গল্পালোচনা- হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

ন ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ের চূড়ায় দৃষ্টিপথে, যেখানে অন্নপূর্ণা, কাঞ্চনজঙ্ঘা, ধবলগিরি, নন্দাদেবী। সাদা বরফের চূড়ায় সূর্যের সোনালি পরশ, ফেরারি মন ধায় ঊর্ধ্বলোক থেকে আরও ঊর্ধ্বপানে। পাখা নেই, তবুও আজ আমি হিমালয়। জিএমজির সুবিশাল বিমানে উপভোগ করছি মনোরম দৃশ্য, আর মনের কুঠরিতে বন্দী করি অনুপম মুহূর্তের নির্যাস।
হিমালয় এত কাছে, হিমালয় হতে পারি না। জয়ন্তী চা-বাগানের কোলে পাহাড়িদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়, দার্জিলিংয়ের কার্ট রোড চত্বরে, টাইগার হিলে সূর্যোদয়ের আগে চা পান করেছি, সরল হূদয় সেই মানুষগুলোকে এত বছর কেটে যাওয়ার পরও মনে করতে পারি। সরলতা খুঁজতে চাইলে পাহাড়ি মানুষ হয় অনুপ্রেরণা। দার্জিলিংয়ে বয়স সাত-আট, পুঁতির মালার দোকানে পাথরের একটি মালা সন্তর্পণে সরিয়ে ফেলি। চার আনাও হবে না। বাল্যচৌর্যের অপরাধ মনকে বিক্ষত করে। ছেলেমেয়েদের কোলে তুলে, জামা পরিয়ে অপরাধ স্খলনের প্রচেষ্টা। চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলেও তাই। এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু কাপ্তাই বাঁধ তৈরি করার সময় নৈতিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ওরা সরল, ঠকানো সহজ। পাহাড়িদের সঙ্গে সমতলবাসীর দ্বন্দ্ব ৩০ বছর ধরে। উত্তাল নেপাল, টালমাটাল দার্জিলিং, পর্যুদস্ত পাহাড়ি চট্টগ্রাম। ওদের সঙ্গে সমতল তেমনটি ভালো ব্যবহার করেনি, যেমনটি উচিত ছিল।
অনতিদুর্গম চিতোয়ান অরণ্যে সপরিবারে, বৃক্ষরাজির তলে সূর্যের আলো পৌঁছায় না যেখানে। অরণ্য মন টানে, ভালো লাগে শব্দহীন তন্ময় চিন্ময় প্রহর। ফরেস্ট আইল্যান্ডে কয়েকটি কটেজ, যার সামনে আমরা কয়েকটি প্রাণী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছি বেড়াতে। পরমানন্দে ঘুরে বেড়ায় নারায়ণী নদীর তীরে নীলকণ্ঠ রাজহাঁস, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা’ বর্ণিত অসংখ্য বক। অজগর, চিত্রল হরিণ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, বুনো হাতি ও রাইনো। প্রথম দিনেই ভোরবেলায় জঙ্গলাভিসারে ছোট্ট গ্রুপের মুখোমুখি রাইনো। নির্বিঘ্নে খুঁজে নিচ্ছিল সে সবুজ তৃণের ব্রেকফাস্ট। রাইনো অন্তর্হিত হওয়ার পর কলাম্বিয়ান, ক্রোয়েশিয়া, হার্জেগোভিনা, হল্যান্ডের বন্ধুদের সঙ্গে আমি ও গাইড বাকহীন। তেমন ভয় পাইনি। রাইনো বৃহৎ প্রাণী, শক্তিধর হলেও অত্যাচারিত ও ক্ষুধায় কাতর না হলে আক্রমণ করে না। তৃণভোজী রাইনো, হাতিও। পাহাড়িরা অধিকাংশই নিরামিষাশী। আক্রমণ করে না, অত্যাচারিত হলে রুখে দাঁড়ায়। সমতলের মাংসাশী প্রাণী মানবজাতি, হিংসায় উন্মত্ত।
