গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা

সম্ভবত কোন এক নাচের স্কুলেই ওকে প্রথম দেখি। ওর কারুকার্যময় অবয়ব এতোই নিখুঁত সুন্দর ছিল যে চোখ সরানো রীতিমতো অসাধ্য ছিল আমার। যদিও একটুকরো ধারালো ঈর্ষা বুকের গভীরে খচ করে ওঠে।

আমার নিপুণ তাল, হাতের চৌকষ মুদ্রার দিকে খুব হেলাফেলায় নজর এড়াচ্ছিলো নাচের শিক্ষক অমৃতলাল স্যার। ওকে সেদিনই প্রথম নিয়ে এসেছিল ওর মা।
ধীরে ধীরে ঈর্ষাটা ফিকে হয়ে আসে আমার। ওর দেহভর্তি শুধু রূপই আছে। শিক্ষানবীশ ছাত্রী হিসেবে একেবারে নিরেট হাঁদারাম বলতে যা বোঝায় মুলতও হলো সে টাইপের। এক সময় আমাদের স্কুলে ওর নাচের পাট চুকে যায়। অমৃত লাল স্যারের মুগ্ধ দৃষ্টিতে বিরক্তি তৈরি হয়। মেয়েটার সাথে পরিচয় পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও ও আমার বুকের কোথাও একটুকরো কাঁচ হয়ে গেঁথে থাকে। সম্ভবত এ জন্য ওর অদ্ভুত সুন্দর হাসি ও সৌন্দর্যই দায়ী।
নাচ করতে আমারও আর ভালোলাগছিলো না। অন্যের ঠিক করা তাল, লয়, মুদ্রায় কোমর দোলানো, চোখের তারা নাচানো, হাতে নানা মুদ্রা তুলে মেকি হাসিতে অন্যকে আনন্দ দেয়া গেলেও এর মধ্যে ক্রিয়েটিভ কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার নাচ ছাড়ার সিদ্ধান্ত অনেকের চোখ কপালে ওঠে-
-এই মেয়ে বলে কী! এমন সুন্দর নাচতে ক'জন পারে!
-এতোটা পারদশর্ীতা বড় শিল্পীদের মাথাও ঘুরিয়ে দেয়, এখন বলে না-চ ছাড়বে! তবু নাচ আমি ছেড়েই দিলাম। অমৃতলাল স্যার শোকে মুহ্যমান হলেন। তবু কে কার কথা শোনে!
ছোটবেলা থেকেই ছবি অাঁকতাম। ড্রইং-এ বরাবর হাইয়েস্ট থাকতো। ছোট মামা দেশের নামকরা অাঁকিয়ে। কিন্তু একটু বড় হবার পর রঙ তুলি, ইজেলের ঠাঁই হলো খাটের নিচে। কিন্তু মজার ব্যাপার এইচএসসি পাস করে ভর্তি হলাম আর্ট কলেজেই।
চিত্রবালার বিচিত্র ভুবনের বাসিন্দা হয়ে গেলাম আমি। আর্ট কলেজেই আবার ওর সঙ্গে দেখা আমার। আমি যখন তৃতীয়বর্ষে ও তখন প্রথম কি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বছর তিনেকের অদেখা সময় ওর রূপের সঞ্চয় বাড়ানো বই কমায়নি। ওর রূপের খ্যাতি এতোটাই আলোচিত হতে থাকে যে আর্ট কলেজে এটা প্রায় প্রবাদের মতো হয়ে যায়- 'রেশমীর ছবি আকার দরকার কী, ওতো নিজেই একটা ছবি।'
তবে নাচের মতো না হলেও এখানেও রেশমীর পারফরম্যান্স সুবিধাজনক হয় না। একজন আটপৌড়ে শিক্ষার্থী হিসেবে ও দিন দিন নিস্প্রভ হতে থাকে। তারপরও ওর এতো বেশি প্রণয়াকাঙ্ক্ষি ছিল যে, এজন্যই বোধহয় ওর পক্ষে বেশিদিন আর অবিবাহিতা থাকা সম্ভব হয় না। আর্ট কলেজের পুরো কোর্স শেষ করার আগেই ওকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে পশ্চিমের একটা (খুব সম্ভবত ইংল্যান্ড) দেশে ও স্থায়ীভাবে চলে যায়।
আর্ট কলেজে ভালো করি আমি। এরপর স্কলারশিপ নিয়ে চলে যাই ছবির দেশ আর শিল্প বালার দেশ ফ্রান্সে। বিভিন্ন মিউজিয়ামে ছবি দেখতে শুরু করি অসীম কৌতূহল নিয়ে। ঠিক বুঝতে পারিনি- মোনালিসার সৌন্দর্য দেখে নাকি রিয়েল মোনালিসাকে দেখছি_ এই বোধে লুভর পাথরের মেঝেতে পা দুটো গেঁথে গিয়েছিল আমার। আমস্টারডামে ভ্যানগঘ ও রেমব্রান্ডট্ দেখে নিজের গায়েই চিমটি কাটি- স্বপ্ন দেখছি নাতো! কিন্তু তারপরও স্বপ্নই মনে হয় এসব।
