সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠা

কজন কবি কখন একটি কবিতাকে কবিতা মনে করেন, কবিরা নিজেদের লেখালেখিকে মানদণ্ড হিসেবে নিয়ে একান্ত কথা বলেছেন এ বিশেষ আয়োজন
ব্যাখ্যাতীত শব্দগুচ্ছের নামই হয়তো কবিতা
ম হা দে ব সা হা
জানি না। 'তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি'। জানি না ঠিকই, না জেনেও কী ভাবে কী করে যেন এইসব পদ্য-পঙক্তি লিখে ফেলি; তাকেই বলি কবিতা, নাম দিয়েছি কবিতা।
কখন কী ভাবে কার মধ্যে জেগে ওঠে সেই কবিতার মুহূর্ত তার কাছেও হয়তো অজানা, কী ভাবে এই শব্দ শব্দেরও বেশি অর্থময় হয়ে ওঠে, ধারণ করে রহস্য, রহস্যাতীত বহু সুখ-দুঃখ, কী ভাবে এই অন্তমিলসমূহ বিদু্যৎ ঝলকের মতো ঝলসে ওঠে, নক্ষত্রখচিত হয় তার মধ্যে, ফুলের গন্ধ, নদীর কলধ্বনি জেগে ওঠে। এই ব্যাখ্যাতীত বর্ণনাতীত শব্দগুচ্ছের নামই হয়তো কবিতা, এই আলো অন্ধকারের নামই হয়তো কবিতা, এই ছন্দ, ছন্দহীনতার নামই হয়তো কবিতা; জানি না, আর কিছুই জানি না।
আমি কবিতা লিখতে লিখতে কখনো হয়তো এই কবিতা হয়ে ওঠে, কখনো হয়ে ওঠে না, কখনো হয়তো এক ঝলক আলো দেখতে পাই, কখনো পাই না, এই আমার কবিতা, এই আমার ভালোবাসার পঙক্তি, স্বপ্নে পাওয়া, আকাশ থেকে পাওয়া এক টুকরো মিথ্যা আলো, তাকেই আমি কবিতা বলি, নৈঃশব্দ বলি, অন্তর্বেদনা বলি, এইসব আরো আরো এইসব মিলিয়ে কবিতা বা কবিতা_না। আর কীইবা বলা যায়?
হয়তো এভাবেই কিংবা আরো অন্য অন্য ভাবে জন্ম হয় কবিতার। সে হয়তো বর্ষার অগি্নগর্ভ মেঘের মতো যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে বিদু্যৎ, তাকে আবিষ্কার করার জন্য বহু দিন বহু রাত্রি জেগে থাকতে হয়, চোখের জল ফেলতে হয়, জীবন ছারখার করতে হয়, নিজেকে উৎসর্গ করতে হয় এই অনিশ্চিত অদৃশ্য অধরা কবিতার কাছে। এভাবেই হয়তো কবিতা হয়ে ওঠে, হয়তো ওঠে না।
এ যেন নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ
আ ল ফ্রে ড খো ক ন
কবিতা যে কুমারের হাতে মাখানো নরম মাটি, ধীরে ধীরে গড়ে তুলে আগুনে পুড়িয়ে তাকে লাল করতে হয়। মাঝেমধ্যে দিতে হয় প্রয়োজনীয় রঙের লেপন। কেউ তাকে কিনে নেয় পুজোর সমীপে। কেউ তাকে কিনে নেয় পিপাসার কলসি ভেবে, কেউ তাকে কিনে নেয় সোকেসের মাটির পতুল মনে করে, কেউ তাকে চেয়ে নেয় ভালবাসার মনন আদরে।
একটি কবিতা কিভাবে জন্ম নেয়, কিভাবে হয়ে উঠে, তা বলতে গেলে আমাকে বলতে হবে, প্রতিটি কবিতার জন্মই ভিন্ন আলোড়নের ভেতর। আমার কাব্যযাত্রায় লক্ষ করেছি, কখনো একটি কবিতা বসে থাকতে থাকতেই জন্ম নেয়। কোন কবিতার গজজন্ম অর্থাৎ দাঁড়িয়ে থেকেই হয়ে যায়। একটি কবিতা দীর্ঘ রাত জেগে জন্ম লাভ করে। কখনো কবিতা রাতজাগা চোখ দুহাতে কচলাতে কচলাতে প্রতু্যষ অবধি প্রতীক্ষা করে।
কবিতা অবশ্যই কবির মস্তকের কলা অনুষদ (আর্ট চেম্বার অব ব্রেইন) থেকেই জন্মলাভ করে, যার সূচনা যেকোন সাধারণ বা অসাধারণ চেতনা কিংবা অনুভূতি বা আবেগ তাড়িত দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান বিষয় থেকেই হতে পারে। সূচনার ক্ষণটি আসলে বোবার মত, যা ভাষা খোঁজে, অন্যের সঙ্গে কথা বলতে চায়, ভাষার অভাবে মনের ভার সে অন্যের কাছে ব্যক্ত হয়ে নির্ভার হতে চায়। একে আমরা ভ্রূণ বলতে পারি। কবিতার সেই ভ্রূণ কবির মস্তকের কলা অনুষদ থেকে ক্রমশ জন্ম নিয়ে একটি আকৃতি বা অবয়ব লাভ করতে থাকে। কিন্তু অনেক কবিতা বা কবিতার ভ্রূণ কবির আর্ট চেম্বারেই ঝরে যায়। আবার জন্মের পরও অনেক কবিতার মৃতু্য হয়। হলো না বলে কবি তাকে ফেলে দেন। ফলে লেখার পর কোন কবিতা হয় না বলে কবির হাতে মৃতু্যবরণ করে আবার কোন কবিতা হয় বলে বেঁচে থাকে। কখনো কখনো এমন ঘটে কবি যাকে ব্যর্থজন্ম মনে করেন, পরবর্তীতে তা সফল জন্মে আকর্ষিত হয়।
এমনও দেখেছি একবার একটি বোধ কবিতার মতো আমাকে লেখাল, কিন্তু মধ্যপথে অন্য কোন ঘটনায় মনোযোগ ভেঙ্গে যাওয়ায় সে আর পুনর্জন্ম পেল না, বিকলাঙ্গ হলো। তাকে শত চেষ্টায়ও পূর্ণাঙ্গতা দিতে পারলাম না। জন্মই হলো না, অথচ সে মৃতু্যবরণ করল! এই বিস্ময়ের হাত ধরে আবার নতুন চেতনা আসে, আবেগ আসে, অনুভূতি খোঁচা দেয় মস্তকের কলা অনুষদে, সেখানে যতক্ষণ পূর্ণ মনোযোগ থাকে তার ভিতর দিয়েই শব্দ-ছন্দ-চিত্রকল্প নিয়ে একটি কবিতা জন্ম নেয়। এ যেন নারী-পুরুষের সঙ্গমকালীন নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ, যেখানে উঠানের একটি পাতার পতনও টের পাওয়া চলে না।
