গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির by ফেরদৌসী মজুমদার

মার স্কুলের অভিজ্ঞতার চেয়ে স্কুলে ভর্তি হওয়ার অভিজ্ঞতাটা অনেক বেশি। আমাদের সময় প্লে-গ্রুপ, নার্সারি এসব বিশেষ ছিল না। বড়জোর প্রথম শ্রেণী থেকে ভর্তির চল ছিল। আমাদের বাড়ির রেওয়াজ ছিল আরও ভিন্ন প্রকৃতির। আমরা ছিলাম ১৪ ভাইবোন। আমাদের কাউকেই, আমার যত দূর মনে পড়ে, বেশি নিচু ক্লাসে ভর্তি করা হয়নি।
আমাদের বাবা ছিলেন প্রচণ্ড প্রতাপ আর দাপটের লোক। যেকোনো বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। বাবাশাসিত পরিবার ছিল আমাদের, নিরীহ মা ছিলেন নীরব দর্শকমাত্র। তবে উল্লেখযোগ্য হলো, বাবার সিদ্ধান্ত অসফল হয়নি কোনো ক্ষেত্রেই।আমাদের স্কুলের ব্যাপারে তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। নামকরা স্কুল হলেই ভালো ফল হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তিনি বলতেন, বাড়িই হলো সবচেয়ে ভালো স্কুল। কাজেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতিটাই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা—সব বেলাতেই আমাদের কিছু না কিছু পড়ালেখা করতে হতো। আমার এক বোন (কণা আপা, আজ আর নেই) একবারেই একটি স্কুল থেকে প্রাইভেটে টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তার পরে স্বাভাবিক নিয়মে ম্যাট্রিক, আইএ, বিএ, এমএ ইত্যাদি করেছেন।আমিও ভর্তি হয়েছিলাম একবারেই পঞ্চম শ্রেণীতে। ওয়ারীর টিকাটুলীর ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ ছিল আমার প্রথম স্কুল। তারপর মুসলিম গার্লস স্কুল। আমাদের আদি বাড়ি ছিল ঢাকার সেন্ট্রাল রোড, হাতিরপুলে। আসলে আমার বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই, সেন্ট্রাল রোডে। আজও আমি সেন্ট্রাল রোডেই আছি। বাবার চাকরির বদলের কারণে অবশ্য বিভিন্ন অঞ্চলে গেছি, সেটা অনেক ছোট্ট বয়সে।সেন্ট্রাল রোড থেকে সুদূর ওয়ারী যাওয়ার প্রধান কারণ ছিল, ওখানে আমার সবচেয়ে বড় বোন নাদেরা বেগমের শ্বশুরবাড়ি; ওটা আমার ছোট খালার বাড়িও বটে। নাদেরা আপাই আমাকে ওখানে ভর্তি করিয়েছিলেন। ভর্তিপরীক্ষার দিনটির কথা কখনো আমি ভুলব না। ভারি মজার! আমি আর আমার খালাতো বোন লিলিকে বসানো হয়েছে পাশাপাশি ভর্তিপরীক্ষার জন্য। ইংরেজি ভাষায় আমার বেশ আগ্রহ ছিল এবং দখলও ছিল খানিকটা। লিলি আর আমি, বোন ও বন্ধু দুটোই ছিলাম। আমাদের দুটো অনুচ্ছেদ এসেছিল পরীক্ষায়—বাংলা থেকে ইংরেজি করা এবং ইংরেজি থেকে বাংলা করা। বাংলায় কী ছিল, আমার ঠিক মনে নেই। অনুবাদে আমি লিলিকে দরাজ দিল হয়ে দেখাচ্ছিলাম এবং বলে দিচ্ছিলাম।লিলি অঙ্কে বেশ ভালো ছিল। আর আমার ছিল অঙ্কের ব্যাপারে প্রচণ্ড ভীতি। তাই আমি প্রথম থেকেই লিলির খাতাটা দেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু হতবাক হয়ে দেখলাম, লিলি হাত দিয়ে ওর খাতা ঢেকে লিখছে এবং আমাকে মোটেও সাহায্য করছে না। আমি রাগে-দুঃখে ভ্যা করে কেঁদে ফেললাম। পরীক্ষক যিনি ছিলেন, আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, তিনি ছিলেন জ্যোতিদি। ভীষণ কড়া শিক্ষক। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অ্যাই মেয়ে, কাঁদছ কেন?’ আমি সরলভাবে বললাম, ‘ও আমাকে কিছুই দেখাচ্ছে না। আমি তো ওকে সব দেখিয়েছি।’ শোনা মাত্রই সে কী হাসির রোল! জ্যোতিদি এবং আরও একজন শিক্ষক আর কিছু পরীক্ষার্থী আমার এহেন অপ্রত্যাশিত উত্তরে হাসি আর থামাতে পারছিলেন না।ভাবি, কী সরল আর কী বোকাই না ছিলাম আমি। এখনো অবশ্য আছি। সে দিনের আরেকটা ঘটনার কথা ভাবলে এখনো আমার হাসি পায়।