গল্প- 'গন্না' by তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ পর্যন্ত অস্ত্রটি সে সংগ্রহ করতে পারল। একটি ছোট্ট পিস্তল। ০.৩২ বোর। ছ'টি বুলেট। এমন নয় যে, অর্থের অভাবেই সংগ্রহের কাজটি আটকে ছিল এতদিন। আসলে বিনিয়োগের পরেও কিছু কাজ থাকে। তার ক্ষেত্রে ছিল, কারণ সে সম্পূর্ণ বৈধভাবে অস্ত্রটি চেয়েছিল। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষার জিনিস। অতএব, সেটি হাতে পেয়ে সে খুশিতে শিস দিল। দোয়েলের ডাক অবিকল সে অনুকরণ করতে পারে। এবার গরম দুধে শুকনো ফল আর ভুট্টা শস্যের কুচি ফেলে, এক চামচ চিনি মিশিয়ে খেয়ে নিল। একটি ঢোলাঢালা ট্রাউজার পরল, যার মস্ত মস্ত পকেটে অস্ত্র এবং প্রয়োজনীয় নানা বস্তু নেওয়া যায়। রুমাল, ওডিকোলনে ভেজানো টিসু্য পেপারের প্যাকেট। অপরিচ্ছন্নতা সে বরদাস্ত করতে পারে না।
পথে বেরিয়ে তার একজন জনপ্রিয় নায়কের কথা মনে পড়ল, যার নাম শ্রীঅমিভাত বচ্চন। বহু চলচ্চিত্রে এমনই অস্ত্র পকেটে নিয়ে ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে রাগী পদক্ষেপে হেঁটে গেছেন তিনি। এমত স্মরণে তার হাসি পেল। অস্ত্র হাতে পেলে মানুষের মধ্যে নায়কোচিত হাবভাব প্রকাশ পায়। তার ক্রোধ গনগনে ছিল না। তবু সে ভারি গায়ে হাঁটতে লাগল।
স্টেশনে পেঁৗছে শহরতলিমুখী একটি ট্রেনে চাপল সে। বসার জায়গাও পেয়ে গেল। হকারের কাছ থেকে একটি খবরের কাগজ কিনে মন দিল। আজকাল বাংলায় অনেকগুলো খবরের কাগজ। প্রত্যেকটিই দাবি করে যে, এ নিরপেক্ষ, স্পষ্টবাদী। ফলে, নিরপেক্ষতার দায়ে একটিই খবর বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। এতে তার সত্য সম্পর্কে ধারণা বিভ্রান্ত হয়। ন্যায় সম্পর্কেও। সে নিজস্ব ন্যায়বোধ এবং সত্যদর্শন বিষয়ে বিভ্রান্তি পরিবর্জন কাম্য বোধ করে।
গন্তব্যে ট্রেন পেঁৗছলে সে নেমে যায় খবরের কাগজটি ফেলে রেখে। একটি রিকশা নিয়ে বলে, গগন পাড়-ইয়ের বাড়ি চেনো? বিধায়ক? রিকশাওয়ালা বলে, কে না চেনে? সে রিকশায় উপবেশন করে চারপাশ দেখতে দেখতে যায়। এখানে তার ছোটবেলার অনেকখানি কেটেছে। সেইসব দেখা ছবি কিছু মেলে, কিছু নয়। যা অবধারিত, তাই হয়েছে। আরও বেশি দোকানপাট। আরও মানুষ। আরও রিকশা। আরও আধুনিক বাড়িঘর। অবশেষে গগন পাড়-ইয়ের গৃহে পেঁৗছে সে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দেয়।
বিধায়কের গৃহে সারাক্ষণ লোকলস্কর থাকে। সে গগন পাড়-ইয়ের প্রধান পাশর্্বচরকে চিনতে পারল। ছাত্র সংগঠনে গলাবাজি করত। তাকেই বলল, স্যারকে বলুন, গণনাথ এসেছে।
সঙ্গে সঙ্গেই তার ডাক পড়ল। গগন পাড়-ই নির্দেশ দিলেন, যত প্রয়োজনীয় কাজই থাক, এখন যেন তাকে বিরক্ত না করা হয়। গণনাথ নিজেই দরজা বন্ধ করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধ অধিকার করল তাকে। কিংবা বিপুল দুঃখ।
কলেস্নালই ছিল প্রথম, বালক বয়সে যার সঙ্গে তার স্থায়ী বন্ধুত্ব ও ভালবাসা গড়ে ওঠে। এক সন্ধ্যায় সে স্কুলের মাঠে কলেস্নালকে ক্লিষ্ট ও রোদনশীল দেখতে পায়। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, তার কেবল মলবেগ আসছে এবং পায়ুদ্বারে অসহ্য যন্ত্রণা। সে বলে, বাড়ি চল। তোর মা তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। কিন্তু কলেস্নাল শিউরে বলে, তা হলে অঙ্কে ফেল করিয়ে দেবে।
'কে'?
গগন স্যার।
সে আবিষ্কার করে কলেস্নালের রক্তাক্ত পায়ুদ্বার। অতঃপর গগন স্যারের কর্ম সে লুকিয়ে দেখে এবং অঙ্কভীতি তার অন্তরে চিরস্থায়ী হয়ে যায়। আর কলেস্নাল, যে ছিল ফর্সা চিকন
টুকটুকে ঠোঁট-সে ক্রমশ রোগা ও কালো হয়ে যেতে যেতে একদিন পুকুরে ভাসমান দ্রষ্টব্য হয়। সেদিন গননাথ এই প্রতিজ্ঞাই করে যে, বড় হলে সে একটি অস্ত্র সংগ্রহ করবে।
সেই অস্ত্র এখন তার পকেটে। সে বলে, 'তা হলে আলোচনায় ফেরা যাক স্যার'। গগন পাড়-ই বিধায়কোচিত গম্ভীরে বলেন, আপনি আমার কোন গোপন বিষয় জানেন? আমি এমন কিছু করিনি যা দিয়েঃ তার কথার মাঝপথে হাত তোলে সে, বলে আপনি না, তুমি, স্যার। আমি আপনার ছাত্র ছিলাম।
'হবে। কত বছর পড়াচ্ছি সবাইকে চিনতে পারা সম্ভব নয়'।
'স্যার, কলেস্নালকে মনে পড়ে'?
'কলেস্নাল? কোন কলেস্নাল'?
