সাহিত্যালোচনা- কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা by বিশ্বজিৎ ঘোষ

কালে আমাদের সংস্কৃতির একটি প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে বইমেলা। একুশে বইমেলা ও ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা। বাংলা একাডেমীর বইমেলা প্রমাণ করে যে বই নিয়ে আমাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। লেখক-পাঠক-প্রকাশক-প্রচ্ছদশিল্পী—সবার কাছেই এই বইমেলা ভিন্ন এক আনন্দের উৎস হয়ে হাজির হয়।
কিন্তু এমন কথা কি ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা সম্পর্কে বলা যাবে? নামে আন্তর্জাতিক হলেও কতটা তা আন্তর্জাতিক? অথচ আমাদের তো মনে থাকার কথা, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজক ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। ১৯৭২ সালের ২০ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে বসেছিল সে মেলা। দেশের প্রকাশকেরা ছাড়াও আটটি দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল সে মেলায়। ওই বইমেলা উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক সেমিনার। গ্রন্থকেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক সরদার জয়েনউদ্দীনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বইমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে দেখা দিয়েছিল উৎসবের আমেজ। কিন্তু বর্তমানের ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলা একাডেমীর মেলার মতো লেখক-পাঠকের সমাবেশ কোথায় ঢাকা বইমেলায়? বিক্রিও যে আশানুরূপ নয়, তা অনায়াসেই বলা যায়। মেলায় নতুন বই বিশেষ বেরোয় না। মনে হতে পারে একটা আন্তর্জাতিক বইমেলা করতে হয় বলে করা।
কেমন দেখতে চাই ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা? এ ক্ষেত্রে কলকাতা বইমেলা আমাদের আদর্শ হতে পারে, আদর্শ হতে পারে আরও অনেক আন্তর্জাতিক বইমেলা। প্রতি বইমেলায় একটা দেশকে ‘থিম-কান্ট্রি’ হিসেবে নির্বাচন করা যেতে পারে। পূর্ব থেকেই যোগাযোগ করে সে দেশের বিখ্যাত কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থাকে মেলায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। থিম কান্ট্রি ছাড়াও অন্য দেশ থেকেও প্রকাশনা সংস্থাকে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রতিবারই দেখা যায়, দুএকটা বিদেশি সংস্থা মেলায় আসে বটে, তবে তাদের স্টলে বই থাকে না; দুএকটা বই থাকলেও ‘বিক্রির জন্য নয়’-মার্কা বিজ্ঞাপন লাগিয়ে দেওয়া হয় টেবিল বা সেলফের গায়ে।
নির্দিষ্ট না থাকার কারণেও পাঠক ও ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে এই মেলা সম্পর্কে আগ্রহের কমতি দেখা যায়। কখনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মাঠে, কখনো শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গণে, কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে, কখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে এই মেলা। এর ফলে এই মেলা সম্পর্কে, মেলার স্থান সম্পর্কে জানতে জানতেই মেলার অবসান ঘটে। মেলার জন্য স্থায়ীভাবে একটা স্থান নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সব দিক বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠটাই হতে পারে ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলার আদর্শ স্থান। বিস্তৃত পরিসর, সহজ যোগাযোগ—এসব কারণে এখানে পাঠক ও ক্রেতার সমাবেশ ঘটবে বলে ধারণা করা যায়।
বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলার জন্য এখন আর কোনো প্রচারের প্রয়োজন হয় না। লেখক-পাঠক-প্রকাশকেরা সারাটা বছর অপেক্ষা করে থাকেন—কখন আসবে একুশের মাস? কিন্তু এ কথা কি ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা সম্পর্কে বলা যাবে? একটা আন্তর্জাতিক বইমেলা অথচ সারা দেশ তো দূরের কথা, খোদ ঢাকাবাসীই এই মেলা সম্পর্কে তেমন একটা জানতে পারে না। এদিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রচারমাধ্যমগুলো এ ক্ষেত্রে পালন করতে পারে অর্থবহ ভূমিকা। প্রতিবছর একই তারিখে এবং অভিন্ন স্থানে বইমেলার আয়োজন করলে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে বলে ধারণা করি। রেডিও-টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা, পোস্টার-বিজ্ঞাপন প্রভৃতি মাধ্যমে বইমেলা সম্পর্কে প্রচার চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র দূরসঞ্চারী ভূমিকা পালন করতে পারে।
