গল্প- 'কোনো এক গাঁয়ের বিয়ে' by রেজাউর রহমান

বাঁশখালী গ্রামের ইউসুফ খলিফা তাঁর মেয়ের বিয়ের বরপক্ষ ও অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। এমন সময় হুড়মুড় করে মোটরসাইকেলে করে একদল সাদা পোশাকি লোক এসে হাজির। সেখানকার সমবেত সবাই তাদের অনুষ্ঠানে যোগদানকারী অতিথি দল ভেবে নিয়েছিল ততক্ষণে। কিন্তু হঠাৎ করেই পরিস্থিতি অন্যরূপ নেয়। আগত দলের মাঝখান থেকে ভারিক্কি গোছের একজন এগিয়ে আসে। তার কণ্ঠে রাগের ঝাঁজ।
‘ইউসুফ খলিফা কে?’
গামছায় হাত মুছতে মুছতে ইউসুফ এগিয়ে আসেন।
‘জি আমি..., আমি মেয়ের বাবা..., আপনারা বসেন।’... আগন্তুক মুখপাত্র প্রায় গর্জে ওঠে।
‘আমরা থানা থেকে এসেছি। পুলিশের লোক। আপনার বিরুদ্ধে চুরির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। গত ১৫ জুন রাতে বাঁশখালী গ্রামের হাবিব মণ্ডলের বাড়ি থেকে ৩৫ হাজার টাকা দামের দুটি গরু চুরি হয়েছে। আপনি প্রধান আসামি...।’
বিয়ের আসরের মেয়ের বাবা ইউসুফ খলিফার মুখ দিয়ে শুধু বেরোল, ‘আমি আসামি... গরু চুরি...’
ততক্ষণে আগত মোটরসাইকেলবাহীদের মধ্য থেকে দুজন এসে ইউসুফের কোমর বেঁধে ফেলে এবং টেনে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়।
আসর ততক্ষণে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার পথে। অভ্যাগতরা সবাই গ্রামের নিরীহ গোবেচারা মানুষ। তারা সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। পরিস্থিতির আকস্মিকতা ও ঘটনাচক্রের আগপিছ কিছু বুঝতে না পেরে হকচকিত, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থমকে থাকে সবাই। এর মধ্য থেকে শুধু সাহস করে বাঁশখালী প্রাইমারি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হেড মাস্টার এগিয়ে এসেছিলেন দু-পা।
‘আপনারা একটু বসেন... আজকের দিনটির কথা ভেবে... ইউসুফের মেয়ের আজ বিয়ে, ... এমন দিনে বোন-ঝি সবারই আছে... মেয়েটির দিকে চেয়ে অন্তত একটা দিন অপেক্ষা করেন। আমি জিম্মাদার রইলাম। আগামীকাল তাকে আমি নিজে থানায় পৌঁছে দিব...।’
কথা শেষ করতে পারে না হেডমাস্টার সাহেব। আবার গর্জে ওঠে পুলিশের লোক।
‘আপনি কে?’
‘আমি সামান্য হেডমাস্টার... সবাই আমাকে হারিস মাস্টার বলে জানে।’
‘আপনারাই তো ন্যায় শিক্ষার নামে দেশে চোর-তস্কর প্রশ্রয় দিয়ে বেড়ান...। এত কথার সময় নেই আমাদের। এই তোরা চল... এগিয়ে যা। দেখিস, চোর না আবার ফসকে যায়? কোমরের দড়ি ভালো করে বানছিস তো...।’
কনে জয়তুনও ততক্ষণে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে। অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে পুলিশের লোকদের উদ্দেশে বলে, ‘আপনাগোর পায়ে পড়ি... আমার বাবা চোর না...। খলিফার কাজ করে। বাবাকে ছাইরা দেন... আপনাদের পায়ে পড়ি।’
‘এই দেহি আরেক তিলিসমত। কোত্থেক্কা এক ছুকরি আইয়া হাজির। ছেদ-কান্দুরীর মা...’