'ওই যে স্যার পড়ানোর নাম করে যাকে আপনি বলাৎকার করতেন'।
'কী যা তা বলছ। কে তুমি এত বড় স্পর্ধা'।
'আমি নিজে দেখেছি স্যার। আপনার পায়ুসঙ্গম। কলেস্নালকে শাসাতেন অঙ্কে ফেল করিয়ে দেবেন। সেই থেকে আমিও অঙ্কে গাড্ডু মেরে দিলাম। ছোটরা খুব ভিতু আর বোকা হত তখন'।
'সব বনানো। সব মিথ্যে কথা। কোনও প্রমাণ নেই'।
'প্রমাণের কী দরকার। এখানে তো আমি আর আপনি। আমি তো আদালতে যাচ্ছি না।
কলেস্নালকে কেন মারলেন স্যার'?
আমিঃআমি মারিনি ওটা দুর্ঘটনা।
'সে যাকগে ও তো মরেই ছিল। মরা ছেলে মেরেছেন, বেশ করেছেন। এবার উঠুন'।
'অঁ্যা'?
সে পিস্তল বার করে। গগন পাড়-ইয়ের ঘাড়ে চেপে ধরে। শরীরের নিম্নভাগ বেআব্রু করে দেয়। পাড়-ইয়েরই পোশাক দিয়ে ভাল করে মুখ বাঁধে। একটি নামি উৎপাদক সংস্থার ফিনফিনে ধারাল বেস্নড বার করে পাড়-ইয়ের আধখানা পুরুষাঙ্গ কেটে নেয়। প্রথমে ফিনকি দিয়ে পরে গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। ফিনকি ধারায় হাতে রক্ত লেগেছে। এবার পাড়-ইয়ের কানে পিস্তল ধরে সে। গুলি করে। কাজ শেষ।
পাড়-ইয়ের জামাতেই ভাল করে রক্ত মোছে সে। তারপর ওডিকোলনে ভেজা টিসু্য পেপারে ভাল করে হাত মুছে নেয়। অপরিষ্কার সে বরদাস্ত করতে পারে না। বেরিয়ে পড়ে। পাশর্্বচরের সঙ্গে দেখা হলে বলে, 'স্যার বললেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আরো আধঘন্টা যেন তাকে কেউ বিরক্ত না করে'।
।। ২ ।।
অসীম কেউই ছিল না তার। না বন্ধু, না অগ্রজপ্রতিম। সহপাঠিনী শিপ্রার প্রেমিক ছিল ছেলেটা। মাঝে মাঝে সে শিপ্রা ও অসীমের প্রেমের চিঠি আনা-নেয়া করে দিয়েছে। অসীমের চিঠিগুলি শিপ্রা তাকে পড়াত। কতই না আবেগপূর্ণ কথা তাতে। 'শিপ্রা, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না'। এই বাক্যটি অমোঘ নির্দেশে সে লিখতই প্রতিবার। সে কি বুঝেছিল, শিপ্রা তাকে ছেড়ে যাবে?
আকস্মিকভাবে জড়িয়ে যাওয়া সেই ঘটনা প্রবাহে কোনও ব্যতিক্রম ছিল না। শিপ্রার বিবাহের সম্বন্ধ দেখা হচ্ছিল। সে এতই কৃত্রিম দুঃখের সঙ্গে বলে যে বাড়িতে তাকে পাত্রস্থ করার জন্য জোর করছে, সে বড় কষ্টে আছে-যে গননাথ একজন সাধারণ তরুণ হূদয়েও সেই কৃত্রিমতা ধরতে পেরে যায়। বলে বসে, তোর গলা শুনে মনে হচ্ছে না, কষ্টে আছিস। শিপ্রা রেগে বলে, 'অসীম কেরানির চাকরি খুঁজছে। আজ রেলের পরীক্ষা, কাল সরকারি জনকৃত্যক, পরশু কোন স্কুলঃ এদিকে পাত্র প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। তফাৎটা বুঝবি না'?
তফাৎ কে না বোঝে? কিন্তু প্রেম চিরকাল অবুঝপনায় অনন্য। গননাথের গৃহে, অসীম ও শিপ্রার দেখা হলে তার সামনেই অসীম শিপ্রার পায়ে মাথা রেখে অবিচ্ছেদ ভিক্ষা চায়। অশ্রুতে প্রেমিকার পদতল ভিজিয়ে দিয়ে বলে 'শিপ্রা তোমাকে ছাড়া বাঁচব না'। গননাথ যদি শিপ্রা হত, ওই অশ্রুমুখী প্রেমে সম্পূর্ণ ডুবে যেত, তক্ষুণি রাজি হত বিবাহে। শিপ্রাও রাজি হল। সেও ক্রন্দনচর্চিত স্বরে বলল, 'ওঠো অসীম। আমিও তোমাকে ছাড়া বাঁচব না'। সে ঠোঁট রাখল অসীমের এলোমেলো চুল ঢাকা কপালে। ঠিক হল, লুকিয়ে বিবাহ নিবন্ধীকৃত থাকবে।
নির্দিষ্ট দিনে, নির্ধারিত স্থানে ও সময়ে সেও গেল সাক্ষী দিতে। শিপ্রা এল না। অসীম এক কথার মানুষ। ঘরে ফিরে বিজলি পাথায় দড়ি টেনে ঝুলে পড়ল। মড়া-কাটা ঘর থেকে শ্মশান পর্যন্ত সে অসীমের সঙ্গে সঙ্গে ছিল। অসীম আত্মনাশের কারণ দর্শিয়ে যে চিরকুট রেখে যায় তাতে লেখা ছিল, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। অসীমের মরদেহ পুড়তে থাকলে সে সংকল্প করে, উপার্জনক্ষম হলে অবশ্যই সে একটি অস্ত্র খরিদ করবে।
সে শিপ্রাকে ফোন করে বলে, শিপ্রা, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। ওপারে শিপ্রার ত্রস্ত স্বর শোনা যায়, কে আপনি? কী চান? সে বলে, ভয় পেলি নাকি? ভাবলি অসীমের ভূত? আমি গন্না। গণনাথ। চিনতে পারলি?
ওঃ বব্বা! গন্না তুই! এতকাল পরে এসব কী অসভ্যতা?
একটু কথা ছিল।
কী কথা?