একটি কবিতা কখন কিভাবে জন্মাবে নিশ্চিত বলা যায় না। কোন কবিই কবিতা লেখার জন্য কাগজ-কলম আর ক্ষণ-লগ্ন ধার্য করে কবিতা লিখতে বসেন না। সেভাবে বসলে কবিতার জন্ম হয় কিনা, তা আমার অভিজ্ঞতায় আসেনি এখনো।
চিরায়তের মুক্তি চিরকবির হাতেই
তু ষা র দা শ
একজন কবিই তাঁর কবিতার সবচেয়ে বড় সমালোচক। অন্য যে কারো চেয়েই তিনি নিজের লেখা কবিতা ও অকবিতাকে ভালো চিনতে পারেন। তারপরও বহু কবি নিজের অনেক অকবিতাকে কেন কবিতার পাশাপাশি অবমুক্ত করেন? কারণ, তখন তাঁর সমস্যা আসন্নপ্রসবা মায়ের মতোই_গর্ভজাত সন্তানকে অবমুক্ত করেই তাঁর আনন্দ ও সার্বিক মুক্তি। তো, সেই সন্তানের সার্বিক সাফল্য তো সময়ের হাতে, ভবিষ্যতের হাতে। কবিরাও মায়ের মতোই প্রায়শ উদ্ভ্রান্ত, কন্ফিউজ্ড, মতিচ্ছন্ন, গাঢ় সংবেদনায় রক্তিম আর আশাবাদী। তাই, সব সন্তানের মতো প্রায় সব কবিতাই তিনি সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে চান। আবার, বাধ্য হয়ে সন্তান জলে ভাসিয়ে দেবার মতো নির্মমতাও কোনো কোনো কবির ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই। এসবই প্রায় সবাই জানেন। অনেক লিখেও সামান্য পরিমাণ রচনাকে কেউ কেউ অবমুক্ত করেন, আবার অনেকে যা-ই লেখেন, তা-ই ছাপেন।
কবিতার হয়ে ওঠার ব্যাপারটা কবির মাথায় থাকলে, তাঁর পক্ষে বিস্তর রচনা অবমুক্ত করা প্রায় অসম্ভব। আমরা অনেক সময় মক্শো করার জিনিসও অবমুক্ত করে দেই নানা সীমাবদ্ধতার কাছে নতি স্বীকার করে।
প্রখ্যাত সংগীত-শিল্পী ভীমসেন যোশীর 'সাবেরিয়া' যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা বুঝতে সহজেই পারবেন যে, প্রকৃত কবিতা হয়ে ওঠা কী জিনিস!! তিনি বলেছেন_'সাবেরিয়া' যে 'সাবেরিয়া' হয়ে উঠল, সার্থক একটা 'পীস্' হয়ে উঠলো_তার কারণ সেদিন তাঁর মুড ভালো ছিলো, যেভাবে যা তিনি ঐ গানের ক্ষেত্রে করতে চাচ্ছিলেন, সেগুলো ঠিক সেই অনুযায়ীই হয়ে উঠেছিলো- আর তাতেই 'সাবেরিয়া'র মতো গানও পেলো শিল্পীর শিখরস্পশর্ী সাফল্যের অনুমোদন। কবিতার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি এরকমই_কবি যেভাবে তাঁর ভাব বা বিষয়কে রূপ দিতে চান, উপকরণগুলো যেভাবে তিনি ব্যবহার করতে চান, যেভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে চান, ঠিক ঠিক সেভাবেই হয়ে উঠলেই, কবির কাছে কবিতাটির অনুমোদনের ব্যাপারটি তখন অনেক সহজ হয়ে ওঠে। এসব একজন কবির জীবনে মাঝে মাঝে ঘটে- 'এ্যাপিকানির' সবটুকুও সবসময় গ্রাহ্য হয় না প্রকৃত কবির কাছে_স্বপ্নে পাওয়া কবিতাও অনেক সময় হারিয়ে যায় সময়-স্রোতযাত্রায়_কবির দেয়া মুক্তি সবসময় সেই কবিতার প্রকৃত মুক্তি নাও হতে পারে তাই।
কবিতা যে প্রকৃত প্রস্তাবে কী_তার ব্যাপারে কবি ও বোদ্ধাদের এত মত জগদ্ব্যাপী_আমরা যারা দলিত-হরিজন এক্ষেত্রে, তার হয়ে ওঠার ব্যাপারে আমরা তেমন আর কী বলতে পারি?? তবে তাজমহল, সুন্দরবন, হিমালয়ের ঐ শিখরশ্রেণী যে সুন্দরের নানা 'বাহানা' ছড়িয়ে আমাদের বিস্মিত, মুগ্ধ ও নয়নশোভার আরাম দেয়_সে ব্যাপারে আমাদের মতো সাহিত্য-টোকাইরাও আর বিতর্ক-সভা করার প্রয়োজনবোধ করি না।
চিরায়তের মুক্তি তাই চিরকালের কবিরাই দিয়েছেন যুগে যুগে।

অলৌকিক বেহালায় ছড় টানে সময় ও অনুভূতি
মা রু ফ রা য় হা ন
আফ্রোদিতি যখন কবিকে চুম্বন করে, অথবা ইবলিশ বালিশ পেতে দেয় তার আগুনশয্যায়, কিংবা উচ্ছ্রিত সুন্দরের কফিনে পেরেক ঠুকতে থাকে কদাকার লুসিফার_ কবিতা হয়ে উঠতে থাকে সেসময়। যেমন তিস্তায় তরঙ্গ জাগে, জোনাকি জ্বলতে থাকে কালের কৃষ্ণগহ্বরে, সদ্য ফোটা সূর্যমুখীর মুখ ঘুরে যায় অমাবস্যার দিকে; যেমন সর্বনাশের পালে লাগে মন্দমধুর হাওয়া, পূর্ণিমা জ্বালিয়ে দেয় অন্ধগায়কের ঝিমিয়ে পড়া গান, কোথাও বর্ষার জলে ধুয়ে যায় খুন হয়ে যাওয়া দোয়েলের রক্ত_যেমন সহজ নিয়মে ফোটে ফুল গোলাপবাগানে, বৃক্ষের পাঁজর পুড়ে পুড়ে ফোটাতে থাকে ভাত অনাহারী শিশুর জন্যে_এমন সহজ নিয়মে এমন সপ্রাণ স্বাচ্ছন্দ্যে কবিতা হয়ে উঠতে থাকে কবির মনে ও মননে।
তবু কবিতার হয়ে ওঠা জটিল রহস্যময়, অপার অবাক-করা, স্পন্দিত দ্বন্দ্বময়, হর্ষসিক্ত বিষাদগ্রস্ত। তাই কবিতা জন্মাতে থাকে আইসিইউ-র সুনসান বেডে, মড়ার প্রতীক্ষায় থাকা মর্গে, নবজাতকের কান্নায়, নিসর্গের ইশারায়।
কবি এক অলৌকিক বেহালা, সময় ও অনুভূতি ছড় টেনে টেনে বাজায় কবিতা!