এরপর থেকেই আমার অসুখটা শুরু হয়। ডাঃ রা অবশ্য বলেছেন- নার্ভাস ব্রেক ডাউন। এতো উন্নতমানের শিল্প সৃষ্টি দেখে নিজের উপর আস্থা হারাই। বাংলাদেশে বেশ কিছু ভালো ছবি অাঁকা হয়েছিল আমার। অঁলিয়াস ফ্রাসেজ, বেঙ্গল গ্যালারিতে দু'টো একক চিত্র প্রদর্শনী হলে ভালো প্রশংসা পাই। আমার তুলির টান, রঙ প্রয়োগের মুন্সীয়ানা, রেখার সূক্ষ্নতা নিয়ে সমালোচকরা স্তুতিই করেছেন। কিন্তু ফ্রান্সে এসে নিজের কাজকে মনে হচ্ছে অপরিপক্ক, অশৈল্পিকঃ। কিচ্ছু করতে পারি নাঃ। এভাবে দীর্ঘ সময় বসে থাকায় আমার স্কলারশিপটা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। হীনমন্যতায় ভোগা একটা কঠিন রোগে পরিণত হয়।
তারপরও সৃষ্টির তিব্র পিপাসা থেকেই যায় আমার। একটা নদী, দুধারে কাশ ফুল, আর জলের রেখায় নৌকা ভাসাই। নাহ্ এতে কোন অভিনবত্ব নেই। একটানে ছিঁড়ে ফেলি। মাথাটা পুরোপুরি গোলমেলে হয়ে যায়। তারচে বরং কবিতা লেখি- ফ্রান্সের মহান নারী 'জোয়ান আর্ককে নিয়ে? পর মুহূর্তেই এ ভাবনায় স্পর্ধিত মাত্রায় বিস্মিত হই। খুদ বার্নাডশ একে নিয়ে নাটক লিখে গেছেন। আর আমি ঃ। এরপর দ্রুত মানসিক ভারসান্য হারাতে থাকি।
দেশে ফেরার পর পরিচিত ও প্রিয়জনের সানি্নধ্য, আমার নিজের শহরের আটপৌড়ে রূপ ও অভ্যাসে ধীরে ধীরে পুরনো 'আমি'তে ফিরতে থাকি। মাস ছয়েক পর প্যারিসে অাঁকা আমার ছবিগুলোকে বাক্স মুক্ত করি। সৌভাগ্যক্রমে আমার এই মানসিক দৈন্যতা সত্ত্বেও মাহীর আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি। ও ওর সজীব ভালোবাসা দিয়ে আমার প্রায় নিভে যাওয়া বোধগুলো জাগিয়ে তোলে।
মাহীরকে বিয়ে করি। একটা অদ্ভুত মধুরতা আমার সমস্ত জড়তাকে দু'হাতে ঠেলে সরাতে থাকে। আবার অাঁকতে শুরু করি। প্রায় সারাদিনই অাঁকা-অাঁকির জগতে ডুবে থাকি। নিজের তুলির অাঁচড় নিজের প্রাণেই তোলপাড় তোলে।
মাহীরের ভালোবাসায় আমার মধ্যে প্রাণ ফিরে আসে। শুকিয়ে যাওয়া বোধে নতুন করে কুঁড়ি আসে। ফুল ফোটে।
স্বপ্নের রঙে ঘর সাজাই দু'জন। মাহির আর্কিটেক্ট। ওর শৈল্পিক সৃজনশীলতা বরাবরই স্বস্তি দেয় আমাকে। ঘরটাকে আটপৌঢ়ে সংসার বানাই না আমরা। বারান্দার টবে ফুল ফোটাই। রজনীগন্ধা। টবের একরক্তি মাটির স্বল্পতায় ফুলগুলো মূলত রচনাই করতে হয় আমাদের। প্রথম ফুল ফোটার আনন্দে তোলপাড় হই দু'জন। ঘরে চিন্ময়ের উদারগলায় মীরের মিহিন কারুকাজ- চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে উছলে পড়ে আলো/ও রজনী গন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালোঃ। সত্যি সত্যিই আকাশ জুড়ে চাঁদ উঠেছে আজ। মাহীর আমাকে গভীর প্রণয়ে আলিঙ্গন করে- আমার রজনীগন্ধা কি তার গন্ধুসুধা ঢালবে এবার? ওর নিবিড় ভালোবাসায় প্রেমও যেন নতুন করে রচিত হয়।