'অসীম একটা কথা তোকে বলতে বলেছিল'।
'দ্যাখ গন্না, কবেকার কী ব্যাপার, ছেলেমেয়ের মা হয়ে গেলাম। এখন এসব কথার কোনও মানে হয় না। আমি রাখছি'।
'রাখিস না। তা হলে আবার ফোন করব। কত আর আগেকার ব্যাপার? একটা কথাই তো শুধু। অসীম নিজে তো আসছে না। আর কেউ জানবে না। তুই কখন একটু একলা থাকিস বল'।
'আয় তবে দুপুরের দিকে। এই ধর একটা। বেশিক্ষণ সময় পাবি না কিন্তু'।
'দরকার নেই'।
দুপুর একটা। এখনও এক ঘন্টা সময়। সে একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে। সুস্বাদু চিনে খাবার খায়। তারপর ধীরে-সুস্থে শিপ্রার বাড়িতে যায়। চমৎকার বাড়ি। দিব্যি সাজানো- গোছানো। তার বেশ পছন্দ হয়। সে একখানা চুরুট ধরায়। শিপ্রা একটু কেশে বলে, 'ইশশ এসব কী খাচ্ছিস'? কী বিচ্ছিরি গন্ধ!' সে বলে, 'কাজে লাগে। বাচ্চারা কোথায়'।
'নার্সারিতে দিয়েছি। আয়া আনতে গেছে। যা বলবি বলে ফেল'।
'বলব। এক গস্নাস জল দে'।
শিপ্রা জল আনার জন্য ওঠে। দরজার দিকে যায়। সে পছন থেকে শিপ্রাকে ধাক্কা মারে। শিপ্রা পড়ে যায়। সে শিপ্রাকে চিৎ করে বুকে হাঁটু চেপে বসে। কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, 'চ্যাচালেই গুলি করব'।
ঘটনা এতই অপ্রত্যাশিত যে, শিপ্রা এমনিতেই হতবাক হয়ে গেছে। তাছাড়া তার পিঠে ব্যথা করছে। এবার আতঙ্কে চোখে জল এল। গণনাথের হাটুর নীচে যন্ত্রণা পাচ্ছে দুটি স্তন। গণনাথ এক হঁ্যাচকায় শিপ্রার দোপাট্টা নিয়ে বেঁধে ফেলল হাত। স্তন কিংবা যোনি তাকে প্রলুব্ধ করল না। সে শক্ত হাতে শিপ্রার চোয়াল চেপে ধরল যাতে ঠোঁট ফাঁক করতে না পারে এবং ঠোঁটে চেপে ধরল জ্বলন্ত চুরুট। ঠিক যেভাবে শিপ্রা ওই ঠোঁট অসীমের কপালে চেপে ধরেছিল। শিপ্রার কাঁপতে থাকা, জল ভরা চোখ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে বলল, 'অসীম বলেছিল- তোকে ছাড়া বাঁচবে না। যা, অসীমের কাছে যা। কপালে গুলি করল। হাতে শিপ্রার মুখের লালা লেগেছিল। আর ঘাম। টিসু্য পেপারে ঘষে ঘষে মুছে ফেলল। ময়লা সে সইতে পারে না।
।। ৩ ।।
পুলকেশদার মাকে সে প্রথম দেখে এক বিজয়া দশমীর সকালে। তিনি দুর্গাবরণ করছিলেন। সাদা শাড়িতে চওড়া লাল পাড়। কপালে রাঙা টিপ। ছোটখাটো মানুষটিকে দেখে তার মনে হয়েছিল শ্রীমতী লক্ষ্মী বৃদ্ধার বেশ নিয়েছেন। অথবা বৃদ্ধাও যেন নয়। বয়স তাকে ছুঁয়েছে কেবল। শ্রী কাড়তে পারেনি। পুলকেশদা সেবার দুর্গাপূজা সমিতির প্রধান। আর শুধু সেবারই কেন, গত কয়েক বছর ধরেই তিনিই প্রধান। লোকে জানে, পুলকেশদা দায়িত্ব নিতে ভালবাসেন।
একদিন সে পথ দিয়ে চলেছে সাইকেলে চেপে। তার আগে আগে অন্য এক মহিলার সঙ্গে মাসিমা। এই বয়সেও কত চুল। পাকা চুল, মস্ত খোঁপা। মাসিমা মহিলাকে বলছেন, আর পারিনা। উনি পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন চার বছর, সে কি আমার দোষ? চিকিৎসার নাম করে করে আমার সব গয়না নিয়েছে। সেদিন গলার হারটা ধরে টানে। এই দেখো, এত শক্ত করে ধরেছে আমার হাত, কালশিটে পড়ে গেছে। সেদিন কালীবাড়িতে গেছিলাম
পুজো দিতে। বউমাকে বললাম, ওঁকে খাইয়ে দিয়ো। সব তো আমিই করি। কারওকে ময়লা ধুতে হয় না। একটু খাওয়াবে না? এসে দেখি, ওর ঠোঁটের আশেপাশে কেটে কেটে গেছে। আকারে ইঙ্গিতে বললেন, গিলতে দেরি হচ্ছিল বলে চামচ দিয়ে গুঁতিয়েছে। এরা কি মানুষ? নিজের ছেলে বউ, তার সম্পর্কে আর কাকে বলব?
এর বছর দুয়েক পরে সে হঠাৎ বড় স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে মাসিমাকে দেখতে পায়। কালো পাড় সাদা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছেন। চাইছেন না। নীরব ভিক্ষাবৃত্তি তার। দেশে সে চেঁচিয়ে ওঠে, মাসিমা আপনি এভাবে। মাসিমা দ্রুত ভিড়ে সেঁধিয়ে যান। সে খোঁজ নিয়ে জানতে পায়, পিতার মৃতু্যর পর পুলকেশদা বাড়িখানি নিজের নামে লিখিয়ে নেন, বাড়ি সারানোর নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নেবার অছিলায় মাসিমা কি মতলব বোঝেননি? সে আর কে বলবে। তিনি অতঃপর তুচ্ছ বাদানুবাদের পরিণামে বিতারিত হন।
তার কি আর কোথাও যাবার ছিল না। কারও কাছে? পৃথিবী কি এতই একলসেরে? স্বার্থপর? সে ভেবেছিল, মাসিমাকে খুঁজে পেতে জোর করে ধরে আনবে গৃহে। কিন্তু তার আগেই রেলপথের পাশে মাসিমাকে পাওয়া যায় ধর্ষিত ও মৃত। অন্তত পঁয়ষট্টি বয়সী শ্রীমতী কমলা বিবস্ত্র ছিলেন।
সে মাসিমাকে চিনতে পেরে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। অতঃপর প্রয়োজনীয় অস্ত্রের মূল্যমান নিয়ে চিন্তার সূচনা করে।
সে জানে, পুলকেশ তাকে চেনেন না। সুতরাং পরিচয় দেবার কোনও চেষ্টাই না করে সে সরাসরি বলে, রেল পুলিশকে আপনার ঠিকানা আমিই দিয়েছিলাম। নইলে শরীরটা রেলের মড়া কাটা ঘরে পচত। ইঁদুরে খেত। মর্গের ইঁদুর দেখেছেন? দেখেননি। মানুষের মাংস খায়। মানুষের মতোই হিংস ।
অঁ্যা পুলকেশ চমকে ওঠেন। সে বলে, খবরটা আপনাকেই দিতে চেয়েছিলাম। শুনলাম একলাই আছেন, বাড়িতে। বউদিরা কোথায়?