চিতোয়ানের বুনো হাতি-রাইনো ক্রমপরিবর্তনশীল রাজনীতির স্পর্শ থেকে বঞ্চিত। ২০০৬ সালের এপ্রিলের উত্তাল গণবিপ্লবের ঢেউও বাংলাদেশ পর্যন্ত পৌঁছায়নি। নেপালের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে আহ্বান জানানো হয় প্রকাশ্য রাজনীতি করার। প্রস্তুত হলো সিপিএ অর্থাৎ কমপ্রিহেন্সিভ পিস এগ্রিমেন্ট। সাত রাজনৈতিক দল ও মাওবাদীরা ২১ নভেম্বর ২০০৬ সালে চুক্তিতে দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ, ফেডারেল, রিপাবলিকান ও সিভিলিয়ান আওতায় নেপালি আর্মি, রাজকীয় সম্পত্তির জাতীয়করণ, নতুন জাতীয় সংগীত ও হতবঞ্চিত দরিদ্রের সমানাধিকার অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান। সিপিএর তিনটি তারিখ পিছিয়ে গেল, নতুন শাসনতন্ত্র লেখা হলো না, আরও নতুন ২৩টি পয়েন্ট যুক্ত হলো, ইলেকশন কমিশন যেটাই করুক, বিরোধীরা করে বিরোধিতা। তরাই অঞ্চলের সঙ্গে মালিন্য বেড়েই চলে, যাতে থারুস, রাইস, লিম্বাস, তামাং, গুরুং, মাগার, দলিত ও নেওয়াররা চাইতে থাকে স্বায়ত্তশাসন। নেপালের স্পেশাল টাস্কফোর্স (এসটিএফ) দেশটিকে একসূত্রে গাঁথতে হয় অসমর্থ। আর্মিপ্রধান জেনারেল আর কাতাওয়াল বলছেন, তাঁর আর্মিতে মাওবাদীরা থাকতে পারবে না। নেপাল আর্মড ফোর্সের সংখ্যা এক লাখ ৬৫ হাজার (৯২ হাজার নেপালিজ আর্মি, ৪৮ হাজার সিভিলিয়ান ফোর্স ও আর্মড পুলিশ ফোর্স ২৫ হাজার)। আর্মিরা ব্যারাকে। অন্য দুটি ফোর্সের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়। মধ্যবিত্তরা দুর্বলতম অবস্থানে। শাসকেরা পুলিশই হোক অথবা বিভিন্ন অফিসের চূড়ায়, গরিবদের চিন্তা থেকে বহুদূরে। জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার সভাপতি কে এন উপাধ্যায় বলেছেন, অধিকার সংরক্ষণের জন্য যে আন্তরিক প্রয়াস প্রয়োজন, তার আয়োজন নেই কোনো পক্ষেরই। গরিবেরা দিন দিন গরিব হয়ে যাচ্ছে, তাদের কথা চিন্তা করার কেউ নেই। তাই মাওবাদীরা তাদের আশ্রয় করে শক্তি সঞ্চয় করেছে। সময়মতো নির্বাচন না হলে শাসনতন্ত্র ফিরে যাবে ১৯৯১-এর শাসনতন্ত্রে। পূর্বতনরা খুশি হবে এতে, রাজনীতি হবে আরও উত্তালতার মুখোমুখি। সিভিল সোসাইটি বলছে নতুন একটি সর্বসম্মত সরকারের কথা, যাতে এপ্রিল ১০-এর নির্বাচনে মাওবাদী, তরাই অঞ্চলের গরিব, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের সমন্বয়ে সর্বসম্মত নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়।
জগতের হিন্দু রাষ্ট্র বলতে নেপাল। মন্দিরে ও তার বাইরে পেয়েছি ধর্মানুসারী হিসেবে। হিন্দু ও বৌদ্ধমন্দির কখন যেন মিলেমিশে একাকার। ঘণ্টা স্পর্শ করলে অথবা গোলাকার রোলগুলো ঘুরিয়ে দিলে মন্দিরের কাজ শেষ। তবুও স্পর্শ, তবুও কাছে আসা। বাড়ির পাশের হিন্দুদের দেখছি, মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট শিক্ষা ক্রমেই ফিকে করে দিচ্ছে ধর্মবোধ। কলকাতার পূজামণ্ডপে আরতিরত পুরোহিত, প্রণতিতে আনত নারী, আর ঠাকুর দেখতে অগণিত। গন্তব্য: হিন্দি গান, মনিহারি তৈজস। নতুন গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদের লেখায় জানা যায়, সনাতন হিন্দুধর্ম দূরাগত বংশীধ্বনির মতো। তবু শীর্ষেন্দুর মতো কিছু লেখক ওদের ধর্মবোধকে জাগ্রত রেখেছেন।
