মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা by সেলিম রেজা নূর

আমি নিউইয়র্কে থাকি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আর্কাইভস ঘেঁটে সিরাজুদ্দীন হোসেনের অনেক লেখা সংগ্রহ করেছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর, কাশ্মীর সমস্যা, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা বইবিষয়ক সমস্যা, ভাষা আন্দোলন, পাট সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে তাঁর স্বনামে প্রকাশিত লেখাগুলো আগ্রহোদ্দীপক। ‘অনামী’ ছদ্মনামে সিরাজুদ্দীন হোসেনের ‘মঞ্চে-নেপথ্যে’ কলামগুলোও সংগ্রহ করতে পেরেছি। অপেক্ষা করছি, একদিন সিরাজুদ্দীন হোসেনের সত্যিকার অবদান সম্পর্কে গবেষণা হবে এবং তিনি পাবেন তাঁর যোগ্য আসন। ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় সিরাজুদ্দীন হোসেন থাকতেন বেকার হোস্টেলে। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, কাজী গোলাম মাহবুব, আসফউদ্দৌলা রেজা, শামসুদ্দীন মোল্লা প্রমুখ। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তখন থেকেই সখ্য ছিল সিরাজের। বন্ধু শেখ মুজিবকে ইত্তেফাক-এর মাধ্যমে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার রূপকারদের মধ্যে সিরাজ ছিলেন অন্যতম। শুধু একাত্তরের মার্চ মাসে প্রকাশিত ইত্তেফাক-এর শিরোনামগুলোর দিকে নজর দিলেই আমরা তার প্রমাণ পাব। এই ফিচারে আমরা সিরাজুদ্দীন হোসেনের লেখা একটি অবতরণিকা নিয়ে আসব। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর যে ভাষণগুলো দিয়েছিলেন, তারই একটি সংকলন করেছিলেন আমিনুল হক বাদশা। এটি প্রকাশিত হয়েছিল কুষ্টিয়া ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষে। বাদশার অনুরোধে বন্ধু মুজিবকে নিয়ে অবতরণিকাটি লিখে দিয়েছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। সরাসরি শেখ মুজিবকে নিয়ে এটাই তাঁর একমাত্র লেখা। লেখাটি তিনি লিখেছিলেন ১৯৬৯ সালের ২৩ জুন। শেখ মুজিবের মধ্যে একজন সত্যিকার নেতার দেখা পেয়েছিলেন তিনি। লেখাটা এ রকম:
‘বাংলার মানস-সন্তান। অগ্নিপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ ও জাতির জন্য সংগ্রামী পথে পা বাড়িয়ে জীবনে বহু নিগ্রহ তিনি ভোগ করেছেন, কিন্তু দেশ ও জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা তিনি করেননি কখনো। অত্যাচারী, অবিবেকী আইয়ুব-মোনেম সরকার দেশের বুকে কবরের শান্তি কায়েম করে যখন স্বস্তিতে রাজত্ব করতে চেয়েছিলেন, দেশ ও জাতির দুর্দিনের কথা চিন্তা করে এই একটি কণ্ঠ সেদিন ভীম গর্জনে গর্জে উঠেছিল। ভয়-ভীতির জড়তা কাটিয়ে সারা বাংলার মানুষ সেদিন জেগে উঠেছিল, কাতার বেঁধেছিল এই অকুতোভয় মধ্যবয়সী নেতার পেছনে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার উত্তাল তরঙ্গে যখন মোনেমশাহির তখতে তাউস সয়লাব হতে চলেছে, ঠিক তখনই তাঁকে দেশরক্ষা আইনে আটক করা হলো কারাগারে। কিন্তু সে আইনও যখন তাঁকে আটকে রাখার পক্ষে অপর্যাপ্ত বিবেচিত হলো, তখনই বিশেষ আইন প্রণয়ন করে তাঁকে প্রধান আসামি করা হলো তথাকথিত এক ষড়যন্ত্র মামলার। একপর্যায়ে দেশব্যাপী প্রচণ্ড গণবিস্ফোরণের মুখে ষড়যন্ত্র মামলার ভিত ধসে পড়ল। শেখ মুজিব বেরিয়ে এলেন, সারা দেশ তাঁকে লুফে নিল বিজয়ী বীরের বেশে। সত্য বলতে কি, শিশু কচি-কাঁচাদের মুখেও ধ্বনিত হলো, “জেলের তালা ভেঙ্গেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি”।