ও ওর বাপের বাড়িতে। আপনি কে?
আমি গন্না। গণনাথ।
আপনাকে কি আমি চিনি?
না। আমি আপনাকে চিনি। তবে একেবারেই কি দেখেননি? মনে নেই। কই, বার করুন।
কী?
ধর্ষিতা ও খুন হাওয়ার আগে মাসিমা আপনার হাতে একটা জিনিস দিতে বলেছিলেন।
কী? মানে মার সঙ্গে দেখা হত আপনার?
হয়েছিল। ওই যে ওর গলার হার ছিনিয়ে নেবার জন্য আপনি এক হাতে কালশিটে ফেলে দিয়েছিলেন- সেই হাত পেতে ভিক্ষে প্রার্থনা করছিলেন।
দেখুন এতে আমার কোন দোষ নেই। মাকে কি আমি সত্যি চলে যেতে বলেছিলাম?
না শুধু তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিন, বেশি সময় নেই। হাত পাতুন।
আমি আর এক মিনিটও আপনাকে দেব না। আপনার মতলবটা কী? যা দেবার দিয়ে চলে যান।
সে ওঠে পিস্তল ঠেকিয়ে দেয় বুকে। একটি সরু নাইলনের দড়িতে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধে। কাপড় গুঁজে দেয় মুখের গহ্বরে। এবার ধীরে সুস্থে আঙুলের ডগা আর নখরের খাঁজে আলপিন ফোটাতে থাকে একটি দুটি তিনটি।
লোকটা কাঁপছে। চোখ থেকে জল পড়ছে। সে নাভিতে পিস্তল রাখে। গুলি করে।
।। ৪ ।।
নয়নের বাড়িতে গেলে নয়নিকা তাদের চা দিয়ে যেত। পরিচয় বলতে ব্যস এইটুকুই। বড় বড় চোখ, দুটি মোটা বিনুনী, ফর্সা হাত। বোনেদের যেমন হওয়ার কথা ঠিক সেইরকম। তারপর দেখা নিউ মার্কেটে। নয়নিকা না ডাকলে সে চিনতেও পারত না। শীর্ণ, পাঁশুটে নয়নিকার শাড়ির নীচে ফোলা তলপেট, বোধহয় বাচ্চা আছে পেটে। আগে ছিল নয়নিকা শেঠ, এখন হয়েছে নয়নিকা ভুতোরিয়া। অতএব, সে বলে, এ কি চেহারা হয়েছে তোমার নয়নিকা? তুমি ভাল আছ। নয়নিকার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। হাত চেপে ধরে তার। বলে, গণনাথদাদা কী আনন্দ হচ্ছে। কতদিন আপনার লোকের সঙ্গে দেখা হল!' সে, এই গভীর আন্তরিক স্পর্শে ভুলে যায়, নয়নিকার সঙ্গে সেরকম কোনও সম্পর্ক ছিল না। বন্ধুর বোন। প্রেমে না পড়লে বোনই থেকে যায়। আজ, দীর্ঘ অদেখার শেষে, সেই ক্ষীণ পরিচয়ের রেশ আপনি জমে জমে আকার ধারণ করেছে গোপন গুহায় থাকা স্ট্যালাগটাইটের মতো। সে 'তুমি থেকে তুই' করে নেয় এ স্পর্শকে। বলে, 'কেন রে, নয়ন? সে কোথায়? তোর বাবা-মা?'
'বাবা তো নেই!' সে মুখ নামায়। বলে চলে, 'দাদা অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। মাকে নিয়ে গেছে।'
তোর এই চেহারা কেন রে? অসুখ-বিসুখ করেনি তো? ডাক্তার দেখিয়েছিস?'
সে মস্নান হাসে। এখন আর বিনুনী করে না। ছোট খোঁপা। হাতের শিরা দৃশ্যমান। সোনা আর কাচের চুড়ি ঢল ঢল করছে। চোখের কোলে কালি। বলে, 'পেটে বাচ্চা। চলো না! কোথাও একটু বসবে?
তারা নিকটবতর্ী ঠান্ডা রেস্তোরাঁয় বসে। মুখোমুখি হতে, সে নয়নিকার চোখে গভীর দুঃখ দেখতে পায়। জিজ্ঞেস করে, 'তুই ভাল আছিস তো বোন?' নয়নিকা কেঁদে ফেলে।
রোস্তোরাঁর স্বল্প লোকে লুকিয়ে নামে অশ্রু। আর অশ্রুমুখী নয়নিকা বলে, 'আমি ভাল নেই গণনাথ দাদা! আমি মরে যাব!'
'কী সব বলিস নয়নিকা। আমরা আছি না?'
নয়নিকা সেসব কানেই তোলে না। শীর্ণ মুখে তার দু'টি চোখ আরও বড় ঠেকে। সে বলে চলে, 'যদি মরে যাই, দাদাকে বোলো, যেন এর শোধ নেয়। একদিন এসো আমার শ্বশুরবাড়িতে। খুব তাড়াতাড়ি একদিন। অস্ট্রেলিয়ার ঠিকানাটা দেব। আজকাল মনে থাকে না কিছু।'
'নয়নিকা, কী হয়েছে বল।'
'ওরা ছেলে চায়। বলো না দাদা, আমার পেটে যদি বারবার মেয়ে আসে, সে কি আমার দোষ?'
'এই তো তোর বিয়ে হল। ক'বছর। ক'টি মেয়ে তোর?
'একটাও না, একটাও না!'
'তার মানে?'
'যেই জানতে পায় পেটে ছেলে নেই, ওমনি গর্ভপাত করিয়ে দেয়। প্রথমবার কী যে খাইয়ে দিল! হঠাৎ দেখি রক্ত পড়ছে। কী রক্ত মাগো! ওগুলো তো আমার বাচ্চারই ছিল, নাকি বলো? কচি শরীর! বিষে গলে গলে আসছিল। তারপর জানো, চারমাসে গর্ভপাত করিয়ে দিল কোন এক দাইকে ডেকে। খাটের সঙ্গে দড়ি দিয়ে আমাকে বাঁধল। চেঁচিয়েছিলাম বলে খুব মারল আমার শাশুড়ি। একবার প্রেসার কুকার দিয়ে মাথায় মেরেছিল। ছঁ্যাকা দিয়েছে কত! গণনাথদাদা, এটা তো হাটবাজার! না হলে দেখাতাম কত দাগ!'