বইমেলার জন্য সেমিনার একটি অপরিহার্য অংশ। সেমিনার আয়োজনে ‘থিম কান্ট্রি’র ওপর গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে বিশেষ কোনো প্রবণতা বা বিষয়ের প্রতি। নিষ্ঠাবান গবেষক এবং বিষয় বিশেষজ্ঞদের বক্তা হিসেবে সেমিনারে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। এ জন্য তাদের যথোপযুক্ত সম্মানী দেওয়া জরুরি। সেমিনারগুলো যাতে কৌতূহলী চিন্তক ও জিজ্ঞাসু শ্রোতার কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে—তার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সর্বত্র দেখা যায়, বক্তা তাঁর কথা বলে যান, শ্রোতা সামনে বসে থাকেন অপেক্ষায় কখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলার একটা স্থানে ই-প্রযুক্তির ব্যবহার কীভাবে বইয়ের প্রকাশনাকে ভিন্নতর অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখানো যেতে পারে। উন্নত শিক্ষা আর প্রশিক্ষিত জনবল সৃষ্টিতে বইয়ের ভূমিকা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বইয়ের এই বৃহত্তর সামাজিক উপযোগিতার কথা মনে রেখে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠীকে ই-বুকের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারেন বইমেলার উদ্যোক্তারা। কোনো কোনো স্টলে অনলাইনে ই-বুকের মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করতে পারলে আগ্রহী ক্রেতা ই-বুক সংগ্রহ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত না থেকেও একটা প্রকাশনা সংস্থা মেলায় হাজির থাকতে পারে এবং এভাবে মেলার আন্তর্জাতিক চারিত্র্যে সঞ্চার করতে পারে নবতর মাত্রা।
বাংলাদেশের প্রকাশকেরা, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, একুশের বইমেলাকে সামনে রেখেই বই প্রকাশ করে থাকেন। ঢাকা বইমেলা তাঁদের চিন্তায় খুব একটা কাজ করে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ঢাকা বইমেলা উপলক্ষে যেসব প্রতিষ্ঠান কমপক্ষে দশটা মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করবে, তাদের জন্য কিছু সুবিধার কথা ঘোষণা করা যায়। মেলায় প্রকাশকদের অংশগ্রহণে বাধ্য করার পরিবর্তে, তারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করুক—এই হোক উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা।
বইমেলার প্রধান উদ্দেশ্য পাঠক সৃষ্টি। সবার মিলিত উদ্যোগে পাঠক সৃষ্টির লক্ষ্যে মানসম্পন্ন বইয়ের প্রকাশকে নানাভাবে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। নকল বই বা নিচুমানের বইকে নিরুৎসাহিত করা দরকার। এ বিষয়ে মেলার আগে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং প্রকাশক সমিতি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসতে পারেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে বিষয়বৈচিত্র্যের দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা কর্তৃপক্ষ বিষয়ভিত্তিক শ্রেষ্ঠ বইয়ের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দেবে বলে মনে করি। গণগ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বই ক্রয়ের সময় শ্রেষ্ঠ বইগুলোকে প্রাধান্য দিলে প্রকাশকদের মধ্যে ভালো বই প্রকাশের জন্য একটা ইতিবাচক প্রতিযোগিতা দেখা দেবে। বাংলা একাডেমীর একুশের বইমেলার মতো শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পী এবং সুন্দর স্টলের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকলে মেলার চারিত্র্য পাল্টে যেতে পারে বলে মনে করি।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলাকে আকর্ষণীয় করতে উদ্যোগ দরকার, সদিচ্ছা দরকার, প্রয়োজন সরকারি আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা, প্রয়োজন প্রাগ্রসর চিন্তা ও দূরদৃষ্টি। আশা করা যায়, এসব দিকে আমরা ক্রমশ আন্তরিক হয়ে উঠব—ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠবে একটা আন্তর্জাতিক বইমেলা।
========================
দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!  ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উইকিলিকস সমর্থকদের  কানকুনঃ মুমূর্ষু পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষ  নারীর হার-নারীর জিত, বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক  সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত  বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব  মুক্তির গান  এক-এগারোর জুজুটাকে হিমাগারে পাঠান  জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জাগরণ সৃষ্টি করুন  সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্পসল্প  রাষ্ট্রীয় সমাজে চিন্তা করার স্বাধীনতার প্রয়োজন  বাঙালের জলবায়ু দর্শন: ইঁদুরই কি শ্রেষ্ঠ জীব  প্রকৃতি- পাহাড়টির সঙ্গে ধ্বংস হবে ঐতিহ্যও  স্মরণ- আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়া  আলোচনা- উইকিলিকসঃ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ত্রিমুখী সংগ্রাম


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ বিশ্বজিৎ ঘোষ


এই সাহিত্যালোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.