নেপালিরা ভালোবাসে ট্যুরিস্ট। পছন্দের লিস্টে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পছন্দ করার কারণ জিজ্ঞেস করায় জবাব পেলাম, ভালোবাসা পাই, যেটা পাশের বাড়ি থেকে পাই না, যদিও ওরা হিন্দু। যে ভালো ব্যবহার করবে, জিতে যাবে সে-ই। বারাক ওবামা এই নীতিটি ধার নিতে পারেন।
মাষকলাইয়ের ডাল আর পাহাড়ি নদীর মৌরলা মাছ সমান পছন্দ আমার ও নাতি আলভির। হিউয়েন সাং বর্ণনায় এই মাছটিকেই মূল্য দিয়েছেন। রাঁধতে হয় যত্নসহকারে, অল্প তেল ও অল্প মসলায় মাখো মাখো। নেপাল, ভুটান, কোচবিহারে একই রান্না। গাছ থেকে কমলা পেড়ে খেতে কী আনন্দ, হাতির পিঠে নারায়ণী নদী পাওয়ার কী সুখ, আলভি তা বুঝেছে, বলেছে সে ইউরোপের ট্যুরিস্টদের কাছে।
‘নেপাল দর্শন ট্যুরিস্ট বছর’ ২০১১। ট্যুরিস্ট আসার কথা ১০ লাখ। সবুজ বাংলাদেশের কক্সবাজার ও সুন্দরবনের কথা ট্যুরিস্টরা জানে। কাঠমান্ডু, পোখারা ও অন্যান্য শহরে অনতিবিলম্বে ট্যুরিস্ট অফিস বসাই নানা হোটেলে। অন্তত এক লাখ ট্যুরিস্ট কক্সবাজারে আসতে রাজি হবে। সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ সম্ভব, মাননীয় পর্যটনমন্ত্রী ব্যবস্থা নিলে। দুই ডজন রোটার্যাক্টর-ভলান্টিয়ার আমার ইঙ্গিতে বাংলাদেশে ও নেপালে কাজ করার জন্য প্রস্তুত। কাঠমান্ডু থেকে সোজা কক্সবাজার ডেইলি ফ্লাইটে ৫০০ জন বিদেশি ট্যুরিস্ট আসার ব্যবস্থা, কক্সবাজারে ১০টি হোটেলে তাদের থাকার ব্যবস্থা, সঙ্গে সুন্দরবনের বিহার সংযোজন, আমন্ত্রণের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে [কোনোক্রমেই ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যামের সন্ধান যেন না পায় ওরা]। কুনমিং থেকে প্রতিবছর দুই লাখ চীনা ট্যুরিস্টের বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলাম চীন থেকে ফিরে। কর্তাব্যক্তিরা যোগাযোগ করেননি। অধম লেখকের লেখার কী বা মূল্য!
হিমালয়ের প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ। নিবিড়তর হতে পারি। পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকে। এক ও অভিন্ন আমরা, শুধু রান্নাঘর আলাদা করেছি। সাধারণ লোকেরা হিমালয়ের আহ্বান শুনতে পাই, শুনতে পান না নীতিনির্ধারকেরা।
============================
পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!  ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উইকিলিকস সমর্থকদের  কানকুনঃ মুমূর্ষু পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষ  নারীর হার-নারীর জিত, বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক  সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত  বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব  মুক্তির গান  এক-এগারোর জুজুটাকে হিমাগারে পাঠান  জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জাগরণ সৃষ্টি করুন  সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্পসল্প


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ মুস্তাফা জামান আব্বাসী
সাহিত্য, সংগীতব্যক্তিত্ব।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.