'নয়নকে বলিসনি?'
'কী করে বলব? ফোনের সামনে পাহারা দেয়। তারপর জানো, আবার গর্ভ হল। হঁ্যা, তৃতীয়বার! চার মাস পার হয়ে গেছিল। ডাক্তার বলল, এখন গর্ভপাত করালে এ মারা যেতে পারে। আমাকে দেখিয়ে বলল বুঝলে? আরও বলল যে আর কোনও দিনও বাচ্চা নাও হতে পারে। শুনে আমার শ্বশুর আর বর বলল, থাক তবে। অনেক হয়েছে। ভগবান যাকে দিচ্ছেন, খুশি মনে নাও। কিন্তু শাশুড়ি শুনল না। বলে, 'মরে মরুক। এ দেশে মেয়ের অভাব?' ডাক্তারকে অনেক টাকা দিল। আমার তিন নম্বর মেয়েটাও খুন হয়ে গেল দাদা। ভাবলাম, বেশ হল, আর যদি বাচ্চা না আসে তো বেঁচে যাই! কিন্তু দেখো! আবার! আমার বাচ্চারা যেন রক্তবীজ, হঁ্যা দাদা? যত মারে, তত জন্মায়।'
সে উন্মাদ হাসে। গণনাথ বলে, 'চল নয়নিকা। পালিয়ে চল। আমি তোকে নয়নের কাছে পাঠিয়ে দেব। খুব যত্নে রাখব তোকে। এখন তোর সঙ্গে কেউ নেই। কেউ জানবে না।'
নয়নিকা বলে, 'পালাতে পারব না গণনাথ দাদা।'
'কেন?'
আমার বরের জন্য। আমি ওকে ভালবাসি তো। আর ও-ও! আমাকে কত যে ভালবাসে কী বলব! ছঁ্যাকা খেয়ে যখন গায়ে ফোসকা পড়ে, ও-ই তো মলম দিয়ে দেয়। কত ভালবেসে সঙ্গম করে, যাতে এতটুকু ব্যথা না লাগে। আমাদের ভালবাসা আছে বলেই তো বারবার পেটে বাচ্চা আসে, না? বলো?'
'যত বাজে কথা ধর্ষণের ফলে মেয়েরা গর্ভবতী হয় না? সেখানে ভালবাসা কোথায়?'
'বোলো না। আর কিছু বোলো না। ওইটুকুই তো আছে আমার। কেন কেড়ে নিচ্ছ?'
'তা হলে বরের সঙ্গেই ভেগে যা তুই আমি সাহায্য করব।'
'সে কি আর ভাবিনি আমরা? কিন্তু ও বলে, মা-বাবা আপনার লোক। তাদের ছেড়ে কোথায় যাব? মা-বাবাই সাক্ষাৎ দেবতা।'
'তা হলে প্রতিবাদ করে না কেন? রামচন্দ্রের অবতার!'
'সব যে আমার শাশুড়ির হাতে। হিন্দি ফিল্মে দেখোনি, বিন্দুজি অভিনয় করেন? আগে ছিলেন ললিতা পাওয়ার? কী সব দজ্জাল শাশুড়ি! সবাইকে ভেড়া বানিয়ে রাখেন! খুব মজা পেতাম দেখে।'
'সব শাশুড়ির হাতে- তার মানে ব্যবসা, সম্পত্তি, বাড়িঘর- এইসব তো? এরই জন্য তোর বর চুপ করে থাকবে?'
'কতরকম মজবুরি আছে মানুষের, কত অসহায়তা। সব কি ব্যাখ্যা করা যায়?'
'যদি মরে যাস?'
'সে তো যাবই গণনাথ দাদা। একলা তো যেতে দেয় না কোথাও। আজ লুকিয়ে বেরিয়েছি। কেন জানো? পরীক্ষা করাতে। পেটের বাচ্চাটা ছেলে, না মেয়ে! ওরা দু-একদিনের মধ্যেই আবার আনবে। মনে মনে তৈরি থাকলাম।'
'এবারেও?'
'হুঁ! তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি এসো গণনাথ দাদা। ঠিকানাটা দেব।' সস্নান হাসে। বলে, 'আজ মার খেতে হবে। তবু কী আনন্দ যে হচ্ছে। একজন আপনার লোককে তো পেলাম। আর শোনো, দেখা যে হয়েছিল আমাদের-একথা উচ্চারণও কোরো না। যেন হঠাৎ এসেছে, কেমন? কী ভাল যে লাগছে! একজন আপনার লোক!'
মাত্র তেরাত্রি পার করে সে। মাত্রই তেরাত্রি। আসলে তা অন্তকাল!
'কাকে চাই" ভৃত্য এসে বলে।
'নয়নিকা।'
ভৃত্য তার আপাদমস্তক দেখে নেয় ভাল করে। চলে যায়। গৃহকোণে একটি ফুট তিনেক পেটমোটা রুপোর গণেশ। আর কোণে রুপোর চৌদোলায় সোনার মাখন লাল। সোনা আর রুপো, রুপো আর সোনা। ধাতব বৈভবে তার দম আটকে আসে। ইচ্ছে করে গণেশের নাদা পেটে টোকা দিয়ে দেখে। তিনিও তো গণনাথ। একপ্রকার ধাতব মিতালী হতেই তো পারে। সে কাছে গিয়ে গণেশের মোটা শুঁড়ে ফুঁ দেয়। তখন পেছনে তাঁর পদশব্দ বাজে। সে না দেখেও টের পায় এই আবির্ভাব নয়নিকা নয়। তবে কে?
'ওখানে কী করেছেন? কী চাই?'
সে ঘুরে দেখে। মোটা, তবে শক্তপোক্ত। গায়ে মোটা মোটা অলংকার। মুখে প্রসাধন।
ঠোঁট দুটি বিরক্তিতে বক্রিম। সে বলে, 'নয়নিকা?'
'আপনি কে? কোথা থেকে আসছেন?'
'আমি নয়নিকার দাদা নয়নের বন্ধু। আপনি?'
'আমি নয়নিকার শাশুড়ি। নয়নিকাকে কী দরকার?'
'নয়নের ঠিকানাটা চাই।'
'কেমন বন্ধু যে ঠিকানা জানেন না?'
'যোগাযোগ ছিল না যে। নয়নিকা চেনে আমাকে। ওদের বিয়েতেও আমি ছিলাম ও কোথায়?'
'নেই।'
'নেই মানে?
