ইসলাম মানবসেবার কথা বলে by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

সব ভেদাভেদ ভুলে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে ইসলামের অনুপম আদর্শ রয়েছে। ইসলাম ধর্মে সৃষ্টিজগতের সেবা একটি মহৎ কাজ। সৃষ্টিকর্তার ওপর ঈমান আনার পর মানুষের সর্বোত্তম ইবাদত মানুষকে ভালোবাসা; আর সবচেয়ে বড় গুনাহ হচ্ছে মানুষকে দুঃখ-কষ্ট দেওয়া। মুসলমান-খ্রিষ্টান-হিন্দু-বৌদ্ধসহ যত ধর্মাবলম্বী আছে, সব মানুষই অন্য মানুষের ভাই। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের একজন নর ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর আমি তোমাদের অনেক সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
স্রষ্টাকে পেতে হলে ধর্মপ্রাণ মানুষের অন্তরে মানবপ্রেম থাকা চাই। অহিংসা, শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধনের জন্য চাই মানবপ্রেম। আগ্রাসী মনোভাব অন্তরে পোষণ করে লোক দেখানো মানবসেবা বা ইবাদতে প্রকৃত খোদাপ্রেমিক হওয়া যায় না। হিংসা-বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানির পরিবর্তে যে অন্য মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে, সে-ই ভেতরে-বাইরে বড় মাপের মানুষ হতে পারে এবং দয়াময় তার ওপর অশেষ রহমত বর্ষণ করেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘রাতের আঁধারে বা দিনের আলোতে যা কিছু করো অথবা মনের গহিনে বা গোপনে করো বা প্রকাশ্যে করো, আমি সবই জ্ঞাত, এসব কিছুরই হিসাব নেব।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৮৪)
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মানুষ, পশুপাখি, বৃক্ষলতা—সব কিছুকেই নিঃস্বার্থভাবে অন্তর থেকে ভালোবেসেছেন এবং সৃষ্টিকে ভালোবাসার মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্য অর্জন করেছেন। তিনি আল্লাহর প্রিয় বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও কঠিন পরিশ্রমের হাল ছাড়েননি, দুর্বলের হক বা অধিকার নষ্ট করেননি, অসহায়ের সহায় হয়েছেন, সহস্র বাধা-বিপত্তিতেও সত্য-সুন্দর-ন্যায়ের পথেই তিনি সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চলার পথে যে দুষ্ট মহিলা কাঁটা ফেলে রাখত, সেই বুড়ির অসুস্থতায় তার খেদমত করে নবীজি মানবসেবার পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। পিতা-মাতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, নিঃস্ব, বিপদগ্রস্তদের নিঃস্বার্থভাবে মমতার বশে ভালোবাসার অর্থই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসা। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি মানুষের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ নয়।’ (তিরমিযি, আবু দাউদ)
আল্লাহ তাআলা মানুষের ধনসম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, ক্ষমতা, বংশ, রূপলাবণ্য দেখেন না, দেখেন কোন প্রেমিক বান্দা তার সাধ্যানুযায়ী মানবসেবা করছে। তাই স্রষ্টার সন্ধান পেতে হলে মানুষকে ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই। আর্তমানবতার সেবায় যাঁরা এগিয়ে আসেন বা যাঁদের দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়, তাঁরাই মূলত মানবসেবক। মানুষ যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দলমতের অনুসারী হোক না কেন, তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার করা মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটেছে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১১০)
মানবতাবাদী ধর্ম ইসলাম সর্বাগ্রে মানুষকে মানুষের প্রতি মমত্ববোধের শিক্ষা দেয়। ইসলাম মনে করে, আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি হলো বিশ্বমানবতার সৌন্দর্য। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী মানুষে মানুষে সম্পর্ক যত সহনশীল, সম্প্রীতিময় ও মানবীয় হবে, সমাজে ততই সুখ-শান্তি ও নিয়ম-শৃঙ্খলা বিরাজ করবে। প্রতিটি মানুষেরই সমাজের প্রতি কিছু করণীয় রয়েছে। কোনো একজন মানুষ দুঃখ-কষ্টে পড়লে বা বিপদগ্রস্ত হলে অন্যরা তার দুঃখে দুঃখিত বা ব্যথিত হলেই চলবে না, বরং তার দুঃখ-কষ্ট লাঘবের বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। যে মানুষের প্রতি সদয় হবে, আল্লাহও তার প্রতি সদয় হবেন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী সব জীবের প্রতি দয়া করো, আল্লাহও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (মিশকাত)
আল্লাহ তাআলা মানুষকে ধৈর্য ও ঈমান পরীক্ষা করার জন্য নানা রকম বিপদ-আপদে পতিত করেন। তিনি মানুষের মধ্যে কাউকে জ্ঞানী, বিত্তশালী ও সক্ষম করেছেন; আবার কাউকে করেছেন স্বাভাবিক কর্ম সম্পাদনে অক্ষম বা প্রতিবন্ধী, দুস্থ-পীড়িত, দীন-দুঃখী। তিনি দেখতে চান সক্ষম লোকেরা অক্ষমদের জন্য কাঁদে কি না।
মানবসেবার জন্য অনেক ধনসম্পদের দরকার নেই, দরদি ও বিশুদ্ধ মনের প্রয়োজন। প্রতিটি শ্রেণীর ও পেশার মানুষ তাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকেও সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে মানবসেবা করতে পারে। একজন ব্যবসায়ী যদি মানুষকে ওজনে কম ও মালামালে ভেজাল না দেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অহেতুক দ্রব্যমূল্য না বাড়িয়ে সঠিক দামে পণ্য বিক্রি করেন অথবা চিকিৎসক যদি ভিজিট কম নিয়ে গরিব রোগী দেখেন—এটাই মানবসেবা। মানুষ যদি বিশুদ্ধ নিয়তে অন্তর দিয়ে অন্য একজন মানুষকে ভালোবাসে, তার কল্যাণে কাজ করে, তাহলে আল্লাহ তাকে আরও অধিক ভালোবাসেন; সত্য-ন্যায় ও সুন্দরের পথে চলার শক্তি জোগান এবং তাকে তাঁর আরশের ছায়াতলে স্থান দেন। অতএব, সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে জগতে মানুষ মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে, সৎপথের সন্ধান দেবে, ক্ষুধার্তের ক্ষুধা মেটাবে, তৃষ্ণার্তকে পানি দেবে, আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দেবে এবং অসুস্থ ও অসহায় দুর্বলের প্রতি মানবসেবার হাত বাড়িয়ে দেবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.