বছর দুই স্বপ্নের ঘোরে কেটে যায়। ছবি অাঁকা, ঘর, প্রেম সব নিয়ে মসৃণ সময় কেটেছে। কিন্তু একটু একটু করে শূন্যতা আসে ঘরে। মাহির একদিন স্পষ্ট বলে রূবা আমাদের একজন বড় কাছের মানুষের প্রয়োজন। মাহীরের কালো চোখের তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি নিজের চোখে গেঁথে ফেলি- ঠিকই বলেছো, আমাদের প্রেমে নতুন একজনকে যতোটা তাড়াতাড়ি সম্ভব সৃষ্টি করতে হবে।
একটা একটা করে মাস চলে যাচ্ছে। নির্ধারিত সময়টা এলে প্রচণ্ড টেনশনে মরে মরে থাকি। বিষয়টা ঘটে গেলে দুঃখে যন্ত্রণায় বিষাদগ্রস্ত হয়ে যাই মাসের পর মাস অপেক্ষা। বছর দুয়েকের দুঃসহ সময় এভাবে কাটতে থাকে। টবেও ফুল ফোটে না। আমার প্রাণশক্তি ক্রমশঃ যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিছু করতে ভালোলাগে না। বড় ভয় লাগে- তাহলে কী আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছিঃ? মাহীর ওর বিষাদ ঢেকে আমাকে বোঝায়-একটা বাচ্চাই কি সব? আমাদের প্রেম ভালোবাসাঃ। ওর আটপৌরে ভানে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ি-কেন আমার সামনে অভিনয় করছো? সত্যি বলো, এসব কি তোমার প্রাণের কথা? মাহীর দু'হাতে আমার কাঁধ আকড়ে ধরে- আমি যে চাই না তাতো বলিনি, কিন্তু সবার আগে তোমার সুস্থতা আমার প্রয়োজন, আমি করুণ চোখে ওর দিকে তাকাই- বলি আমরা কত কী করি-
গাছে ফুল ফোটাই
-পাহাড়ের মতো বিশাল অট্টালিকা তৈরি করি।
-অদ্ভুত সুন্দর ছবি সৃষ্টি করি। কিন্তু একটা জীবন বানাতে পারি না। একটা তুলতুলে শিশুঃ। হাঁটুতে মুখ গুজে আকুল কান্নায় দুমড়ে মুচড়ে যাই। মাহীর আমাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
কিন্তু স্পষ্ট টের পাই ওর আন্তরিক আলিঙ্গন কিংবা দরদী হাতের স্পর্শ দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। ওর রচিত হাসি আর ক্লান্তিকর মমতাভরা দৃষ্টির কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়।
শরীরের আনন্দে নয় স্রেফ একটা জীবন সৃষ্টির জন্য আমি ওর শরীরের কাছে সমর্পিত হই। মাঝে মধ্যে প্রচন্ড বিবমিষায় চিৎ হওয়া তেলাপোকার মতো তড়পাই। দাঁতে দাঁত চেপে কষ্টের পানি লুকোই।
ডাঃ বলেছে- মাহীরের কোন সমস্যা নেই। আমার কিছু সমস্যা থাকলেও একেবারে যে সন্তান ধারণ অসম্ভব তাও নয়।
একমাত্র রাতেই একসঙ্গে খেতে বসি আমরা। মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচার জন্য দিনরাত অাঁকাঅাঁকিতে বুদ হয়ে থাকি এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমার কাজগুলো সূক্ষ্ন শৈল্পিক পারিপাট্যে জেলস্নাদার হয়ে ওঠে। বছর তিনেকের মধ্যে নামী-দামী কিছু আর্টগ্যালারিতে একক প্রদর্শনী হয়। জাপান ও ফ্রান্সের দুটো প্রদর্শনীতে আমার ছবি প্রশংসাসূচক সমালোচনাই শুধু নয় শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার অর্জন করে। কিন্তু আমার মরুভূমিতে ফুল ফোটে না। মাহীরের সঙ্গেও সম্পর্ক হয়ে গেছে শীতল। শুধু ছাড়াছাড়িটা বাকি। ওর সানি্নধ্য আমার ভালস্নাগে না- খুব সম্ভবত ওরও তাই। গর্ভ ধারণের রিচ পিরিয়ডগুলোতে কাঙালের মতো ওকে ডাকি। মিশ্মিশে কালো অন্ধকারে তারচেয়েও কালো কিট্কিটে ঘৃণায় বিছানায় দম বন্ধ করে শুয়ে থাকি।