শব্দেরা তারার মতো ফুটতে থাকে, আবেগ বাঘের মতো তড়পাতে থাকে, বেদনা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে থাকে, ধরিত্রী স্বৈরিণীর মতো উস্কে দিতে থাকেঃকবি তো দেবদূত, মেঘেমেঘে তার পর্যটন; কবি যে রক্তমাংসের অভাজন, তারও লাগে রুটি ও মদ, কীভাবে সে এড়াবে প্ররোচনা অথবা প্রলোভন? কবিতার হয়ে ওঠার জন্য জরুরি হলো আধার ও আধেয়, আকাশ ও মাটি, জল ও হাওয়া, কবি ও ব্রহ্মাণ্ড। পিলখানার দীর্ঘশ্বাস থেকে তাই কবিতা হয়ে ওঠে।
সদ্য প্রেমে পড়া নবীনের অপ্রকাশিত ইচ্ছে থেকে তাই কবিতা হয়ে ওঠে। আত্মহননের চেয়ে ভালো শব্দখনন_তাই কবিতা হয়ে উঠতে থাকে প্রাজ্ঞের প্রতিভাতীর্থে, মৃতু্যকে ছাপিয়ে ওঠা জীবনের সহোদর।
অথৈ সীমান্তে নাভিশ্বাস হুইসেল
ফে র দৌ স না হা র
সেই কবে ঘুম ভেঙে ঘুমহীন প্রান্তরের দীর্ঘশ্বাস কাঁধে হেঁটে চলছি। যত দূরেই যাই না কেন পিছুটান ও কিছু মায়াবী মাপজোখ পেছনে লেগেই থাকে। শীতার্ত বস্ন্যাকবোর্ডে রেখা টেনে বুঝাতে চায়_এটাই কবিতা।
কবি যা জানে তার চেয়েও অজানাই বেশি থেকে যায়। বেহিসেবি ভাঙাগড়া বারবার বলে ওঠে_চলো অজানা কুড়াই, কষ্ট বাড়াই প্রতিবার নতুন করে। নামহীন গোত্রহীন এক দুরন্ত চণ্ডাল কবি অবয়বে কাঁপন ধরিয়ে যায় স্মৃতি-বিস্মৃতির আয়ুতটে।
যেভাবে হয়ে উঠলে মনে হয়_হলো, সেভাবে কি কখনো কবিতা এসে দাঁড়িয়েছে! কত না নীরব রাতের গল্প ঝরে পড়ছে পথের দু'ধারে। ভাঙাগড়ার মাঝখানে বয়ে যাচ্ছে ঝড়োমেঘ আর ছিন্নপাতার অভিমানঃ!
শিল্পের হুইসেল শুনতে শুনতে ঝিম নামে শুঁড়িখানা-বুকে। পুবের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে উত্তরের কোরাস। বেদনাভিক্ষুর কণ্ঠে বাজে উদাস-বিবাগী গান। গায়ে মেখে টকটকে শিখা, আগুনের নামাবলি পোড়ায় দেহঘর। পৌরাণিক বৃষ্টির হিমদানা কবিতা খুঁজতে খুঁজতে উড়ে যায় অথৈ সীমান্তে।
এই তো আমার কবিতার বিষুবরেখা পাড়ি দেয়া। জীবনের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ায় বারবার। নিজের সঙ্গে দরকষাকষি, অস্থির আলিঙ্গন এসে চুমু খায়।
আত্মকথনের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো এই আয়ু নিয়ে নিজের প্রকাশ কখনো পরাবাস্তব রহস্যময়তায়, কখনো বা চেনা দৃশ্যের পার্থিব বলয়ে। অর্ধেক আগুনে জ্বলা, অর্ধেক কুয়াশা অতল।
বাঁচি প্রতিটি মুহূর্ত- প্রতিদিন। আলো ভেঙে, অাঁধার ছেনে, প্রেম ও জন্ম মেখে, ধুলায় গড়িয়ে কবিতা আমার কখনো পাথর, কখনো তরল। কখনো কি হয়ে ওঠা?
কবিতা সকলের হাতে ফোটে না
কা ম রু ল হা সা ন
কী কবিতা এবং কী কবিতা নয়_এ এক চিরকালীন বিতর্ক, কেননা কবিতা বহুপ্রকার এবং বিভিন্ন সময়ে বদলে গেছে তার আদল। সঙ্গে বদলেছে পাঠকের রুচি। অতীতে যে কবিতা সমাদৃত হয়েছে, বর্তমান কালে এসে তা হয়েছে পরিত্যক্ত। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বাঙলা কবিতা হাজার বছরের পথ পরিভ্রমণ করেছে। এই সহস্র বছরে অজস্র কবি ছন্দোবদ্ধ পদ রচনা করেছেন, আমরা তাদের নাম ভুলে গেছি, টিকে আছে কতিপয় কালোত্তীর্ণ প্রতিভা। সে বিচারও আজকের বিচার, আরো হাজার বছর পরে তা পাল্টে যাবে। কবিতা সকলের হাতে ফোটে না, অনেকে সারাজীবন লিখেও একটি স্মরণযোগ্য পঙ্ক্তি বা কবিতা লিখতে পারেননি, বিপরীতে কেউ কেউ যা লিখেছেন, তাই হয়ে উঠেছে কবিতা। 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি' জীবনানান্দের এই আপ্তবাক্যের কাছে আমাদের ফিরে যেতেই হয়। তবে বিখ্যাত কবিদেরও সব লেখা কবিতা হয়ে ওঠেনি। যেসব লেখা কবিতা হয়ে ওঠে, সেসবের ভেতর এমন এক অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য আছে, শব্দ ও ছন্দের এমন আশ্চর্য জুড়ন রয়েছে যে পাঠক আন্দোলিত হন, কবিতাটি তার হূদয়ে গেঁথে যায়। কবি নিজেও হয়ত জানেন না কখন কবিতাটি হয়ে উঠল। উত্তীর্ণ কবিতার কাছে পাঠক বারংবার ফিরে যায়, মনোসংকটে এর কাছে আশ্রয় চায়। কবিতা তখনি হয়ে ওঠে, যখন তা এমন এক দু্যতি ছড়ায় যা আবিষ্ট করে রাখে পাঠককে, বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, ছন্দ ও অলঙ্করণের মিশ্রণে তা হয়ে ওঠে অপরূপ। পরিমিত অবয়বে বৃহত্তর পৃথিবীকে ধারণ করে, বিশেষ থেকে সাধারণে পেঁৗছায় আর ইঙ্গিতে ধারণ করে ইন্দ্রিয়বিশ্ব। অগুণিতের মনোসঞ্জাত জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে ঐ ছন্দ-শব্দ_অলঙ্করণ-এ ঋদ্ধ কবিতা; এমন এক বাণী সে নিয়ে আনে যা অশ্রুতপূর্ব, এমন এক অনুভবে দোলায় যা নতুন।
পাঠমাত্রই ঘুম ভেঙে যায়
টো ক ন ঠা কু র
একটা দুপুরবেলার ফাঁকা রাস্তায়, হঠাৎ একটা ঘূর্ণিচক্র কিভাবে তৈরি হয়? খড়কুটো, ছেঁড়া পলিথিন, টুকরো কাগজ কিংবা ধুলো চক্রাকারে দল বেঁধে ঘুরতে ঘুরতে উড়তে থাকে। মাটি ঘেঁষে বেশ কিছুদূর পর্যন্ত যায় ঘূর্ণিটা। একজন কবি লিখেছেন, ঘূর্ণির মধ্যে উড়ে যাওয়া ছেঁড়া কাগজের টুকরোতে কার নাম লেখা ছিল, জানো? মালতী বসুর?
