বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০ by আইন ও সালিশ কেন্দ্র

২০১০ সালে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল মিশ্র। একদিকে যেমন কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে, তেমনি নেতিবাচক উদাহরণও রয়েছে অনেক। ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পুনর্গঠন করা হয়েছে, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণীত হয়েছে, জাতীয় শিক্ষানীতি অনুমোদিত হয়েছে, সংশোধিত শিশুনীতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইন অনুমোদিত হয়েছে। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদের (সিডও) আওতায় প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া উচ্চ আদালত কর্তৃক ফতোয়াকে আইনবহির্ভূত ঘোষণা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বোরখা পরা বাধ্যতামূলক করা যাবে না, ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবে—এ ধরনের কিছু ভালো সিদ্ধান্ত এসেছে। কিন্তু উপরিউক্ত উদ্যোগের ফলাফল পাওয়ার ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ—বারবার এ ঘোষণা দেওয়া হলেও এটি অব্যাহতভাবে চলছে। ‘ক্রসফায়ার’ নেই, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘আত্মরক্ষার্থে গুলি’ চালানোর ফলে মৃত্যু ঘটছে—এ ধরনের যুক্তি দেখিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত ১১৭ জন এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। তা ছাড়া নতুন প্রবণতা হিসেবে নিখোঁজ বা ‘গুপ্তহত্যার’ ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অনেক ক্ষেত্রে নিখোঁজ অথবা গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের পর পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে তাদের র্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগেই তুলে নিয়ে গেছে, যা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
প্রায় পুরো বছরই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল নাজুক। নিজ বাসভবনে এক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতা এবং এতে বেশ কয়েকজন মেধাবী ছাত্রের মৃত্যু, ছিনতাইকারীদের হাতে গণমাধ্যমের কর্মীসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ড, মানুষের নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা এবং তাতে গণপিটুনির শিকার হয়ে অনেক মৃত্যুর ঘটনা নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উদাহরণ। চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত ৯০ জন গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছে।
চলতি বছর বখাটেদের দ্বারা নারীদের উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃৃদ্ধি পায়। অবশ্য সরকার ও প্রশাসনের তরফ থেকে নানামুখী প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ দেখা যায়। ফলে অনেক প্রতিবাদও দেখা যায়। কিন্তু বখাটেদের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। এমনকি প্রতিবাদকারীরাও বখাটেদের রোষানলে পড়েছে। এর মধ্যে নাটোরের কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমান এবং ফরিদপুরে মা চাঁপা রানী ভৌমিকের মৃত্যু ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়ে ২৮ জন নারী, মেয়ের অপমান সহ্য করতে না পেরে এক বাবা এবং ছেলের অবাধ্যতায় অতিষ্ঠ হয়ে একজন মা আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ১৮ জন।
চলতি বছর বিরোধী দল দুই দিন হরতাল পালন করে। হরতালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনা বা হরতালের আগে গণগ্রেপ্তারের ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি মানুষের মনে ভীতি সঞ্চারের জন্য বিরোধী দল কর্তৃক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে।
বিচার বিভাগের কাজকে মসৃণভাবে চালানোর জন্য সরকার নিম্ন আদালতের জন্য বেশ কিছু বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। তবে হাইকোর্টে দুজন বিচারকের নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে নীতিমালা স্বচ্ছভাবে অনুসরণ না করায় দলীয় নিয়োগের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। সরকার সম্প্রতি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘আপরাধ আমলে নেওয়ার’ ক্ষমতা দেওয়া হবে। এটা বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা এবং এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তা ছাড়া বিচারব্যবস্থার প্রচলিত নিয়মনীতিকে রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বেশ কিছু দুর্নীতির মামলা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, রাজনৈতিক বিবেচনায় যতগুলো মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে, সবই ছিল সরকারদলীয় কর্মীদের। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নাটোরের গামা হত্যাকাণ্ডের আসামিদের বা শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের শাস্তি মওকুফের ঘটনা এ ক্ষেত্রে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে।
বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় সাংবাদিকেরা সরকারদলীয় প্রভাবশালী স্থানীয় নেতাদের হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মাসুম নামের জনৈক সাংবাদিক (নিউ এজ) র্যাবের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। চলতি বছর ১৫৮ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। তা ছাড়া চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করা ও আমার দেশ পত্রিকা বন্ধের চেষ্টা, সাময়িকভাবে ফেসবুক বন্ধ রাখা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও মূল যে সমস্যা—ভূমিবিরোধ, তা নিষ্পত্তিতে তেমন অগ্রগতি নেই। ভূমি জরিপ আগে হবে নাকি পুনর্বাসন আগে হবে, তা নিয়ে ব্যাপক মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। তবে এ বিষয়ে পুনরায় চিন্তাভাবনা চলছে। ওই অঞ্চলে সহিংসতাও বন্ধ হয়নি। সহিংসতা প্রতিরোধে সেনাবাহিনী এবং সরকারের ভূমিকা ও আন্তরিকতা নিয়েও নানা সময় প্রশ্ন উঠেছে। ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ১৩ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে সন্তু লারমা হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করবে, এ বিশ্বাস আমার নেই। মানুষের জীবন ও জীবিকার সংগ্রামেও অনেক চড়াই-উতরাই ঘটেছে।’
পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ এবং কবে থেকে শ্রমিকেরা তা পাবেন, তা নিয়ে বেশ কিছুদিন পোশাকশিল্পে অস্থিরতা চলে, একপর্যায়ে মালিকপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য পোশাকশিল্প বন্ধের ঘোষণা দিলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। রূপগঞ্জে সেনা আবাসন প্রকল্পের জমি কেনা নিয়ে সৃষ্ট ঘটনায় গ্রামবাসীর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে একজন নিহত ও কয়েকজন নিখোঁজ হয়। ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রতিবাদে মানুষ পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়েছে। তা ছাড়া দ্রব্যমূল্য ও বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি সারা বছরই নাজুক ছিল।
এপ্রিল ২০০৯ থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্যপদ শূন্য ছিল। দীর্ঘদিন পর ২২ জুন ২০১০ সরকার চেয়ারম্যান ও অন্য ছয়জন কমিশনার নিয়োগদানের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে। তবে কমিশনের জন্য বিধিমালা ও সাংগঠনিক কাঠামো এখনো অনুমোদন করা হয়নি।
অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের গুরুত্বপর্ণ সব ক্ষমতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২৬ এপ্রিল ২০১০ মন্ত্রিপরিষদে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। এই সংশোধনী গৃহীত হলে সরকার কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর করার যে অঙ্গীকার করেছে, তা পূরণ হবে না এবং কমিশনের কর্মপরিধি যেমন সংকুচিত হবে, তেমনি এর ওপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ জোরদার হবে। এই সংশোধনীর অন্যতম হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তাদের (মন্ত্রীসহ) বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে কমিশনকে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। আরও প্রস্তাব করা হয়েছে, কমিশনের সচিব হবেন প্রধান হিসাব কর্মকর্তা এবং তিনি সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, যা কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রিত করবে। তা ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ করা এবং মিথ্যা অভিযোগে শাস্তির বিধান রাখাও দুর্নীতি দমন কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আশার ব্যাপার হচ্ছে, সংশোধনীটি এখনো সংসদে উত্থাপিত হয়নি। আইন কমিশন বিদ্যমান বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আইন চিহ্নিত করে সংশোধনের কর্মপরিকল্পনা করলেও দীর্ঘদিন ধরে তা অনুমোদনের অপেক্ষায় মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। তা ছাড়া আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের হঠাৎ পদত্যাগ এই প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার বিষয়ে সংশয় সৃষ্টি করেছে।
যেহেতু বর্তমানে যে দল সরকার পরিচালনা করছে, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে মানবাধিকারের সুরক্ষা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার হিসেবে ব্যক্ত হয়েছিল, তাই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে আসক সরকারের আরও কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশা করে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক): একটি মানবাধিকার সংগঠন।

No comments

Powered by Blogger.