এই কি আমাদের মানবাধিকার? by অ্যাডভোকেট এলিনা খান

নেয়ামুল। বয়স সাত। সাত বছরের এই ছেলেটির পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা! শুধু তা-ই নয়, শরীরের বিভিন্ন অংশ ব্লেড দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে! কেন এই নির্মমতা? তার অপরাধ কী? তার বাবার সঙ্গে সন্ত্রাসীদের কথা কাটাকাটির জের হিসেবে এ ঘটনার শিকার হয় নেয়ামুল। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। কী লাভ হয়েছে মামলা করে? কারণ এ মামলা দায়েরের পর আসামিদের কেউই গ্রেপ্তার হয়নি;
বরং তারা প্রকাশ্যে পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে! আর যিনি বাদী হয়েছেন এ মামলার, সেই হতভাগ্য রিকশাচালক বাবা এখন মামলা করার সাহস দেখানোর খেসারত দিতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে নিজেই গা-ঢাকা দিয়েছেন। প্রসঙ্গের শুরুতে উদাহরণটা আনলাম এ কারণে যে এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
গতকাল ছিল বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সাল থেকে আজ ২০১০-এর শেষপ্রান্তে এসে তাই সংগত কারণেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে, আমি বা আমার সন্তানও কি নিরাপদ? শুধু খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের বৈষম্য কি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মূল অন্তরায়? নাকি মূল অন্তরায় তার নিরাপদ জীবনযাপন? বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে মানবাধিকার দিবস। এই সময়ে উত্ত্যক্তকারী সন্ত্রাসের কারণে অনেক মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। এর প্রতিবাদ করায় প্রাণ দিতে হয়েছে শিক্ষক, অভিভাবকসহ অনেককে। এই শিক্ষক আর অভিভাবকদের কি বেঁচে থাকার কোনো অধিকার ছিল না? তাই আমি মনে করি, সন্ত্রাসও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বড় হাতিয়ার। এ কারণেই আমাদের এবারের স্লোগান_'সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, রুখে দাঁড়াব একসাথে।'
মানবাধিকার হলো, মানুষের অধিকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও মানুষের নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা যায়নি। একটু ভেবে দেখুন তো_আপনি, আমি বা আমাদের সন্তানরা আসলেই কি মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সব অধিকার পাচ্ছি? অথবা আদৌ কি আমরা জানি, রাষ্ট্র কোন অধিকারগুলো আমাকে দিতে বাধ্য? অনেকেই জানি না। আর জানি না বলেই আমরা আমাদের অধিকারের দাবিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেও পারি না। ফলে আমি মনে করি, অতি শিগগিরই এ অবস্থা থেকে আমরা মুক্ত হতে না পারলে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। আর তাই, আমাদের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসতে যেমন রাষ্ট্রকে, তেমনি সচেতন হতে হবে আমাদের সবাইকেই। কারো দয়া নিয়ে নয়, প্রাপ্য অধিকার নিয়ে বাঁচতে হলে জানতে হবে আমাদের সংবিধান ও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার-সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র।
জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সব মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাঁদের বিবেক এবং বুদ্ধি আছে; সুতরাং সবারই উচিত একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করা।
এ ঘোষণায় উলি্লখিত স্বাধীনতা এবং অধিকারগুলোয় গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, রাজনৈতিক বা অদ্যাবধি মতামত, জাতীয় বা সামাজিক উৎপত্তি, জন্ম, সম্পত্তি বা অন্য কোনো মর্যাদায় নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই সমান অধিকার থাকবে। জীবন, স্বাধীনতা এবং দৈহিক নিরাপত্তায় প্রত্যেকের অধিকার আছে। কাউকে অধীনতা বা দাসত্বে আবদ্ধ করা যাবে না। সব ধরনের ক্রীতদাসপ্রথা এবং দাসব্যবস্থা নিষিদ্ধ করা হবে। কাউকে নির্যাতন করা যাবে না; কিংবা কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না অথবা এহেন শাস্তি দেওয়া যাবে না। আইনের সামনে প্রত্যেকেরই ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের অধিকার আছে। আইনের চোখে সবাই সমান এবং ব্যক্তি নির্বিশেষে সবাই আইনের আশ্রয় সমানভাবে ভোগ করবে। এ ঘোষণা লঙ্ঘন করে_এমন কোনো বৈষম্য বা বৈষম্য সৃষ্টির প্ররোচনার মুখে সমানভাবে আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। কাউকে খেয়াল-খুশিমতো গ্রেপ্তার বা অন্তরীণ করা কিংবা নির্বাসন দেওয়া যাবে না। নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভিন দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করার এবং সে দেশের আশ্রয়ে থাকার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। অরাজনৈতিক অপরাধ এবং জাতিসংঘের উদ্দেশ্য এবং মূলনীতির পরিপন্থী কাজ থেকে সত্যিকারভাবে উদ্ভূত অভিযোগের ক্ষেত্রে এ অধিকার প্রার্থনা না-ও করা যেতে পারে।
ঘোষণাপত্রে আরো বলা হয়েছে, প্রত্যেকেরই একটি জাতীয়তার অধিকার আছে। কাউকে যথেচ্ছভাবে তাঁর জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, কিংবা কারো জাতীয়তার পরিবর্তনের অধিকার অগ্রাহ্য করা যাবে না। ধর্ম, গোত্র ও জাতি নির্বিশেষে পূর্ণবয়স্ক সব নর-নারীর বিয়ে করা এবং পরিবার প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে। বিয়ে, দাম্পত্যজীবন এবং বিবাহবিচ্ছেদে তাঁদের সমান অধিকার থাকবে। বিয়েতে ইচ্ছুক নর-নারীর স্বাধীন এবং পূর্ণ সম্মতিতেই কেবল বিয়ে সম্পন্ন হবে। পরিবার হচ্ছে সমাজের স্বাভাবিক এবং মৌলিক গোষ্ঠী_একক। সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভের অধিকার পরিবারের রয়েছে।