আমি টের পেয়ে যাই, হঠাৎই, ওরকম একটা ঘূর্ণি বোধহয় এল, মাথার মধ্যে। তখন, মাথার মধ্যেই ঘূর্ণিচক্রঃমাথার মধ্যেই খড়কুটো, টুকরো কাগজ, মাথার মধ্যেই ধুলোদল কিংবা একটা আবছা ইমেজ, ইমেজটা হয়তো প্রথমে কয়েকটি শব্দের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে পড়তেই বাক্য আত্মপ্রকাশ করে ফেলল। অসংখ্য শব্দে গাঁথা বেশকিছু বাক্যসমষ্টি হয়ে হয়তো লেখা হয়ে যায়, আবার লেখা হয়ও না কতঃলেখা হলেই যে হলো, তাও তো নয়। লেখার পরে মনে হলো, না, যা ভাবনায় ছিল, তা পুরোটা আসেনি। তখন আর ভালো লাগল না। খাতাতেই পড়ে থাকল। কিন্তু যে লেখাটা লেখার পরেই মনে হলো, আহ্! নেমে গেল!! তখন হয়তো নিজের মধ্যেই তৈরি হলো আনন্দ। সৃষ্টির আনন্দ। হয়তো কয়েকটা দিন লেখাটা পড়ে থাকল খাতার মধ্যেই, তারপর আবারো পড়লাম। কাটাকুটি তো লেগেই থাকে, যতক্ষণ মনে হতে থাকে, না, মনমতো হয়নি। যথার্থ সেই শব্দ কিংবা শব্দবন্ধ পেয়ে গেলেই লেখাটা কমপিস্ন্নট। তারপর পাঠিয়ে দেই কাগজে। ছাপা হয়ে যায়। পাঠকের প্রতিক্রিয়া পাই, পাঠিকাদেরও পাই, 'আপনার কবিতাটা খুব সুন্দর হয়েছে' 'পড়ে ভালো লাগলো কবিতাটি' 'আপনার কবিতাটি পড়ে আমি মনে মনে আপনাকে খুঁজছিলাম, পেয়েও গেলাম, বলি, কি লিখেছেন আপনি, পড়তে-পড়তেই তো ফিরে গেলাম তের বছর আগে?' ইত্যাদি মন্তব্যের ভেতর দিয়ে দেখি, আমার সেই লেখাটা 'কবিতা' পদবাচ্য পেয়ে যাচ্ছে।
দেখতেই তো পাচ্ছি, দিনে দিনে বালিকারা বড় হয়ে ওঠে, যুবতী হয়ে যায়, নারী হয়ে ফোটে। ছোট্ট কুঁড়ি, ফুটে ওঠে ফুল হয়ে। স্তব্ধতা নেচে ওঠে গান হয়ে। আর কোত্থেকে একটা শব্দ বা দৃশ্য বা অনুভূতি-চেতনার কোনো ইমেজ_কিভাবে যেন লেখাও হয়ে যায়। কোত্থেকে সব শব্দ-বাক্য নিজেই ছুটে আসে, এলেই একটা লেখা দাঁড়িয়ে যায়। সে লেখা হয়তো খাতার মধ্যে ঘুমোয়, কেউ পাঠমাত্রই তার ঘুম ভেঙে যায়। লেখা আত্মপ্রকাশ করে। তখন তাকে কবিতা বলবে কি বলবে না, তা পাঠক, সমালোচক, অন্যান্য লেখক, শিক্ষিত প্রকাশক_তাদের ব্যাপার। আমার কাজ আবার একটি নতুন লেখার সন্ধানে ফাঁদ পেতে বসে থাকাঃহাওয়ার ঘরে।
পাঠক যখন বলে ওঠেন 'বাহ্'
তু ষা র গা য়ে ন
যে কোনো উত্তীর্ণ কবিতা তিনটি দশাকে অতিক্রম করে হয়ে ওঠে। প্রথম দশাটি হচ্ছে কবির মনোজগতে কোনো এক মুহূর্তের অনুভব, উপলব্ধি বা বোধের আলোড়ন যা কবিকে বিদু্যৎস্পৃষ্ট করে তোলে ঐ মুহূর্তের অভিজ্ঞানকে ভাষার আধারে ধারণ করার জন্য। সেই মুহূর্তটি হতে পারে কোনো খণ্ডকাল অথবা মহাকালের কলরব ও অনুভব রাশির বার্তাবাহী। দ্বিতীয় দশাটি হলো, ঐ মুহূর্তের স্বরূপকে প্রকাশ করার জন্য কবি যখন তাঁর একান্ত প্রকাশভঙ্গী ও ভাষাশৈলী, ছন্দ-উপমা-উৎপ্রেক্ষার মাধ্যমে কবিতা নির্মাণের আনন্দ ও যন্ত্রণাকে যুগপৎ অনুভব করেন, যেভাবে একজন গর্ভধারিণী মা সন্তান প্রসবের আনন্দ ও যন্ত্রণাকে অভিজ্ঞান করে থাকেন। তৃতীয় দশাটি হলো, কবিতাটি রচিত হয়ে যাওয়ার পর যখন তা পাঠকের মানসভোজে উপস্থিত হয় এবং তা পাঠ করে অনাস্বাদিত আনন্দ ও অভিজ্ঞানের মুখোমুখি হয়ে পাঠক বলে ওঠেন, বাহ্?! সত্যিকার অর্থে, কবিতা তখনই হয়ে ওঠে যখন পাঠককে কবি তাঁর উপলব্ধি ও সৃষ্টির আনন্দের অংশীদার করে নিতে পারেন। কবিতা অনেক রকম এবং পাঠকও নানা জাতের; তাই পাঠকের প্রস্তুতি ও পাঠ অভিজ্ঞতাও নতুন কাব্য আস্বাদনের জন্য দায়ী! তবে কবিতা যখন নির্মাণের দাগ মুছে স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টিশীলতায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়, তখন তা দ্রুত অথবা ধীর প্রক্রিয়ায় পাঠকের মন দখল করতে থাকে। 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ', 'বিদ্রোহী', 'বনলতা সেন', 'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা', 'সোনালী কাবিন', 'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি', 'ফিরে এসো চাকা'ঃএ রকম অজস্র কবিতা কাল অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে পাঠকের স্মৃতি ও শ্রুতির অংশ। পাঠক যখন কবির নাম বিশ্রুত হন, কিন্তু কোনো এক আনন্দ বা বিষাদের মুহূর্তে, জীবনের কোনো এক সন্ধিক্ষণে বা প্রদোষবেলায় গুনগুন করে ওঠে কোনো একটি পঙ্ক্তি, তখন 'কবিতার হয়ে ওঠা'-র পরম মুহূর্তটি টের পাওয়া যায়!