বহু দিন পর্যন্ত, বলতে গেলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আমার মাথা ন্যাড়া ছিল। সে সময় আমরা মোটেও সৌন্দর্যসচেতন ছিলাম না। যখনই মা-বাবা চেয়েছেন, অসুখবিসুখের কারণে বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কারণে মাথাটা পরিষ্কার করে চেঁছে দেওয়া হয়েছে। তাতে আমার কোনো খেদ বা আপত্তি বা ভ্রুক্ষেপ ছিল না।আমি পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হতে গেছি। সেদিন আমার একমাথা ঘন কালো খোঁচা খোঁচা চুল ছিল। আমি ছেলে না মেয়ে, এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে রসাল আলাপ-আলোচনা চলছিল। তাঁদের কথা সবই আমার কানে যাচ্ছিল। একসময় জ্যোতিদি আমার কাছে এসে আমার মাথাটা ঝুঁকে দেখলেন এবং অকস্মাৎ বলে উঠলেন, ‘একি! এর মাথায় দুটো পাকা চুল কেন? একেবারে কদম ফুলের মতো লাগছে।’ব্যস, হয়ে গেল। আবার আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। এমন পরিস্থিতিতে হাসি চাপাতে গিয়ে শিক্ষকদের বেহাল অবস্থা। তাঁদের হাসি আর আমার কান্না, কোনোটাই থামছিল না।যা হোক, ফল বেরোল। আমি ভর্তিপরীক্ষায় পাস করলাম এবং ভর্তি হয়ে গেলাম। ভর্তিপরীক্ষার পর নাদেরা আপার বাড়িতে গেলাম প্রশ্নপত্র দেখানোর জন্য। নাদেরা আপা ইংরেজি সাহিত্যে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তাঁর আগ্রহ ছিল, ইংরেজিটা আমি কেমন করলাম, তা জানার। দুটো বাংলা বাক্য বা বাক্যাংশ ছিল, যার ইংরেজি করতে দেওয়া হয়েছিল—‘আকাশ নীল’, অন্যটা ‘নীল আকাশ’। আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমার ইংরেজি অনুবাদ অবশ্যই ঠিক হয়েছে। তাই নাদেরা আপা যখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আকাশ নীল’-এর ইংরেজি কী করেছিস? বললাম, ‘দ্য স্কাই ইজ ব্লু’, উনি খুশি হলেন এবং বললেন আর ‘নীল আকাশ’ কী লিখলি? বেশ সগর্বে এবং আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে বললাম, কেন, ‘দ্য স্কাই ইজ ব্লু’। আপা বললেন, ‘বোকা, দুটোই কি এক হতে পারে? ‘নীল আকাশ’-এর ইংরেজি অবশ্যই ‘দ্য ব্লু স্কাই’। এখনো সব মনে আছে। জীবনেও এ ধরনের তুচ্ছ ভুল আর হবে না।স্কুলের দু-চারটা ঘটনা বলতেই হচ্ছে। আমাদের বাংলা ব্যাকরণের জন্য পণ্ডিতমশাই ছিলেন। একটুখানি বিশেষ্য, বিশেষণ পড়িয়ে তিনি চেয়ারে বসে ঝিমোতেন। আমার মনে আছে, এ ফাঁকে আমরা দু-তিনজন পাঁচগুটি খেলতাম, বসেই—‘ফুল ফুল, ফুলটিএকেতে দোলিট।শুষম্, শুষম্, শুষমটিএকেতে জোর শুষমটি।কদম, কদম, কদমটিএকেতে জোর কদমটিবকুল, বকুল, বকুলটিএকেতে জোর বকুলটি’সব শেষে ছিল—‘তারিঝাম, তারিঝাম, তারিঝামটিএকেতে জোত্তারি ঝুপ।’বলে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় যেই গুটিটা ওপরে উঠাত, সেটা ধরার আগেই কেউ ধরে ফেললে, সে আউট হয়ে যেত। আমি সে কম্মটি করতে গিয়ে আমার বন্ধু মায়াকে এমন থাবা দিয়েছি যে সে পেছনের ব্ল্যাকবোর্ডে পড়ে গেল। ওর চশমা গেল ভেঙে। চোখমুখ কেটে রক্তে মুখ ভেসে যাচ্ছিল। ভয়ে আমি কেঁদে ফেললাম। আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মিসেস নন্দী, ড. নন্দীর স্ত্রী। ভারি ভালো ছিলেন। অন্য শিক্ষকেরা ধরাধরি করে মায়াকে মিসেস নন্দীর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ওকে সারিয়ে তোলা হলো। সে যেদিন একদম ভালো হলো, সেদিন আমার অপরাধবোধ ঘুচল। সে কী মহা শান্তি! ভাগ্যিস, মিসেস নন্দীর বাড়ি কাছে ছিল। নয় তো কী হতো! এমনি আরও কত কত স্মৃতি আছে!
=====================
স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'  আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং  আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'  আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক'  আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা'


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ ফেরদৌসী মজুমদার


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.