অঁলিয়স ফ্রসেজে এক চিত্র প্রদর্শনীতে ছবির স্তুতি শুনতে শুনতে আমি যখন বিষণ্নতা ভুলে অনেকটাই উৎফুলস্ন, তখন পিঠে কারো আন্তরিক হাতের স্পর্শ পাই- রুঃরুঃ(ও আমাকে আদ্যক্ষরেই ডাকতো) ঘার ফিরিয়ে দেখি- রেশমী। ৬/৭ বছরের অদেখার এ মেয়েটিকে আমি প্রায় ভুলতে বসেছি। ওকে দেখার পর আমার অনুভূতির সেতারে তীব্র অনুরাগ বেজে ওঠে- টুং টাং, টাং টুং টুংঃ। সুর ওঠে তাতে- রেশমী, কতদিন পর তোমাকে দেখলাম! এতোদিন কোথায় ছিলে? তোমাদের পুরনো ঠিকানায় খোঁজ করেছিলাম। তাও বছর পাঁচেক আগে। তারপর অবশ্য আর খুঁজিনি। হয়তো ভুলেই গেছ্লামঃ। ওর ফর্সা মুখটা বিষন্ন দেখায় একটু- তাই? আমি কিন্তু ভুলিনি তোমায়। বিয়ের পর চলে গেলাম ইংল্যান্ড। ওখানেই সেটেলড হয়েছি। হাজবেন্ড বিজনেস করে। তবে আমি বলতে পারো স্রেফ হাউজ ওয়াইফ। আটপৌরে গৃহিণী জীবন। ঘর গোছানো, বাচ্চাকাচ্চা সামলানোঃ। তুমি কত বড় আর্টিস্ট এখন! দেশ-বিদেশে খ্যাতি। অবশ্য অাঁকার হাতও তোমার অসাধারণ। কত সম্মান আর বৈচিত্র্যময় জীবন তোমার। অন্ততঃ আমার মতো একঘেয়ে জীবন কাটাতে হয় না তোমারঃ। ওর বুকচেরা দীর্ঘ হতাশা পরাবাস্তব শূন্যতায় ধাক্কা খেয়েও আমার কানে ঠিকঠাক প্রবেশ করে। বিস্মিত বোধ করি ওর এই আহাজারিতে। কি নেই ওর অর্থবিত্ত, রূপঃ। একটু বিরক্ত হই মনে মনে। ওর বিবেচনাহীন আফসোসে ক্ষোভ বোধ করি। আমার ভাবনায় আবার আঘাত হানে ওর আক্ষেপ- কত কি যে করার ইচ্ছে ছিল-
-গান গাওয়ার।
-নাচ করার।
-ছবি অাঁকার। কিন্তু মেধা না থাকায় কিছুই হলো না। এই সরল প্রকাশ ভঙ্গি ওর প্রতি তৈরি হওয়া একটু আগের ক্ষোভকে হটিয়ে আবারও আন্তরিক করে তোলে আমাকে। মেশমী জড়তাহীন গলায় আমার প্রশংসা করেই চলে- কত খ্যাতি তোমার। এতো স্রেফ মেধার ধারেই অর্জন করেছো তুমি। পত্রিকায় প্রদর্শনীর খবর পেয়েই দেখতে এলাম। তোমার সঙ্গে দেখা হবার এই সম্ভাবনাকে কিছুতেই মিস্ করতে চাইনি। দেশে এসেছি মাস দেড়েক। সামনের সপ্তাহেই চলে যাবো। আবার কবে আসি ঠিক নেই তাই ছুটে এলাম তোমার সঙ্গে দেখা করতেঃ। ওর হাতে হাত রাখি, বলি চলো কফি খাই? টেবিলে বসার পর ওকে একটু উদভ্রান্ত দেখায়- স্খলিত গলায় বলে- এতো চমৎকার কি করে অাঁকো তুমি? তারপর টেবিলে নিজের হাত দুটো বিছিয়ে বলে- দেখ, আমার হাত দুটো কত সুন্দর, কোমল আর গোলাপী আঙ্গুলের ডগাগুলো নেইল পলিশ ছাড়াই প্রায় রক্তবর্ণ, অথচ বড়ই অথর্ব। এরা কোন শিল্পই তৈরি করার ক্ষমতা রাখে না। স্রেফ মাকাল ফল। পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে ও। অবশ্য কিছুক্ষণ পর নিজেকে সংযত ও পুনঃনির্মাণে সচেষ্ট হয় রেশমী। সম্ভবত নিজের এই আচরণে লজ্জা পায়। ওর ফর্সা গাল দুটো গোলাপী হয়ে ওঠে। নিজেকে সহজ করার জন্য দ্রুত ব্যাগের চেন খোলে। হয়তো খাবারের বিল পরিশোধ করতে চায়। বাধা দেয়ার আগেই ও একটা খাম বের করে। ওর বিষণ্ন ও হতাশ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে- আমার