অনাদিকালের পৃষ্ঠে কবিতার ভূগোল
পা ব লো শা হি
তাহার সঙ্গে দেখা হইবার পূর্বে, আমার অন্তর অনুভূতির ঝোল খাইনি কোনদিন। যদিও তিনি অথর্াৎ আমার জানপহেচানের সঙ্গে দেখা হইয়া ছিল তিন দশককাল আগে, তবু প্রথম কবিতার আধার ছবিবিবিকে দর্শনের পর থেকে কবিতার ভাতবর্ণগুলি কেমন যারপরনাই বিচলিত হইয়াছিল আজও তেমন বিচলিত হইয়া আছি। বুঝিয়াছি, আদিকালের কবিতাপৃষ্ঠে সেই আমার নিয়তি? আমার অনুভূতির ঘোড়াগুলির বাঁকঘোরার সেইতো পূর্বক্ষণ, তা থেকে অদ্যাবধি সেরকমই রহিয়াছে। অতঃপর আমার হুশ প্রাপ্তি হইল কবিতার ভূগোলে। ভাবি, পৃথিবী একটা মৃগরোগীর নাম অথচ ইহার মধ্যে লুকায়িত বিষাদ আর বক্ষের ভূগোলে লুকানো মানুষের মন। এইভাবে মনমন্দিরের ঘড়ির কাঁটায় ঝুলিয়া থাকে কবিতা হইয়া ওঠার জন্মইতিহাস। সত্যিকার কবিরা হয়তো পাঁজড় কাটিয়া দেখে, তাহাদের মনের মধ্যে কত আছে অন্তত বিষাদের দৈর্ঘ্যপ্রস্থ। আমিও, তৎপর হইয়া, ছবিকে কাটি, নিজেও রক্তাক্ত হই, নিজে সে অনুভূতির রক্তের কাদায় গড়াগড়ি দেই আর মনের অস্থির মাছির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে লিখিয়া ফেলি_'তোমার জন্য অনেক দিন ধরে কুড়িয়ে রেখেছি দিনগুলি, মানুষতো সবকিছুর নাম দেয়; তাই দিনগুলির নাম দিয়েছি 'হারানো গান'।' এই 'তুমি'কে অনেক নামে ডাকিয়াছি আমি_সে 'হলুদপাখি' সে 'আগুনপাখি' সে 'জানপহেচান' সে শৈশবের জমিনে চিহ্নিত খোলাখাতা। ফলত, 'তুমি'তে ঘোরলাগা চারধারের বস্তুসমূহ কবিতা হইয়া ওঠে। এর মধ্যে রূপায়িত হইয়া ওঠে সমাজ, জনগোষ্ঠীর আত্মচরিত আর গর্ভবর্তী বেড়ালের প্রার্থনা। আর 'তুমি' নিরন্তর এই বক্ষের মানচিত্রে, কেননা সে মনপোড়াগন্ধ ও দস্যুমেঘ থেকে রক্ষা পাবার ছাতা? 'তারপরও আমার হারিয়ে যাওয়া কাহিনী আমি তোমাকে বলবো না। যদি তুমি তার মধ্যে গন্ধ শুঁকে খুঁজে পাও দুঃখ ও পাপঃআমি এখনও ছাতিম গাছের খোড়লে নিজেকে লুকিয়ে রাখি। দেখি তার ভেতরে বশীকরণ মন্ত্র আর উদাসী এক পরীর মুণ্ডু-রক্ত-ধড়।'
এই দুর্ভাগ্যের দিকে ভাগ্যকে_বেদনায় ফিরাবার মধ্যে কবিতা হয়ে ওঠে। কেননা, আমাদের অনুভূতিগুলি আমাদের ভূখণ্ডের পাহারাদার। আর সেই কার্যত নারীকে, আগুনপাখিকে তিন দশক আগে দেখা জানপহেচানকে দেখিয়া সেদিন থেকে অদ্যাবধি এখনও সে মনে করে_'নারীরা সব হতে পারে_ডুমুরের ফুল, দস্যুমেঘের পালক কিংবা ছাতিমের গাছ।' উহ্যত, তাহার প্রতি আমার মহাকালের এই ভাব যা_'আমি দিনগুলিকেও তোমার মতো বক্ষে কুড়িয়ে রাখি। তোমার বুক দেখার নাম করে দেখি_আমাদের দিনগুলির অন্তর্দাহ।' কার্যত, জীবনের একটা কবিতার পোকা রহিয়াছে মানব অন্তরে, তাহাকে খুঁজিয়া মরি কবিতাকল্পনালতায়। এতোদিন বক্ষের টিপিনবক্সে তা লুকিয়ে রাখিয়াছিলাম। আজ তাহাকে লিখি এইভাবে_'তার থেকে যে শব্দ, যে বাক্যগুলি এতোদিন লিখেছো ভালোবাসার জন্যে, দেখো তার বুকে দীর্ঘশ্বাস আছে কিনা?' এতো কিছুর পরও তিন দশকের ভালোবাসায় তাহাকে (ছবিকে) পায় নাই, তারপরও 'তুমি'কে 'কবিতা'কে এই বক্ষবেদনায় কবিতা করিয়া তুলি_'আমার কষ্টেপোড়া পোশাক, মেঘবজ্রের মুখমণ্ডল আর ফুসফুসির গলাকাটা হাসপাতাল।' উহ্যত, ছবিবিবিকে অথবা কবিতাকল্পনালতাকে আমি যেদিন প্রথম দেখিয়াছিলাম সেই দিন থেকে আমি ছাতিম গাছে_বৃষ্টি ও কান্নার বই হাতে বশিকরণ মন্ত্রপড়িয়া দিন কাটাইতেছি। হয়তো জানপহেচান ছবিও কবিতাকল্পনালতা হইয়া, আমার বক্ষে অনুভূতির দলা হইয়া ধরা দিবে একদিন?
মনের সাথে কল্পনার লুকোচুরি
অ ত নু তি য়া স
কবিতা হয়ে ওঠে। কবিতা নিজেই কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। কবির হূদয়বৃন্ত থেকে ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে কবিতা। কবিতাকে প্রার্থনা করতে হয়। কল্পনা দেবীর পায়ে সারারাত বসে থাকতে হয় ধ্যানে। কখনো কবিতা ধরা দেয়, কখনো দেয় না। তবুও কবি বসে থাকেন। জীবনের দুঃখ-সুখ-আনন্দ-অভিজ্ঞতা-স্মৃতি দ্রবীভূত হয়ে সৃষ্টি হয় ভাব। সেই ভাবের পরিণত রূপই কবিতা।
একটা কবিতার জন্য আমি কল্পনার সমুদ্রে জাল ফেলে বসে থাকি। সেই সমুদ্র থেকে উঠে আসে রুপালি মাছের ঝাঁকের মতো শব্দগুচ্ছ। আমাকে লিখতে বলে। আমি লিখি। এগুলো কী? কবিতা? কবিতা আসলে কী? কবিতা তো সংজ্ঞার অধিক। এত রূপ অঙ্গে যার, রহস্যময়ী, সুন্দর_সে-ই তো কবিতা। কবিতা তো অধরা, অসীম। কবিতা মনের সাথে কল্পনার লুকোচুরি, প্রেম প্রেম। কবিতা তো অন্তর বাউলের তারে বেজে ওঠা একতারার সুরঃ
একটি কবিতা লেখার পর আমি জীবনের ভার থেকে মুক্তির আনন্দ পাই। এই আনন্দের কোনো সংজ্ঞা নেই; নেই যেমন কবিতার। আবার কখনো মনে হয়, কবিতা একঝাঁক প্রজাপতির দুরন্ত নাচ। যার পাখায় পাখায় বিচিত্র রঙের সম্ভার। আমি সেসব প্রজাপতির পা আঁকড়ে ধরে কোথায় যেন হারিয়ে যাই। কোথায়? নিজেও জানি না। এভাবেই বিভিন্ন এলোমেলো শব্দগুচ্ছ এসে ভর করে আমার উপর। কখনো না চাইতেও ভর করে। কবিতা লিখতে লিখতে আমি অচেনা হয়ে উঠি নিজের কাছেই। নিজেকে প্রশ্ন করি, যে হাত আমাকে দিয়ে একটা কবিতা লিখিয়ে নিলো, সে হাত কি আমার? নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকেই খুঁজতে থাকি আর খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই অবচেতন মনের সাক্ষাত, হয়তো সেখানেই থাকে এইসব বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুচ্ছ, ছোট ছোট জীবনবোধ। আর এসবই আমার খাতায় ঠাঁই করে নেয়। আমি জানি না এগুলোর নাম কবিতা কি-না।
কবিতা কী, কেন, কিংবা কবিতার হয়ে ওঠাঃ
র ণ দী প ম ব সু
কবিতা কেন কবিতা, তা নিয়ে কাব্য-সাহিত্যের নন্দনতত্ত্বে বিস্তর আলোচনা বাদানুবাদ হয়েছে, হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। সাহিত্যের বিচিত্র প্রবাহে নিত্য-নতুন বৈচিত্র্যের জন্যেই এর আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। তাহলে কবিতা কী ?