'মরে গেছে।'
'মারা গেছে? কবে? কী করে?'
'একদিন হল। বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মরেছে। আপনি এখন আসুন।'
'বাচ্চা হতে? ক'মাস ছিল? কীভাবে মারা গেল? ভাল ডাক্তারের কাছে কি নিয়ে যাওয়া হয়নি?'
'এত কথার জবাব আপনাকে কেন দেবে?'
'নয়নের ঠিকানা?'
'আমি জানি না।'
নয়নিকা মারা গেছে। সে তো বলেছিল, বাঁচবে না। তাই বলে সত্যি সত্যি? এ তো হত্যা। নৃশংস হত্যা! সে স্পষ্ট শুনতে নয়নিকা বলছে, 'দাদাকে বোলো, যেন শোধ নেয়।' শোধ? নয়নিকা? সে বিড়বিড় করতে করতে পথ চলে সেদিন। 'নয়নিকা, আমি দাম করেছি। টাকা জমাচ্ছি। একটা অন্তর কিনবই।'
সেই অস্ত্র তার পকেটে এখন। ধাতব শীতল, কিন্তু আগুনে ভরা পেট। এ গৃহে এখন গণেশের পাশে রুপোর পদ্মফুলে সোনার লক্ষ্মীদেবী। মাথায় মণিমুক্তো বসানো মুকুট। সব মিলে তিন হাত উঁচু। নবতম আমদানি। আগে ছিল না।
আবার ভৃত্য আসে। এ অন্যজন। এদের অনেক ভৃত্য। 'কাকে চাই?' জানতে চায়। সে অকপটে বলে, 'নয়নিকার শাশুড়িকে।' নাম জানে না আর কী বলবে? নয়নিকার বরের নাম জিতেন। বলতে পারত 'জিতেনের মাকে।' কিন্তু সে তো সত্যি জিতেনের মাকে চায় না। চায় নয়নিকার শাশুড়িকে। ভৃত্য বলে, 'মা নতুন বউকে নিয়ে পুজোয় বসেছেন।
'গিয়ে বলো, আমি নয়নের ঠিকানাটা চাই।'
একটু পরেই সালংকারা, ভারী, শক্তপোক্ত মহিলাটি আসেন। লালপাড় গরদের শাড়ি। আজ পায় নূপুরের ছুমছুম।
'আপনি আবার কেন এসেছেন?' কড়া স্বরে তিনি জানতে চান।
'নয়নের ঠিকানাটা।' সে আস্তে বলে।
'বলেছি না, নেই। চলে যান।'
'নয়নকে পাঠাতে হবে।'
'কী।'
'নয়নিকা একটা চিঠি রেখে গেছে। আপনি যে ওকে মারতেন, ছঁ্যাকা দিতেন, আর সেই প্রেশার কুকারটা? যেটা দিয়ে মেরেছিলেন? আর সেই দড়িদড়া, যা দিয়ে ওকে বেঁধে গর্ভপাত করানো হয়ঃ'
'কাকে লিখে গেছে? কবে লিখে গেছে? সব মিথ্যা কথা। ও পাগল ছিল। এসব একদম বলবেন না। এখুনি চলে যান। না হলে আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে। রাম সিং, লছমন সিং, ভারত সিং।'
'কেউ আসবে না।'
'কোন?'
'একজন দাইকে ডাকতে গেছে সাক্ষী। একজন ওই ডাক্তারকে, যে পরাশব্দোত্তর চিত্রণে বলে দিত পেটের বাচ্চা ছেলে না মেয়ে, আর একজন ডাক্তার, যে গর্ভপাত করত।'
'চুপ করুন। একদম চুপ। মেরে পুতে দেব। কী চান আপনি? কত টাকা চান?
'নয়নের ঠিকানাটা।'
'কী প্রমাণ আছে যে নয়নিকা চিঠি লিখে গেছে?'
'দেখাব। দেখবেন?'
'দেখব।'
'চলুন।'
'কোথায়?'
'আপনার ঘরে। হঁ্যা, বলে দিন, কেউ যেন ডাকাডাকি না করে।'
'চিঠিটা আমার চাই। কত টাকা নেবেন তার জন্য?'
'এসব কথা এখানে তো হবে না।'
তারা মহিলাটির নিজস্ব কক্ষে যায়। সে দরজা অাঁটে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে বুকে পিস্তল ঠেকায়, 'একটা কথা বললে গুলি করব।'
মহিলাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। হাত-পা বেঁধে দেয় খাটের সঙ্গে। মুখ বাঁধে। একটি একটি খুলে নেয় বেশবাস। চর্বিময় পৃথুলা শরীর, সে একদলা থুতু ফেলে গায়ে। মোটা মোটা স্তম্ভ সদৃশ দুই পা ফাঁক করতে সে ঘেমে নেয়ে ওঠে। একটি ছোট্ট বাল্ব সমেত পস্নাগ বিদু্যতের উৎসে গুঁজে দেয়। যথেষ্ট গরম হলে সন্তোষ লাভ হয় তার। রুমালে বাল্ব ধরে ছঁ্যাকা দিতে থাকে। উরুদ্বয়ে, তলউদরে, কাঁচাপাকা চুলে ঢাকা যোনিদেশে। মহিলা এলিয়ে পড়েন যাতনায়। অবশেষে বুকের মধ্যিখানে গুলি করে। হাত পোছে ভাল করে। পিস্তলের নল পোছে। এদের এত ঘাম হয় কেন সে বুঝতে পারে না। সারা শরীরে আবর্জনা বয়ে বেড়ায় সব। সাফসুতরো না হলে বড্ড ঘেন্না করে তার" হঠাৎ সে বড্ড খিদে বোধ করে। বেরিয়ে একটি বাসে উঠে পড়ে। বিরিয়ানি খাওয়া যাক, ভাবে সে।
পাশেই হিন্দু পাড়া। আর সে থাকত বসিরের সঙ্গে মুসলমান জনপদে। যেদিক দিয়েই দেখা যাক, একটির শেষ হলে অপরটির শুরু। এর ঠিক মাঝখানে মৌলবী নাসিরুদ্দিনের ডাক্তারখানা। ধর্মশাস্ত্রজ্ঞানী তিনি এবং পেশায় চিকিৎসক। এলাকার বড় ভরসা। হিন্দুদেরও যেমন, মুসলমানদের তেমনি, জ্ঞানী, পরোপকারী মানুষ, মনে কোনও ভেদাভেদ নেই। তার বা বসিরেরও নেই। তারা একত্র থাকে। খায়-দায়। এত স্বাভাবিক, লোকে তাকেও মুসলমান ধরে নেয়।
