মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশ ছাড়াল

দেশে মূল্যস্ফীতির হার ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হয়ে চলেছে। চলতি বছর জানুয়ারিতে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে জাতীয় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। আর বার্ষিক গড় ভিত্তিতে এই হার ৮ দশমিক ১৪ শতাংশে ঠেকেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ভোক্তা মূল্যসূচকের ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির এই হার নির্ণয় করে থাকে।
হালনাগাদ এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জানুয়ারিতে এসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১২ শতাংশের কাছাকাছি (১১ দশমিক ৯১ শতাংশ) পৌঁছে গেছে, যা কিনা ৩০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর পল্লি এলাকায় খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশে উপনীত হয়েছে।
এর মানে হলো, মানুষকে খাদ্যের জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে; আর গ্রামের মানুষকে আরও বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রার জোগানে লাগাম টেনে আর সরকার খোলাবাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে চাল বিক্রিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়েও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রুখতে পারছে না।
বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণভাবে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা বিশেষত সরবরাহজনিত কিছু সংকট মূল্যস্ফীতিকে ক্রমেই উসকে দিচ্ছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপাত্ত থেকে আরও দেখা যায়, পল্লি এলাকায় সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার জানুয়ারিতে সাড়ে ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা কিনা ডিসেম্বরে ছিল পৌনে ৯ শতাংশ। আর শহর এলাকায় সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার জানুয়ারিতে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশে; যা কিনা নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির চাপ যে ক্রমশ বাড়বে, তা অবশ্য তিন-চার মাস আগে থেকেই বিভিন্নভাবে তার সুস্পষ্ট আভাস মিলেছে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও ভোগ্যপণ্যের দাম গত বছরের শেষার্ধে যেভাবে বেড়েছে, তা অনিবার্যভাবে দেশের আমদানিজনিত ব্যয় বাড়িয়ে তুলেছে। এভাবে বেড়েছে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ।
২০১০ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়কালে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল (ব্রেন্ট অশোধিত জ্বালানি), চাল (থাইল্যান্ড ২৫ শতাংশ ভাঙা), গম (এইচআরডব্লিউ) এবং ইউরিয়ার দাম বেড়েছে যথাক্রমে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ, ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ, ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ ও ৩৭ দশমিক ৪০ শতাংশ হারে।
আবার মুদ্রা সরবরাহও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছে সাড়ে ২১ শতাংশ, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই হার সাড়ে ১৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে চায়।
ডিসেম্বরের শেষে এসে মুদ্রা সরবরাহের স্থিতি দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৯৯ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। আর জুনের শেষে এই স্থিতির পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৬৩ হাজার ৩১ কোটি ২০ লাখ টাকা।
মুদ্রার জোগানে লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক ১ ডিসেম্বর থেকে ব্যাংকের বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) সাড়ে ১৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৯ শতাংশ এবং নগদ জমার হার (সিআরআর) সাড়ে পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ছয় শতাংশ নির্ধারণ করে।
এভাবে নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতির দিকে ধাবিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এই পদক্ষেপের তাৎক্ষণিক বা দ্রুত প্রভাব পড়েনি। বরং আরও কয়েক মাস পর এর প্রভাব মুদ্রার সরবরাহের ওপর পড়বে বলে ধারণা করা যায়। কেননা, মুদ্রানীতির প্রলম্বিত প্রভাব (ল্যাগ অ্যাফেক্ট) সর্বত্রই বিদ্যমান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বশেষ ঘোষিত মুদ্রানীতিতে চলতি অর্থবছরের গড় মূল্যম্ফীতি সাত শতাংশে বেঁধে রাখার কথা জানিয়েছে। অবশ্য গত বছর জুলাইয়ে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এই হার সাড়ে ৬ শতাংশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
বিশ্বজুড়েই এখন মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে। খাদ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এই মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে।
বিশ্ববাজারেও খাদ্যসামগ্রীর দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) যে বিশ্বখাদ্য মূল্যসূচক প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বে খাদ্যের মূল্য টানা অষ্টম মাসের মতো বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে এই সূচক দাঁড়িয়েছে ২৩৬ পয়েন্টে, যা জানুয়ারিতে ছিল ২৩১ পয়েন্ট।
ফাও এই বলে আরও সতর্ক করে দিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার রাজনৈতিক সংকট এবং জ্বালানি তেলের দামে উল্লম্ফন বিশ্বে খাদ্যের মূল্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.