‘এই ডা ওই আমার মাইয়া জয়তুন... তার ওই বিয়া। এমন রাইতে জামাই-মেহমানদের সামনে আমারে আর লজ্জা দিয়েন না। গরু আমি না নিলেও আমি জমি বেইচ্চা গরু কিন্না দিমু... আমারে ছাইড়া দেন... দশজনের সামনে ওয়াদা করতাছি...।’
মেয়েকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন বাবাও। কিন্তু কার কথা কে শোনে? পুলিশের লোকজন ইউসুফকে মেয়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এগিয়ে যায়। অন্ধকার আল-বাওয়া পক্ষের মোড়ে মিলিয়ে যায়। মিলিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে জয়তুন ঝাপসা জলভরা চোখে শেষবারের মতো দেখেছিল... বাবা তার শীর্ণ হাত উঁচিয়ে যেন বলছে, ‘মা আমার দোয়া রইল... তুমি জামাইয়ের গরে সুখী অইবা। আল্লাহ ভরসা... আমার জন্য চিন্তা কইর না। মার প্রতি খেয়াল রাইক্ক... জামাই মিয়া বালা মানুষ... আল্লাহ দেখব তোমগোরে...’
বাবা-মেয়ে-মার কান্নার হূদয়বিদারক দৃশ্য ও উপস্থিত সবার আক্ষেপ বেদনার সার্বিক সকরুণ পরিস্থিতি-কাকুতি কোনোটাই পুলিশ বাহিনীর মন টলাতে পারেনি এতটুকু। ইউসুফ খলিফাকে তারা নিয়ে চলে যায়।
ইউসুফ খলিফাসহ সাদা পোশাকি পুলিশবহর চলে গেলে অনুষ্ঠানে আগত অভ্যাগতরা, যারা এতক্ষণ এক ঠায় দাঁড়িয়ে ঘটনা অনুসরণ করছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে, তারা একটু নড়েচড়ে ওঠে। কেউ কেউ পাতা চেয়ারে বসে পড়ে হতাশার ভঙ্গিমায়। বিশেষ করে বরপক্ষের দু-চারজনের মধ্যে চাঞ্চল্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তারা মান-সম্মানের প্রশ্ন তুলে সোচ্চার হয়ে উঠতে চাইল। তারা বলাবলি করে, ‘তাইলে কি আমরা চোরের মাইয়ার সঙ্গে সম্পর্ক করতাছি। তাও আবার গরুচোর...।’ দু-একজন অবশ্য অন্য কথাও বলে, ‘এর মধ্যে একটা কিন্তু আছে মনে অয়... মেয়ে বিয়ার আগে ইউসুফ এমন কাজ করবে? তা মনে অয় না... এর মধ্যে...।’
বরপক্ষের লোক ছাড়াও গ্রামের অন্যান্য নিমন্ত্রিত অতিথির মধ্যেও নিরুৎসাহের ভাব ফুটে ওঠে। তারাও বলতে চায়, ‘এখান থাইক্যা কাইট্টা পড়াই ভালো। পুলিশি ব্যাপার কার ঘাড়ে কোন জুলমত আইয়া পড়ে ঠিক নাই। সাক্ষী-সাবুদ... নানা উছিলায় কে কোন দিক দিয়া জড়াইয়া পড়ে ঠিক আছে? কোট-কাচারি বড় খারাপ জিনিস...।’
এমন পরিস্থিতি সামলানোর মূল দায়িত্ব নিয়ে বাঁশখালী প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার হারিস স্যার সফেদ শুভ্র চুলদাড়ি ও লেবাস নিয়ে অতিথিবর্গের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যান। দুহাত তুলে সবাইকে বসে পড়ার সবিনয় অনুরোধ জানান এবং একটা সূরা তেলাওয়াতের আঙ্গিক টেনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন: আমার মুরুব্বি ও ভাইসব, আজ আমরা এখানে একটা পবিত্র রুসমাত উপলক্ষে সমবেত হইয়াছি। একজন সচ্চরিত্র নারী ও পুরুষ যখন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে যায়, তখন তা আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রসুলের জন্য একটি শুভ উপলক্ষ। সহীহ বোখারী শরিফের মাধ্যমে আল্লাহ তখন বয়ান করেন, ‘হে পেয়ারা বান্দাগণ অলীমার দাওয়াত কবুল করা তোমাদের কর্তব্য। ফরজ। সুতরাং আপনারা আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করবেন না। আপনাদের ওপর তাঁর দয়া বর্ষিত হউক।... বাবা চোর কি না... তা জানেন শুধু গায়েবুল মালিক। আমরা তার উছিলা অনুসারী মাত্র। সমবেত মুরুব্বিগণ... আপনারা দয়া করে বসুন... মেয়েটি নিষ্পাপ মাসুম বাচ্চা, তার কোনো দোষ নাই। কাজেই আজকের এই রুসমত অনুষ্ঠান সফল করার দায়িত্ব আপনার-আমার... আমাদের দশজনের। ইউসুফ খলিফা আর আমি সমবয়সী। এক গ্রামেই বড় হইয়াছি আমরা। তিনি খাইট্টা খাওয়া মানুষ। চুরি করার মানুষ না। তবে হ্যাঁ... সব কথা সব জায়গায় বলা যায় না। বলা ঠিকও না। তবে আপনারা জাইনা রাখতে পারেন, ইউসুফের ওই যে বাজারের দশ ফুট বাই বারো ফুটের দর্জির দোকানডার ওপর নজর পড়ছে অনেকের। তাকে তা বেইচা দিতে কয়। তার পরও আমি বলতে চাই, তিনি সব, আমরা উছিলা মাত্র। তার বিচার তিনি করবেন।’
হেডমাস্টার সাহেবের আবেগময় দরদি বক্তৃতা সুফল বয়ে আনে। আমন্ত্রিত অতিথিরা আগের মতো যে যার জায়গায় বসে পড়ে। উত্তপ্ত লঘু আলোচনা, বাগিবতণ্ডা মোটামুটি স্তিমিত হয়ে আসে এবং অনুষ্ঠান সফলতার দিকে এগিয়ে যায়।
গ্রামের জামে মসজিদের ইমাম ও কাজির দোয়া-খায়েরের মধ্য দিয়ে রুসমতের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। এর পরপরই বাড়ির উঠানে চাটাইয়ের ওপর ভাড়া করা ফরাস ও দস্তরখানা বিছানো পরিপাটি পরিবেশে খাওয়া-দাওয়ার পর্বও মোটামুটি শেষ হয়। তখন বাবার অবর্তমানে হেডমাস্টার সাহেবের প্রধান ভূমিকা ও মধ্যস্থতায় অন্দর মহলে বর-কনে দুপক্ষের ময়মুরুব্বিদের মাঝে দাঁড়িয়ে বরের হাতে কন্যা সম্প্রদান করেন। এবং এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে জামে মসজিদের হেড মাওলানা ভরপেট খাওয়ার ভারের ঢেঁকুর তুলে নবদম্পতির সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য দোয়া করেন। দুহাত তুলে। তিনি বলেন, ‘এই মাসুম মেয়েটার বাবা থেকেও আজ নেই। তাতে কী... আজ আমরাই তার বাবা-মা।’ জয়তুনকে লক্ষ করে তিনি আরও বলেন, ‘তোমার কষ্টে আজ আল্লাহর খাস-আরশ কেঁপে উঠেছে।... মা তিনিই তোমাকে দেখবেন। ভাইসব... সমবেত সবাই হাত তোলেন... নবদম্পতির জন্য দোয়া করেন... আমিন... আমিন...।’
এবার কনে জয়তুনের জামাই মুন্তুর (পুরো নাম: মমতাজউদ্দিন) বাড়ি যাওয়ার পালা। মুন্তুর বাড়ি ক্ষেতলাল উপজেলার বড়াইল গ্রামে। তা বাঁশখালী থেকে খুব একটা দূরে নয়। তবুও মুন্তু একটা ভ্যানগাড়ি ঠিক করেছিল। তা কী জন্য জানি আসেনি। রাত বাড়ছে। তখন হাঁটাপথ ছাড়া আর উপায় রইল না। গ্রামগঞ্জের হাঁটাপথ... এবড়োখেবড়ো...। হাঁটতে গিয়ে একাধিকবার হোঁচট খেয়েছে জয়তুন। পাশাপাশি চলতে থাকা মুন্তু তাকে ধরে ফেলতে গেলে সে সরে গিয়েছিল। মন্তু এতে অপ্রস্তুত হয়েছে খানিক।