একদিন হিন্দুপাড়ায় শিবের পবিত্র মন্দিরের চাতালে কে বা কারা মরা গোরু ফেলে গেল। হিন্দুপাড়া ক্ষেপে উঠল। সন্দেহ গিয়ে পড়ল মুসলমানের পাড়াতে। পরদিন মুসলমান জনপদে পবিত্র মসজিদের সামনে কে বা কারা ফেলে গেল স্কন্ধকাটা শূকরের দেহ। মুসলমানেরা ক্ষেপে উঠল। সন্দেহ গেল হিন্দুদের দিকে। আগে এপাড়া ওপাড়া মুখোমুখি হলে বলত- সুপ্রভাত। বলত- খবর ভাল তো? হালককিকৎ কী? দেহমন সুস্থ তো? ঃ দু'দিনেই তারা পরস্পরের শত্রু হয়ে গেল। দেখা হওয়া মাত্র ঘৃণায় নিষ্ঠীব ত্যাগ করল। হিন্দুপাড়ার নামকরা চোয়াড়ে গুন্ডা লখনা ধর্মরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে নিল।
মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ভালমতো ক্ষেপিয়ে তুলল সে। হিন্দুরা দা, বঁটি, কুকড়ি, ভোজালিতে শান দিতে লাগল।
ওদিকে ইসলামের পবিত্রতা রক্ষার দায় কাঁধে নিল মুসলমান পাড়ার মাস্তান জালালু শেখ। হিন্দুদের বিরুদ্ধে সে-ও মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলল। মুসলমানেরা দা, বঁটি, তরবারিতে শাণ দিতে লাগল। মেয়েরা ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ করে দিল। শিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হল দূরের আত্মীয় বাড়ি। বসিরের দোকান ছিল হিন্দুপাড়ায়, সে দোকান খুলতেও গেল না।
তখন মৌলবী নাসিরুদ্দিন চিকিৎসক পথে নামলেন। পরোপকারী মানুষ তিনি। দুই চোখে অসীম করুন। হিঁদুপাড়া-মোচলমানপাড়া ঘুরে ঘুরে জনে জনে বলতে লাগলেন, 'বাবা সকল, মায়েরা, বোনেরা, ভেবে দেখো, ধর্মকে নষ্ট করে কার সাধ্য? দুটি মরা জানোয়ার এনে ফেললেই কি ঈশ্বরের স্থানমাহাত্ম্য এবং পবিত্রতা নষ্ট হয়? হূদয় দিয়ে ভেবে দেখো ভাই সকল, এ কোনও দুষ্ট লোকের কাজ। কোনও স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তারা দাঙ্গা বাধাতে চায়। দুষ্টের কাছে তোমরা মাথা নত করবে কেন? ঈশ্বর প্রকৃতপক্ষে কী চান?
হত্যা নয়, ঘৃণা নয়, মৃতু্য নয়। তিনি চান ভালবাসা।'
হিন্দুপাড়ার কিছু, মুসলমানপাড়ার কিছু শুভবুদ্ধি জন মৌলবী নাসিরুদ্দিন চিকিৎসকের পাশে দাঁড়ালেন। পরোপকারী পণ্ডিত মানুষ- লোকে তাঁর কথা মন দিয়ে শুনল। রাতারাতি এ ওর গলা জড়িয়ে ধরল না বটে, তবে অস্ত্রে শাণ দেওয়া স্থগিত রইল।
এক রাতে কর্কশ শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসল সে আর বসির। জানালায় উঁকি মেরে পথবাতির স্তিমিত আলোয় তারা দেখল, পেছন থেকে জাপটে, মুখ চেপে, মৌলবী নাসিরুদ্দিন চিকিৎসককে ধরে আছে মাস্তান জালালু শেখ, আর তাঁর গলার কাছে ছুরি বাগিয়ে আছে ও কে? হিন্দুপাড়ার নামকরা চোয়াড়ে গুন্ডা লাখনা নয়? এককে আরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা লখনা আর জালালু একত্রে?
জালালু বলে, 'দাঙ্গা ঠেকাবি? পণ্ডিতি হচ্ছে? তুই কি স্বর্গের ফেরেস্তা? খোদা তোকে প্রেমের বাণী দিতে পাঠিয়েছেন? নে, তোর কাজ শেষ। খোদার দূত খোদার কাছে ফেরত যা।'
লখনা এক ঝটকায় মৌলবী চিকিৎসকের গলার নলি কেটে দেয়।
সে বসিরকে বলে, 'চল, ধরি।' বসির তাকে জড়িয়ে ধরে, 'একদম না। জানে মেরে দেবে।
'ডাক্তার বাবু এখন একা একা কী করছিলেন।'
'শুধু জানি তিনি শত শত মানুষকে হিংসা ও হত্যা থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন।'
বসির নিঃশব্দে ফুলে ফুলে কাঁদে। গণনাথের পিঠে তার চোখের জল, নাকের জল, লালা মিশে যায়। প্রেমবানের পবিত্র কান্না। গণনাথ তা ধুয়ে মুছে ফেলার কথা চিন্তাও করে না। ভাবে, কিনবেই, একটা অস্ত্র সে কিনবেই।
এখন আর মাত্র দুটো গুলি। লখনা আর জালালু শেখ। ব্যস। খতম।
কিন্তু এলাকায় এসে সে অবাক হয়ে যায়। জালালু শেখ পেট ফেটে মরে গেছে। পেট আবার ফাটে নাকি? না, ঠিক পেট নয়। পেটের মধ্যে কোনও যন্ত্র। যকৃৎ বা পাকস্থলী, বা পিত্তাশয়। যাই হোক, মৌলবী ডাক্তারবাবু তার চিকিৎসা করতেন। তিনি নেই। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।
সে তখন লখনার বাড়ি যায়। তার ইচ্ছা- লখনাকে বাঁধবে, ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে দেবে পিঠের চামড়া। তারপর অ্যাসিড ঢালবে। ঘন গাঢ় অ্যাসিড। ভুস ভুস করে ধোঁয়া উঠবে কি? রস রক্ত হাড় ত্বক এবং অমস্নের বিক্রিয়ায়? কিন্তু তার সুযোগ নেই। সে বাইরে থেকে ডাকে, 'লক্ষ্মণ ভাই।'
'কে?'
'একটু দরকার ছিল।'
'কে?'
'আমি গণনাথ।'
'কে গণনাথ?' লখনা বেরিয়ে আসে। উদোম গা। টিলটিলে ভুঁড়ি। ভুঁড়ির তলে গিঁট-বাঁধা লুঙ্গি। মুখে খাঁটি হুইস্কির গন্ধ। হিন্দুধর্মের পবিত্রতার রক্ষক। বলে, 'কে তুই?'