শেখ মুজিবের নেতৃত্বের মাহাত্ম্য এখানেই। বাংলার ঘরে ঘরে শিশু, কিশোর, আবালবৃদ্ধবনিতার আজ সে নয়নমণি। দীর্ঘ কারানিগ্রহ ভোগের পর মুক্ত বিহঙ্গের মতো যখন তিনি এ দেশের লাখো কোটি মানুষের মাঝে এসে দাঁড়ালেন, তারই প্রথম কটি দিনে জাতির উদ্দেশে তিনি যা কিছু বলেছেন, ‘পাঠচক্রে’র পক্ষ থেকে তার এই সংকলন বের করায় গ্রন্থকারকে আমার অভিনন্দন। কেননা, দেশজোড়া যে সমস্যা, তার সমাধানের জন্য আজ নেতৃত্বের এ শূন্যতার রাজ্যে নির্ভীক, গতিশীল, প্রাণধর্মী যে গণমুখী নেতৃত্বের প্রয়োজন, তা কেবল শেখ মুজিবেরই সম্ভব। তাই তাঁর যা বক্তব্য, জাতির তা মূল্যবান সম্পদ।
শেখ মুজিবকে আমি চিনি। কলেজ জীবনে পাকিস্তান আন্দোলনেও আমি তাঁকে দেখেছি। নিজেদের আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ময়দানে তিনি ছিলেন মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত ও প্রিয় সৈনিক। সংগ্রামী পুরুষ শহীদ সাহেবের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বলতে ছিলেন দুজন—ইত্তেফাক সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হোসেন ও শেখ মুজিব। শহীদের চরিত্রের একটা অপূর্ব প্রতিচ্ছায়া দেখেছি তাঁদের দুজনের মধ্যে। শহীদ সাহেব ও জনাব তফাজ্জল হোসেন আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তবে তাঁদের চারিত্রিক দৃঢ়তায় এ দেশের ১২ কোটি মানুষের কল্যাণব্রতে দীক্ষা নিয়ে আজও খাড়া গর্দানে আমাদের মধ্যে বিরাজ করছেন মুক্তির বরপুত্র শেখ মুজিব। নিজেদের প্রয়োজনে দেশের বৃহত্তর স্বার্থের টুঁটি টিপে হত্যার জন্য তাঁর নেতৃত্বের যিনি যত অপব্যাখ্যাই করুন না কেন, পাকিস্তানের ১২ কোটি মানুষের মুক্তির প্রকৃত দিশারি যে তিনি, আমার মনে সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। আমার দেশের তরুণ সংগ্রামী ছাত্র-জনতার জন্য শেখ মুজিবের নেতৃত্ব আদর্শ হোক, তাঁদের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ হোক, দেশবাসীর মুখে হাসি ফুটুক—এই আমার অন্তরের কামনা।’
বঙ্গবন্ধুর এককালীন প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশার কাছ থেকে লেখাটি সম্প্রতি সংগ্রহ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র এ লেখাটিতে সিরাজ উঠিয়ে এনেছেন শেখ মুজিবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সিরাজুদ্দীন হোসেনকে পাকিস্তানি বাহিনী ও আলবদররা হত্যা করল ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর। ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ লন্ডন থেকে ঢাকার বঙ্গভবনে টেলিফোন আলাপ-আলোচনার একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির গণসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ শাহজাহানকে জিজ্ঞেস করেন, ‘সিরাজকে কি সত্যিই ওরা মেরে ফেলেছে?’
উত্তরে বলা হয়, হ্যাঁ।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আহা!’

No comments

Powered by Blogger.