কনে সেজে দীর্ঘপথ হাঁটা, তাও আবার স্যান্ডেল পরার অভ্যাস না থাকায়, নতুন জায়গার নতুন আশঙ্কা, ভয়-হতাশা সব মিলিয়ে জয়তুন রীতিমতো হিমশিম খেতে খেতে যখন জামাইয়ের সাদাসিধা বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়ায়, তখন তার শুধু বাবা-মাকেই মনে পড়তে থাকে বারবার। বাবার জন্য দুঃখে-অপমানে তার দুচোখ ফেটে জল গড়িয়ে নামে। কনের সাজে শাড়ির আঁচল চেপে তা সে ধরে রাখতে পারছিল না। সে তার বাড়ি ছেড়ে আসার সময় বাবার দেখা পায়নি। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে অনেকটা পথ ধরে সে শুধু মার বিলাপ শুনতে পেয়েছিল। একটা দূরত্বে চলে এলে সে আর তা শুনতে পায়নি।
পথ ভাঙতে রাত বেড়ে যাওয়ায় বরের বাড়ির আনুষ্ঠানিকতা সংক্ষিপ্ত করা হলো। ছেলের মা নেই। বছর দুয়েক হয় মারা গেছে। এ বাড়িতে মুরব্বি বলতে বাবা ছাড়া শুধু আছে মুন্তুর এক চাচি আর আপন বৃদ্ধা নানি। ঘরে তুলে দেওয়ার আগে তারা মধ্য উঠানে হারিকেনের বাতি জ্বালিয়ে চাটাইয়ের ওপর চাদর বিছিয়ে জামাই-বউকে বসতে দেয়। একই বাটি থেকে তারা দুজনকে গুড়ের ক্ষীর তুলে খাওয়ায়। সাধারণ নিয়মে দুলহা-দুলহানের চাঁদবদন রূপ নিয়ে যে রসিকতা-মশকরা করার কথা, তা এখানে হলো না। মুন্তুর বাবা তখন উঠানের উত্তর কোনায় জলচৌকিতে বসা। গালে হাত। এসবের কোনো কিছুতে আজ তাঁর যোগ দেওয়ার মনমানসিকতা নেই। তাঁর মনে এক বড় প্রশ্ন, কেমন এক পরিবারে ছেলের বিয়ে হলো? মেয়ের বাবা চুরির আসামি...
তারা তাড়াহুড়ো করে যেন জয়তুনকে মুন্তুর ঘরে উঠিয়ে দেয়। ঘরে ঢুকে জয়তুন দেখে, তাদের বাসর চৌকি বুনো ফুলে মোটামুটি সাজানো। এর মধ্যে শাপলা ফুলের ডাঁটাভাঙা শিকলগুলোই তার বেশি চোখে পড়ে। সে ভাবে, হয়তো মুন্তুর ছোট চাচাতো বোন কাঁচা হাতে এসব করেছে। মুন্তু সামান্য ইতস্তত করে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। তা তো দেওয়ার কথাও। কিন্তু জয়তুনের তখন মনে হচ্ছিল, তা না হলেই ভালো হতো। কেননা, আজকের এই আশয়-বিষয় নির্জন-নিরিবিলিতে কোনো উত্থাপন, কোন্ কথার গতি কোন্ দিকে গড়ায় কে বলবে? মুন্তুর সরাসরি মুখোমুখি বসার শক্তি ও মানসিকতা যে সে অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে। এরই মধ্যে মুন্তু দরজা ভেজিয়ে ধীরসুস্থে চৌকিতে বসে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে। কী বলা যায়, তা ভাবার আগেই জয়তুন সদ্য মাটি ল্যাপা মেঝেতে শাড়ির পাট না ভেঙে বসে পড়ে। অনেকটা আলুথালুভাবে। মুন্তু তাকে হাত ধরে উঠাতে গেলে জয়তুন জগদ্দল পাথরের মতো অনড় হয়ে থাকে। মুন্তু অনুনয় জানায়, ‘এইডা কেমন কতা। আমার বাড়িতে আইয়া তুমি মাটিতে... উড... জয়তুন। আমার শরম লাগতাছে...।’
জয়তুন হু হু করে কেঁদে ওঠে। কেঁদে কেঁদে বলে যায়, ‘আজকের ঘটনায় আমার যে মাথা তোলার জো নাই। আমার...আমি আপনার সাতে বই কেমনে? আমার বাবা চোর...সবার সামনে চোর অইল।’...