প্রত্যেকেরই ধর্ম, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। এ অধিকারের সঙ্গে ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তনের অধিকার এবং একই সঙ্গে প্রকাশ্যে বা একান্তে, একা বা অন্যের সঙ্গে মিলিতভাবে শিক্ষাদান, অনুশীলন, উপাসনা বা আচারব্রত পালনের মাধ্যমে ধর্ম বা বিশ্বাস ব্যক্ত করার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। অবাধে মতামত পোষণ এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে যেকোনো মাধ্যমের মারফত ভাব এবং তথ্য জ্ঞাপন, গ্রহণ ও সন্ধানের স্বাধীনতাও অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সমাজকল্যাণমূলক কার্যাদির সুযোগ এবং একই সঙ্গে পীড়া, অক্ষমতা, বৈধব্য, বার্ধক্য অথবা জীবনযাপনে অনিবার্য কারণে সংঘটিত অন্যান্য অপারগতার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং বেকার হলে নিরাপত্তার অধিকারসহ নিজের এবং নিজ পরিবারের স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত জীবনমানের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। মাতৃত্ব এবং শৈশব অবস্থায় প্রতিটি নারী ও শিশুর বিশেষ যত্ন এবং সাহায্য লাভের অধিকার আছে। বিবাহবন্ধন-বহির্ভূত কিংবা বিবাহবন্ধনজাত সব শিশু অভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানেও মানুষের অধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। বিশেষ করে নারীদের ব্যাপারে জাতীয় জীবনে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও আছে সংবিধানে। সংবিধানে বলা হয়েছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।' সংবিধানে প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে তার চলাফেরার স্বাধীনতা। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা।
আজ পথেঘাটে নারীদের উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে। আইনের তোয়াক্কা করছে না কেউই। ফলে দেদার ঘটছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা। অথচ সংবিধানে বলা হয়েছে, 'যে ব্যক্তি, কোন নারীর শালীনতার অমর্যাদার লক্ষ্যে বা এই লক্ষ্যে কোন কথা বলে, কোন শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে বা কোন বস্তু প্রদর্শন করে, যে উক্ত নারী অনুরূপ কথা বা শব্দ শুনিতে পায় অথবা অনুরূপ অঙ্গভঙ্গি বা বস্তু দেখিতে পায় কিংবা উক্ত নারীর গোপনীয়তা অনধিকার লঙ্ঘন করে, সেই ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদণ্ডে_যাহার মেয়াদ এক বছর পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় সাজায় দণ্ডিত হইবে।'
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত) ২০০৩-এ বলা হয়েছে, 'কোন নারীর সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত কোন কার্য দ্বারা সম্ভ্রমহানি হইবার প্রত্যক্ষ কারণে কোন নারী আত্মহত্যা করিলে উক্ত ব্যক্তি উক্ত নারীকে অনুরূপ কার্য দ্বারা আত্মহত্যা করিতে প্ররোচিত করিবার অপরাধে অপরাধী হইবেন এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ১০ বছর কিন্তু অনূ্যন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হইবেন।'
আইনে আরো বলা হয়েছে, 'যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে তাহার যৌন কামনা চরিতার্থ করিবার উদ্দেশ্যে তাহার শরীরের যে কোন অঙ্গ বা কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোন অঙ্গ স্পর্শ করে বা কোন নারীর শ্লীলতাহানি করেন, তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বছর কিন্তু অনূ্যন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।'
এতক্ষণ যা বললাম তা হচ্ছে আইন আর সংবিধানের কথা। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সর্বজনীন ঘোষণাপত্র এবং দেশে প্রচলিত আইনে মানুষের নিরাপত্তা, সুশাসনের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকার কারণে আমরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে জীবনযাপন করছি। এখন একবার ভেবে দেখুন, আসলেই কি এটাকে জীবনযাপন বলে? এই কি আমাদের মানবাধিকার ?
==============================
ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!  ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উইকিলিকস সমর্থকদের  কানকুনঃ মুমূর্ষু পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষ  নারীর হার-নারীর জিত, বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক  সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত  বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব  মুক্তির গান  এক-এগারোর জুজুটাকে হিমাগারে পাঠান  জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জাগরণ সৃষ্টি করুন  সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্পসল্প  রাষ্ট্রীয় সমাজে চিন্তা করার স্বাধীনতার প্রয়োজন  বাঙালের জলবায়ু দর্শন: ইঁদুরই কি শ্রেষ্ঠ জীব  প্রকৃতি- পাহাড়টির সঙ্গে ধ্বংস হবে ঐতিহ্যও


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ অ্যাডভোকেট এলিনা খান
মানবাধিকার নেত্রী ও চেয়ারপারসন
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বিএইচআরএফ

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.