পোশাক ও নকশা তুলে ধরে।
বাংলাদেশে আমরা সব সময় অভিযোগ করি যে বিশ্ববাসী আমাদের অর্জনের স্বীকৃতি দিচ্ছে না; আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম শুধু নেতিবাচক চিত্রই তুলে ধরে। তো ইউনূসকে স্বীকৃতি দিল বিশ্ব আর বিশ্ব-গণমাধ্যমেও তাঁকে নিয়ে বিরামহীনভাবে প্রশংসামূলক লেখালেখি হলো। অবশেষে যখন একজন ব্যক্তি বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে নিয়ে গেলেন, আমরা তাঁকে ‘অপসারণ’ করলাম, তাঁকে অভিহিত করলাম ‘রক্তচোষা’ গরিব-শোষক বলে। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিলাম। কত সুন্দরভাবে আমরা দেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরলাম!
শুধু নোবেল পুরস্কার নয়, আরও অনেক মর্যাদাকর পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। অধ্যাপক ইউনূসের মতো এত বেশি পুরস্কার ও সম্মান হয়তো নিকট অতীতে আর কেউ পাননি। তাঁর কাজের ওপর বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স পরিচালনা করা হয়। বিভিন্ন বিভাগ ও কেন্দ্রের নামকরণ হয়েছে তাঁর নামে। প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এমন কোনোটা খুঁজে পাওয়া কঠিন, যেখানে বক্তৃতা দিতে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সম্প্রতি বিশ্বনেতারা যেখানেই মিলিত হয়েছেন, সেখানে কথা বলার জন্য তাঁকে ডাকা হয়নি—এমন ঘটনা বিরল। তাঁর লেখা বই প্রায় সব নামকরা বইয়ের দোকানে স্থান পায়। ইউনূসের অর্জনের এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হলো এ জন্য যে, তিনি বাংলাদেশকে কোন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। বিশ্বের দরবারে আমাদের দেশকে পরিচিত করানোর ক্ষেত্রে মুহাম্মদ ইউনূস যে ভূমিকা রেখেছেন, আর কোনো ব্যক্তি তাঁর কাছাকাছিও যেতে পারেননি।
যে ব্যক্তি আমাদের এত সম্মান, মর্যাদা ও স্বীকৃতি এনে দিলেন, তাঁর প্রতি আমাদের আচরণের এই কি পথ?
ইংরেজি থেকে অনূদিত
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, ডেইলি স্টার।

No comments

Powered by Blogger.