মুন্তু নরম সুরে কথা বলার চেষ্টা করে, ‘দেহ গো বউ আমাগোর বিয়ার প্রথম রাইত। জীবনের শুরু...। যা অইয়া গেছে তা দুর্ঘটনা...তা সত্য না। তিনি চোর অইতে পারেন না...। লক্ষ্মীসোনা বউ চৌকিতে উইড্ডা বও...।’
তাতেও তাকে অনড় দেখে মুন্তুই নেমে আসে মাটিতে। জয়তুনের গা ঘেঁষে বসে।
জয়তুন কান্না থামিয়ে অশ্রুভেজা বড় বড় চোখ মেলে চেয়ে থাকে মুন্তুর দিকে। বিশ্বাস করতে পারছিল না তার কথাগুলো। তবে সে মনেপ্রাণে চাইছিল, মুন্তুর কথাগুলো সত্য হোক। জয়তুন লক্ষ করে, মুন্তুর মুখমণ্ডল, দৃষ্টিতে মায়া-মমতা ফুটে আছে। তার মুখরেখা সহজ-সরল, কিছুটা বিব্রতও যেন।
হঠাৎ করেই জয়তুন যেন সদ্য ল্যাপা কাঁচা মাটির সঙ্গে ল্যাপ্টে থাকা গোবরের গন্ধটা প্রকটভাবে অনুভব করে। এবং তার তখন মনে হতে থাকে, তার সারা শরীরে যেন সেই প্রচ্ছন্ন ময়লার গন্ধটা ছড়িয়ে আছে। তার মনে-দেহে পবিত্রতার অভাব দেখা দেয় এবং মনে মনে তার গা-ঘেঁষে বসে থাকা সদ্য বিবাহিত স্বামীটির কাছে সে নিতান্তই ছোট হয়ে যেতে থাকে। ছোট্ট একটা বিন্দুর মতো।
দুজন অনেকক্ষণ চুপচাপ মাটির মেঝেতে বসে থাকে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। একসময় মুন্তু বিনয়ী হয়ে নীরবতা ভাঙে।
‘লক্ষ্মী বউ...জয়তুন...চলো, আমরা বিছানায় উইট্টা বই। এমুন একটা দিন...এমুন একটা রাইত আর তো আইত না আমাগোর জীবনে...এই রাইত তো আমরা আর ফিরা পাইতাম না কোনো দিন...।’
মুন্তু জয়তুনের হাত তুলে নেয় তার হাতে। জয়তুন বাধা দেয় না। মুন্তু আবার সচেষ্ট হয়।
‘লক্ষ্মী বউ...চলো, আমরা ওপরে উইট্টা বই। বিয়ের পরথম রাইত আমরা কি মাটিতে বইয়া কাডাইমু...।’
জয়তুনের হাত ধরে মুন্তু ওঠার চেষ্টা করলে জয়তুন টাল সামলাতে পারে না। মুন্তু তাকে জড়িয়ে ধরে। দুজনে উঠে বসে চৌকিতে।
জয়তুন বুনো শাপলা ফুলের গন্ধ অনুভব করতে থাকে ধীরে ধীরে। ঘর ল্যাপা ময়লার গন্ধটা যেন সরে যেতে থাকে তার গা থেকে। সে শক্তি জুগিয়ে মুন্তুর মুখ বরাবর চায়।
‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাস করতাম চাই...আপনি কি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন...আমার বাবা চোর না?’
‘তোমার বাবা চোর না...তুমি ভালো মানুষের মাইয়া।’ মৃদু কণ্ঠে মুন্তু জবাব দেয়।
‘সত্যি বিশ্বাস করেন!’ মুন্তুকে সজোরে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে জয়তুন। মুন্তুও জয়তুনকে বুকে টেনে নেয়। মুন্তুর নাক বেয়ে গরম শ্বাস বের হয়। বুকের দুকদুক শব্দ বেতালা হয়। আবার মনের কোনায় একটা সন্দেহ বাতিকের ক্ষীণ স্ফুলিঙ্গের আলো যেন উজ্জ্বলতরও হতে চায়, হতেও তো পারে জয়তুনের বাবা গরু চোর...। সে যেন আন্দাজে দেখতে থাকে, তার বাবা তখনো উঠানে বসে আছে। গালে হাত। চাঁদের আধো-অন্ধকার আলোতে।
========================
গল্প- মৌরস ভৌরস  শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম  গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'  আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং  আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'  আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক'  আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ'


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ রেজাউর রহমান


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.