কবিতা কী ? নানা মুনির নানা মতে হাবুডুবু খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত কবিতা যে আসলে শিল্পোপলব্ধির এক মায়াবী রসের নাম, তা আর বুঝতে বাকী থাকে না। কাব্যরসে নিমগ্ন রসজ্ঞরা বলেন_'ভাব থেকেই কবিতার জন্ম।' কিন্তু 'ভাব' তো একটা বিমূর্ত ধারণা মাত্র। আর যেহেতু কবিতা হচ্ছে একপ্রকার শব্দশিল্প, তাই আমরা বলতে পারি ভাবযুক্ত শব্দ রচনাই কবিতা। আবার শব্দই যেহেতু ভাবের মাধ্যম এবং অর্থহীন বা ভাবহীন কোন শব্দ বাস্তবে অস্তিত্বহীন, তাই শব্দ মাত্রেই কোন না কোন বস্তু বা ভাবের প্রতীকী প্রকাশ। তবু মালার্মে কথিত 'শব্দই কবিতা' সংজ্ঞাটিকে ভাবগত অর্থে মেনে নিলেও কবিতার পরিপূর্ণ সংজ্ঞা আদতে তৈরি হয় না। এজন্যেই ইংরেজ কবি কোলরিজের 'শ্রেষ্ঠ শব্দের শ্রেষ্ঠ বিন্যাস' সংজ্ঞাটিকে অধিকতর অর্থবহ মনে হয়। কিন্তু এখানেও বিপত্তিটা দেখা দেয় কবিতার সাথে একটা চমৎকার সফল গদ্যের পার্থক্য নিরূপণ করতে গিয়ে। কিন্তু দান্তে যখন বলেন_'সুরে বসানো কথাই হলো কবিতা' তখন কি সংগীত প্রাধান্য কবিতাকে আলাদাভাবে বিশিষ্ট হতে দেয়? এদিকে ছন্দ-অন্তঃপ্রাণ কবি বলেই হয়তো শঙ্খ ঘোষের 'ছন্দে সমর্পিত শব্দেরই নাম কবিতা' কথাটিকে মেনে নিতে গেলেও প্রশ্ন ওঠে_তবে ছড়া বা পদ্য কেন কবিতা নয়? তাই বুঝি শেষ পর্যন্ত আমাদের অগতির গতি রবীন্দ্রনাথেই ফিরে যেতে হয়_'রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা।' এটাকেই যথার্থ সংজ্ঞা বলে মনে হয়। প্রয়োজনীয় শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে যে অপরূপ শব্দচিত্র বা দৃশ্য আঁকা হয় তার মধ্যে অরূপের সন্ধান অর্থাৎ অন্তর্গত অনুভূতির রসে ভিন্ন কোন অর্থের আবহ তৈরি করাকে কবিতা বলা যায়।
কিন্তু আমাদের অর্থময় চেনা জগতের বাস্তব শব্দ দিয়ে তো আসলে অবাস্তব কিছু নয় বরং আমাদের চেনা দৃশ্য বা বাস্তব আদলই তৈরি করা যায়। তাই এ বাস্তবতাকে তীর্যকভাবে দেখার প্রয়োজনেই চলে এলো প্রতীক উপমা রূপক ইত্যাদির আলংকারিক ব্যবহারের মাধ্যমে চিত্রকল্প সৃষ্টির এক শিল্পীত প্রবণতা। সেজন্যেই জীবনানন্দ দাশের কথায় 'উপমাই কবিতা' বলতে মূলত কবিতার চিত্রকল্পতাকেই বুঝানো হয়ে থাকে। এভাবে যথাযোগ্য শ্রেষ্ঠ শব্দগুলোকে শ্রেষ্ঠ বিন্যাসের মাধ্যমে যে অপরূপ শব্দশরীরী চিত্রটা তৈরি হয়ে যায় তাও যখন প্রকাশের বর্ণনাময় আতিশয্যে রহস্যবিহীন, নিরাভরণ ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তখন রূপকল্পের দ্যোতনাময় মায়াবী চাদরে জড়িয়ে তাকে করে তোলা হয় চেনা অচেনার মিশেলে গড়া আধা-বাস্তব আধা-কল্পনার এক স্পন্দনশীল মূর্তি। এটাই কবিতা। আক্ষরিক ব্যাখ্যাযোগ্যতার গভীরে ক্রিয়াশীল অন্য এক উপলব্ধির অর্থময় অনুভব। পাঠকমনের সৃজনশীল কল্পনাও এখানে ক্রিয়াশীল হবার বিষয়নিষ্ঠ সুযোগ পেয়ে যায়। সে রচনা তখন আর স্রষ্টা বা কবির একার থাকে না, পাঠকের স্বতঃস্ফূর্ত অন্তভর্ুক্তি একে নিয়ে যায় রসঘন এক ব্যাখ্যাহীন পরিতৃপ্তির অন্তর্গত জগতে। এবং তখনই একটি সার্থক কবিতা প্রকৃতই কবিতা হয়ে ওঠে। এখানে আর বুঝানোর কিছু থাকে না, বুঝে নিতে হয়; ম্যাকলিশের সেই বিখ্যাত পংক্তির মতোই_'কবিতা কিছু বোঝায় না/ কবিতা হয়ে ওঠে।' কেননা বুঝাতে গেলে সে যে আর কবিতাই থাকে না। এই উপলব্ধিজাত বিস্ময় থেকেই বুঝি রবার্ট ফ্রস্টও উচ্চারণ করেন_'সেটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়'।
হূদয়পুরে আগেই জন্ম নেয়
বী রে ন মু খা র্জী
যাপিত জীবনের বহুবিধ প্রপঞ্চ ও দৃশ্যমান ভাবনা থেকে সৃষ্ট এক ধরনের আবেগ আমার অন্তঃপুরে সারাক্ষণ খেলা করে। আবেগ আমার ধ্যানের পৃথিবীকে ওলট পালট করে, আন্দোলিত করে। ক্রমশ চলতে থাকা ওই প্রক্রিয়া থেকে উৎসারিত বোধ আমি প্রকাশ করতে চাই, প্রকাশকামী কাঙ্ক্ষায়। এ অবস্থায় পেঁৗছে ওই বোধের সুনিয়ন্ত্রিত বিন্যাস করি অর্থবোধক নানা শব্দে। তা সুখপাঠ্য করতে যোগ করি ছন্দবৈচিত্র্য। উপমা ও চিত্রকল্প ব্যবহারে সচেষ্ট হই। এভাবে লেখা হতে থাকা পঙ্ক্তিগুচ্ছ। এক সময় এ প্রক্রিয়ায় পরিপূর্ণ আভায় বিকশিত হয় আমার ভাবনা রাশি। হয়ে ওঠে আমার কবিতা। অবশ্য এরও অনেক আগে হূদয়পুরে তৈরি হয় অন্য এক কবিতা। আমি সে কবিতার নাম দিয়েছি প্রকৃত কবিতা। দৃশ্যমান লিপির কবিতা ওই চেতনা-দর্শনের অবয়ব মাত্র। প্রকৃতার্থে কবিতা বলতে আমি যা বুঝি তা প্রকাশ করতে পারি না_অনুভব করি মাত্র। যে কারণে কবিতায় জ্ঞান প্রয়োগে বিরত থাকি। কবিতাকে ব্যঞ্জনাঋদ্ধ করতে সতর্ক থাকি। বাক্য বন্ধনীতে আবেগের লাগাম টেনে ধরি। জীবন চারিয়ে রসমাধুর্যে, উপস্থাপন করি কবিতা শিল্পকে, শিল্পময় জীবনের সারসত্তা হিসেবে। অতীত অভিজ্ঞতা ও সমকালিন বিশ্বলোক থেকে আহরিত নানা বোধগত অর্থ ভেঙে ভেঙে নতুন দ্যোতনায় জারিত করি কবিতার কেন্দ্র। যাপিত অভিজ্ঞতার ধারক হিসেবে দেখি কবিতাকে। তবে, এ ভাবনায় লিখিত আমার সবগুলো কবিতা ঠিক 'কবিতা' পদবাচ্য হয়ে ওঠে কি-না বলা সুকঠিন।
আমি কবিতার সেবাদাস
মা মু ন মু স্তা ফা