'নাসিরুদ্দিন ডাক্তার সাহেব আমাকে পাঠালেন।'
'কে?' লুঙ্গির গিঁট খুলে বাঁধে একবার। ঠোঁট চেটে বলে, 'পাগল নাকি?'
'না। সুস্থ লোক।'
'কী চাই?'
'শোধ।'
গুলি করে একটিই। অব্যর্থ লক্ষ্যে। চলে যায়। ফিরেও তাকায় না। আজ আর হাত মোছার দরকার নেই।
।। ৫ ।।
বাড়ি ফেরে। আঃ! বাড়ি ফিরে কী শান্তি! মূত্রবেগ অনুভব করে সে। ধৌতিঘরের বাতি জ্বালে। এখন গভীর রাত্রি। তার ক্ষুধা পায়। দরজা খুলে ট্রাউজারের চেন টানতে গিয়ে চোখে পড়ে তার। কোমোডে ওটা কী? নড়ছে। ছোট্ট কালো প্রাণী। জলে ছটফট করছে। চক্রাকারে ঘুরছে। সে কি ফ্লাশ করে দেবে? বোতামে হাত দিয়েও হাত সরিয়ে নেয়। আহা! জ্যান্ত প্রাণী একটা। নিচু হয়ে দেখে। চর্মচটিকা। কুৎসিত, কালো, লোমশ চামচিকে।
সে একটি কার্ডবোর্ড নেয়। অতি সাবধানে প্রাণীটিকে জল থেকে তোলে। সাবধানে শুকনো মেঝেয় নামিয়ে দেয়। এতক্ষণের সংগ্রামে ক্লান্ত অবসন্ন প্রাণীটি থরথর করে কাঁপে।
ও বাঁচবে তো? সে তো দেখেছে, বাঁচার কী আশ্চর্য আকুতি! তখন তার কান্না পায়। বাঁচতে চায়, প্রাণীটা বাঁচতে চায়। ওরাও কি চায়নি? কলেস্নাল, অসীমা, নয়নিকা, ডাক্তার বাবু? কেউ ওদের বাঁচায়নি।
একবার সে একজন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিকের বক্তৃতা শুনতে যায়। মানুষের হিংসা নিয়ে একটি কিতাব তিনি লিখেছেন সেই সময়। এই বই লেখার কারণ হিসেবে বিষণ্নভাবে তিনি বলেন, তাঁর যখন এগারো বছর বয়স, একজন রক্তাক্ত ব্যক্তি তাঁদের গৃহে আবিভর্ূত হয়। লোকটি পড়ে যাচ্ছিল, সে সময় তিনি তার মাথা আপনার ক্রোড়ে তুলে নেন। সেখানেই মানুষটির মৃতু্য হয়েছিল। সে ছিল মুসলমান। তখন দাঙ্গা চলছিল। কতিপয় হিন্দু তাকে হত্যা করে।
সেই দিন দার্শনিক ভাবতে শুরু করেছিলেন, এত হিংসা কেন? এর উৎস কী? কোথায় এর প্রতিকার?
সে কাঁদে, চিৎকার করে, আর ভাবে, দার্শনিক কোন সত্যে পেঁৗছেছেন? সে তো জানে, জেনেছে, ন্যায় এবং ধর্ম-ন্যায়পরায়ণ এবং ধার্মিককে রক্ষা করে না। প্রেমবান মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় নিষ্ঠুরতা! ধর্ম আর ন্যায় তা হলে কোথায়? কে এসব নিয়ন্ত্রণ করে?
সে মূত্রত্যজন সম্পূর্ণ করে। ঘুরে দাঁড়ায়। তার চোখে পড়ে উলটোদিকের দেওয়ালে কাঁচে বাঁধানো ঈশ্বর। সে যখন ছোট ছিল, মা সূঁচে-সুতোয় কশিদা নকশায় এই ঈশ্বরকে গড়েছিলেন। একদিন, মা তাঁর সেলাই রেখে অন্য কাজে গিয়েছেন, সে তখন চুপিচুপি সেই ঈশ্বরের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। কী মনে হতে ঈশ্বরের দীর্ঘ করুণামাখা চক্ষুদ্বয়ে বিঁধিয়ে দিয়েছে ছুঁচ!
এরপর অনেকদিন মধ্যরাতে দুঃস্বপ্ন দর্শন করে সে ঘেমে নেয়ে উঠেছে। যেন ক্রুদ্ধ ঈশ্বর তাকে বলেছেন, 'তুই আমাকে অন্ধ করে দিলি। আমি তোকে ধ্বংস করব।'
আজ তার মনে পড়ে যায় স্বপ্নের কথা। সে হিংস ভাবে বলে, 'তা হলে তুমিই, তুমিই সব ধ্বংস করলে, অন্ধ ঈশ্বর?
ঈশ্বর বলেন, 'কে আমাকে অন্ধ করে?'
'তা হলে তুমি অন্ধ নও? বধির নও? নিষ্ক্রিয়!'
'ওই দেখো, চর্মচটিকা, মৃতু্যর মুখে ছিল। এখন উড়ছে।'
'ওকে আমি বাঁচিয়েছি। তুমি কাকে বাঁচিয়েছ ভণ্ড, অপদার্থ, অক্ষম? তোমাকে আমি খুন করব! খুন করব!'
গুলি করে। গুলিবিদ্ধ ঈশ্বর, কাঁচে বাঁধানো ঈশ্বর, ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়েন। আর রক্ত বহে যায়। রক্ত, রক্ত, রক্ত! ঘর ছেড়ে বারান্দায়, বারান্দা থেকে সিঁড়িতে, সিঁড়ি থেকে পথে প্রবল সে াতে বয়ে যেতে থাকে।
সকালবেলা শিউরে ওঠে মানুষ! এত রক্ত কার? কেউ জানে না!
=========================================
গল্প- 'ঘুড়িয়াল' by শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  গল্প- 'প্রক্ষেপণ' by মোহিত কামাল  গল্প- 'গন্তব্য বদল' by রফিকুর রশীদ  গল্প- 'ঝড়ের রাতে' by প্রচেত গুপ্ত  গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া  গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত  স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী  সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী  গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী  গল্প- 'হার্মাদ ও চাঁদ' by কিন্নর রায়  গল্প- 'মাটির গন্ধ' by স্বপ্নময় চক্রবর্তী  সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ'  গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান  ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান



দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ তিলোত্তমা মজুমদার


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.