বাচ্চাদের ছবি, এনেছি তোমাকে দেখাবো বলে। রেশমী খামের ভেতর থেকে একটা ফটোগ্রাফ বের করে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে আমার চোখ মুগ্ধ হয়ে ওঠে- তোমার ছেলে-মেয়ে? একরকম ওর হাত থেকে ওটা কেড়ে নিই আমি- দেবশিশুর মতো অদ্ভুত সুন্দর দুটো বাচ্চা উচ্ছ্তল সারল্যে হাসছে। রেশমী আমার দিকে তাকায়- ওর অবয়ব জুড়ে অব্যাখ্যাত এক তৃপ্তি ঝলমল করছে- আমার বাচ্চারা, দোলন আর চাঁপা। ওর মুখের ভাঁজে একটু আগের হতাশা আর বিষণ্নতার একটু কুচি মাত্র দেখতে পাই না। বলি রেশমী, তোর সৃষ্টি (আমি এর আগে ওকে কখনো তুমি সম্বোধন করিনি) সত্যি অপূর্ব, মন ভরানো রে! যাতে আছে ভালোবাসা আর মমতার পরিশ্রমী চেষ্টা, হূদয়ের গভীর প্রদেশের তাগাদা থেকে যার জন্ম সেই তো শিল্প, আর তা-ই মহান সৃষ্টি! তারপর ওর দিকে কাঙ্গালের মতো হাত বাড়াই- ছবিটা আমাকে দেবে? ও আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে চেষ্টা করে, তারপর ফটোগ্রাফটা খুশি মনেই দিয়ে দেয়- অবশ্যই দেবো, আমার কাছে ডুপিস্নকেট আছে তো। তখনই ওর মোবাইল বেজে ওঠে। ঃ ফোনের কথা শেষ করে ও ব্যস্ত গলায় বলে- রু এখনি উঠতে হচ্ছে, মেয়েটার জ্বর উঠেছেঃ। তারপর ছবিটার পেছনে ওর ফোন নম্বরটা লিখে দিলো- যোগাযোগ রেখো খুশি হবো।
ও চলে গেলে আবার গ্যালারিতে যাই। সমস্ত দেয়াল জুড়ে আমার অাঁকা ছবি। হাতে তখনো রেশমীর বাচ্চাদের হাসি উচ্ছ্তল অপূর্ব ফটোগ্রাফটি। রঙ ও রেখার সূক্ষ্ন কারুকাজ নিয়ে হেসে থাকা আমার সমস্ত শিল্পকর্ম মূক ও বধির হয়ে গেল মুহূর্তে। বরং আমি নিজের হাতে ধরা ছবিটা দেখি। এটাকেই আমার কাছে মনে হয় শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম।
========================================
গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন  গল্প- 'সুচ' by জাফর তালুকদার   গল্প- 'বাসস্ট্যান্ডে যে দাঁড়িয়েছিল' by ঝর্না রহমান  গল্প- 'গন্না' by তিলোত্তমা মজুমদার  গল্প- 'ঘুড়িয়াল' by শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  গল্প- 'প্রক্ষেপণ' by মোহিত কামাল  গল্প- 'গন্তব্য বদল' by রফিকুর রশীদ  গল্প- 'ঝড়ের রাতে' by প্রচেত গুপ্ত  গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া  গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত  স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী  সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী  গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী  গল্প- 'হার্মাদ ও চাঁদ' by কিন্নর রায়  গল্প- 'মাটির গন্ধ' by স্বপ্নময় চক্রবর্তী  সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ'  গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান  ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান



দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ পারভীন সুলতানা


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.