'চর্যাপদ'কে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ধরে বলা যায় আমাদের বাঙালি মন ও মানসিকতায় চর্যাপদই আদি সঙ্গীত। কেননা সুর সৃষ্টির মাধ্যমে কবিতাই হয়ে ওঠে গীতিকবিতা। সুতরাং আমি একে লালন করি নিজস্ব অনুভূতির বলয়ে_যেখানে কেবল নিঃসঙ্গতা নয়, এমনকি প্রেম-সংঘাত, আনন্দ-দুঃখ-কষ্ট নয় বরং ব্যক্তির দর্শনসঞ্জাত দৃষ্টিভঙ্গি বলে দেবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তার অবস্থান। যার ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় ব্যক্তির স্বাতন্ত্রিকতা।
সেই সূত্র আবিষ্কারের পথ ধরে জেওফ্রি চসার পত্তন করেছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের। কালক্রমে এলিজাবেথীয়ান যুগ, রোমান্টিক ও ভিক্টোরিয়ান যুগ পেরিয়ে আধুনিক পর্বে এসে টি এস এলিয়ট ও তাঁর সমসাময়িকদের হাত ধরে এর পরিণতি। একজন কবি শুধু একটি কবিতাই রচনা করেন না বরং এর মাধ্যমে তিনি তাঁর সময় ও সমাজকে নির্ণয় করার প্রয়াস পান। পরবর্তীতে সেই আলোকবর্তিকায় পথ চলে আগামী। আমি সেই কবিতার পরিপূর্ণ সেবাদাস।
মানুষ তার মৌলিকতা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। কবিও তার ব্যতিক্রম নয়। তেমনই আমার কবিতারও পশ্চাতে কাজ করে মৌলিকত্ব। যেখানে প্রচলিত ধর্ম-রীতিনীতি-বিশ্বাসকে অস্বীকার নয় বরং এগুলোর হাজার বছরের ইতিহাসকে সাক্ষী করেই গড়ে ওঠে আমার কবিতা। সুতরাং আবেগ, অনুভূতি ইত্যাদি বোধ থেকে কবিতা জন্ম নিলেও আমার কবিতা মুক্ত মানবতার সপক্ষে চিরকাল কাতর। আমাকেও তাই বলতে হয়েছে কখনো, 'চন্দন বৃক্ষের নিচে শুকিয়ে শুঁঠ হয়ে/শুয়ে আছে কবিঃ/তার পায়ের কাছে লতাশাপ কুট কুট করে কাটে/লোকসংস্কৃতির শিকড়।' অথবা_ 'পথের শেষ এই, যাত্রারও।/বাতিঅলা, এ অাঁধার কেটে কেটে পথ চলো তোঃ'।
কবিতার প্রকাশ-অপ্রকাশ
বি ধা ন রি বে রু
অ_ভাব মানে অভাবের ভাব থেকেই কবিতা মাথায় আসে, ঠিক কবিতা নয়, বিদু্যৎ ঝলকের মতো কয়েকটি লাইন। কখনো শব্দগুলো গুছিয়ে আপসে আপ বসে যেতে থাকে মাথার ভেতর। কখনো বা উলোট-পালোট করে যাওয়া-আসা করতে থাকে চিন্তার বারান্দায়। সেসবের যেগুলো খাতায় নামানো হয় সেগুলোর সবই যে কবিতা হয় তা নয়, আবার কবিতা হয়েছে বলে যেটিকে মনে করছি সেটা যে ভ্রম নয়, সেই সংশয়ও দূর করতে পারি না। শব্দের যে মালা খাতায় নামানো হলোনা কিংবা নামালাম না সেগুলো চেতনের পেছন দরজা দিয়ে অচেতনের দিকে রওনা দেয়।
এখানে দুটি বিষয় হয়. এক, শব্দ মাথায় আসে, এরপর সেগুলোকে কবিতায় রূপ দেই না। দুই, ভুলে যাই। আমার মনে হয় দুইটা বিষয়ই একই কারণে হয়। আমাদের চেতনা বা কনসাস যাকে বলে, সেটি ঐসব শব্দের লিখিত রূপ হতে বাধা দেয়। অতএব কবিতা মারা যায় ভ্রুণ অবস্থাতেই।
আমার মাথায় অধিকাংশ সময়েই যেসব কাব্যময় লাইন আসে, সেগুলো ব্যক্তিগত আবেগ ও উচ্ছ্বাস জারিত। সেসব কথা পাতায় লিখে রাখতে মন সায় দেয় না। আবার যদিও বা চেতনের পাহারাদারকে টপকে লিখে ফেলি, ছাপতে দেই না কোথাও। অতএব ঘটনা একই দাঁড়ালো_ অপ্রকাশিত থাকলো ভাবনাগুলো। খাতায় লিখে ফেলা কবিতা ছাপতে না দেয়ার একটি কারণ যেমন, পংক্তিগুলোকে বড় ব্যক্তিগত মনে হওয়া তেমনি আরেকটি কারণ, আগেই বলেছি, সংশয়।
তবে কখনো কখনো শরতের অভ্রভেদী সূর্যরশ্মির মতো কবিতা ঝলক দিয়ে যায়, সেগুলোকে খাতায় নামানোর পরও ঝলমল করতে থাকে। বলা বাহুল্য নয়, তাঁরাই শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হন।
অহেতুক কবিতা
ফা তে মা আ বে দী ন না জ লা
দাদী কবিতা কি? এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম "ওরে বোকা, কবিতা কি না কবিতা কে? তোর ফুফু লাগে উত্তর পাড়ায় থাকে। "
যখন স্কুলে যেতে শিখলাম মিস খাতায় লিখে দিলেন ২২নং পাতার কবিতার প্রথম আট লাইন মুখস্থ করবে। বাসায় ফিরে ২২নং পাতা বের করে দেখলাম ছোট একটা গল্প । গল্পটা ছিল মা ভাত খাওয়ানোর সময় চাঁদ মামাকে ডেকে বলছেন চাঁদের কপালে টিপ দিয়ে যেতে। তখন বুঝলাম ছোটগল্পকে সাজিয়ে গুজিয়ে লিখলে কবিতা হয়।
সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন_
'বহুদিন পর মনে পড়ে আজি পলস্নীমায়ের কোল
ঝাঊশাখে সেথা বনলতা বাঁধি হরষে খেয়েছি দোল।'
একদম জ্বলজ্বলে ছেলেবেলার গল্প সেটা নাকি আবার কবিতা। কোনোদিন ও কবিতার বিষয়টা বুঝলাম না। আমার কাছে পৃথিবীর তাবৎ কবিতাগুলোকে নির্জলা গল্প বলেই মনে হল। মনে হয় এটা একান্তই আমার মনের ভুল। কিংবা প্রতিটা কবিতার পেছনের একটা গল্প থাকে। আর থাকে চরম অলসতা কিংবা প্রখরতা।
অলসতা শব্দটা কবিতার সাথে তুলে আনার পেছনে একটি অকাট্য যুক্তি আছে। মোটামুটি জনপ্রিয় একজন কবিকে প্রশ্ন করেছিলাম চাচা কবিতা কেনো লিখেন - হা হা হো হো করে যেটা বললেন সেটার সারমর্ম হচ্ছে- আসলে মা গল্প লিখতে বিশাল খাতা কলমের ব্যাপার প্রচুর সময়ের ব্যাপার এত কষ্ট কে করে যদি সেই একি জিনিস ছ'লাইনে কবিতা বলে চালানো যায়। তখন বুঝলাম অলস লোক কবিতা লিখেন। এটা একান্ত আমার ছেলেবেলার ভাবনা।
আর প্রখর শব্দটা আসবেই কবিতার সাথে। পাতার পর পাতা গল্প লিখে যে ভাব প্রকাশ করা যায় না মাত্র দুটি বাক্যে সেই গল্পটা এরচেয়ে বড় প্রখরতা আর কোথায় আছে?
সেদিন টিভি সাক্ষাতকারে নির্মলেন্দু গুণ বললেন সমকালীন সবাই যখন বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হচ্ছেন ছবি আঁকা ফটোগ্রাফির মত কাজে, তখন তিনি দেখলেন কবিতা লেখা ইনভেস্টমেন্ট সবচেয়ে কম দু টাকার কাগজ কলমে লিখা যায়। তাই তিনি কবি হয়েছেন। খুব জানতে ইচ্ছা হয়েছিল_স্যার আপনার লিখার পেছনে যে গভীর বোধ, যে তীক্ষ্ন অনুভূতি সেগুলো কোন ইনভেস্টমেন্টের ফসল? খুব জানতে ইচ্ছা করে কি করে সৃষ্টি হয়েছিল_
'আমি বলি না আমাকে ভালোবাসতেই হবে
আমি চাই কেউ একজন আমার ঘরের ছিটকিনিটা ভিতর থেকে খুলে দিক
কারণঃ
বাইরে থেকে ছিটকিনি খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।'
কি অদ্ভুত অনুভূতি ! ভাবনার কি অদ্ভুত সম্মিলন! ছোট ছোট অনুভূতির পেছন তাড়া করতে করতে খুব সাহসের সাথে কলম তুলে নিয়েছিলাম বন্ধুর কথা লিখতে। সেটা নেহায়েত কতগুলো কথার শব্দ সাজানো। অকারণে যদি কারো কাছে সেটা কবিতা বলেই মনে হয় এই দায় শুধুই পাঠকের। আমার কাছে এ শুধু আমার বন্ধুর জন্য অনুভব।

অকবির কবিতার গল্প
রা ফি উ ল রা জী রি ট ন
মানুষ কবিতা সম্পর্কে যত বেশি জানবে, ততই মঙ্গল। আমার মনে হয় যাঁরা কবিতা লিখতে চান, তাঁদের সবারই কবিতা লেখা উচিত, যাঁরা গান করতে চান, তাদের সবারই সঙ্গীত সাধনার দিকে যাওয়া উচিত; কিন্তু অপরিণত অবস্থায় কারোরই নিজের গানবাজনা অন্যকে শোনানো উচিত নয় কিংবা আধা-কবিত্ব নিয়ে উচিত নয় কবিতা প্রকাশ করা।
আমি সেই কাতারের অকবি, যাদের লেখা লোকসম্মুখে প্রকাশ করা উচিত নয়। তবু ভিখিরির তো ডাকাত হতে ইচ্ছে করে। সেই সব ইচ্ছার জের ধরেই নিজেকে ডাকাত প্রমাণ করার অপচেষ্টা।
হাঁটতে হয়, খাটতে হয়, তারপর হতে হতেই না একদিন কিছু হয়ে ওঠে। যেকোনো কিছুরই হয়ে ওঠার পেছনে পরিক্রমণের একটি গল্প থাকে। কবিতার বেলাতেই বা ভিন্ন কি! তবে হয়ে ওঠারও আবার নানান পর্যায় থাকে, প্রতিটা পর্যায়ের আবার মাত্রাভেদ আছে। আমার এ লেখাটিও মূলত একটি নির্দিষ্ট পর্যায় থেকে; কিন্তু নিজস্ব বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি সম্পৃক্ত।
কবিতার প্রতি আমার আগ্রহ এবং যোগাযোগের বয়স এক যুগ।
জীবনানন্দ দাশের 'আট বছর আগের একদিন' কবিতাটিই মূলত আত্মিকতা তৈরি করে। আমি আসক্ত বোধ করি এবং ক্রমশ আত্মঘাতী হয়ে উঠি। প্রচণ্ড মানসিক বিপর্যয় থেকে এক ধরনের রূপান্তর ঘটে আমার, কবিতা রচনা করার চেষ্টা শুরু করি এবং কোনো পূর্ব-প্রচেষ্টা বা আকাঙ্ক্ষা না থাকা সত্ত্বেও নিজেকে প্রবল একজন কবি ভাবতে থাকি। লেখালেখির প্রথম নমুনাগুলো ছিল হাস্যকর; কিন্তু তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। পুড়িয়ে ছাই করেছি কবিতার খাতাগুলি। কিন্তু সে সময়ের একটি লেখা আজও আমাকে থমকে দেয়। কবিতাটির নির্মাণ নেহায়েত ফ্যাণ্টাসি থেকে নেয়। নমঃশূদ্র পথিক, দরিদ্র কবি এবং অভিজাত বাহ্মণ এই তিনে প্রাণ প্রচণ্ড চাপে এক হবার চেষ্টা করছে_যন্ত্রণাদায়ক এক মহিমায় হঠাৎ উৎসারিত এই কবিতাটি কি হঠাৎ করেই হয়ে উঠেছিল?
প্রতীক এবং চিত্রকল্প সহজবোধ্য, সাধারণ পাঠকের কাছাকাছি থাকতে পেরেছি এবং এটিই হলো দৃষ্টভঙ্গি। কবিতা বলে সর্বজনগ্রাহ্য হলে সকলেরই লাভ। এই কবিতার মত লেখায় আমি আমার পর্যায়কে আয়ত্তে আনতে পেরেছি। এই বেলা শেষে প্রাপ্তি।
============================
সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠাই কবির তপস্যা  পাঁচ গাড়িসহ দুই ছেলের মালপত্র বুঝে নেওয়া হলো আজ বাকিগুলো  গল্প- 'কোনো এক গাঁয়ের বিয়ে'  গল্প- মৌরস ভৌরস  শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম  গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'  আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং  আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'


দৈনিক ইত্তেফাকে এর সৌজন্যে

এই সাহিত্যালোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.