মুক্তার অপেক্ষা নিজেই বদলে গেছেন ফারজানা by তামান্না মোমিন খান

স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত মুক্তা তার ছেলেকে কাছে পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। বাবার বাড়ি থেকে ছয় লাখ টাকা আনতে না পারায় মুক্তাকে অমানুষিক নির্যাতনের পর এক কাপড়ে ঘর থেকে বের করে দেয় মুক্তার স্বামী বাবু। কেড়ে রাখে চার বছরের নাড়ি ছেঁড়া ধন আবিরকেও। সন্তানকে দেখার জন্য বার বার স্বামীর বাড়িতে গেলেও তাকে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এমন কি ফোনেও একটিবার ছেলের সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হয়নি।  মুক্তা জানান, ছয় বছর আগে বাবুর সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বাবু পেশায় ড্রাইভার। বাড়ি ঢাকার নতুনবাজার এলাকায়। বিয়ের পর এক বছর ভালোই ছিল তারা। এরপর থেকেই শুরু হয় বকাঝকা-মারধর। তারপরও মুখ বুজে স্বামীর ঘর করে যাচ্ছিল মুক্তা। কিন্তুবাবুর চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই চলছিল। একদিন বাবার বাড়ি থেকে ৫০হাজার টাকা এনে দেয়ার চাপ দেয় বাবু। মুক্তা তার বাবার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা এনেও দেয়। এখানেই শেষ নয়। এরপরও বিভিন্ন সময় বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনে মুক্তা। টাকা আনতে না চাইলেই মুক্তার ওপর চলে নির্যাতন। সবশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাবু গাড়ি কেনার জন্য মুক্তাকে তার বাবার বাড়ি থেকে ছয় লাখ টাকা আনতে বলে। টাকা আনতে না পারায় মুক্তাকে মেরে এক কাপড়ে ঘরছাড়া করে। বাবুর প্রহারে আহত মুক্তার জখম এতটাই গুরুতর ছিল যে ২৩শে ফেব্রুয়ারি  মুক্তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ২৫শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে হয় সেখানে। এখন ঢাকায় তার খালার বাড়িতে আছেন মুক্তা। ছেলের জন্য পাগলপ্রায় মুক্তা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কোনো পথ না পেয়ে গত ৪ঠা মার্চ মুক্তাকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ  সেলে নিয়ে আসেন মুক্তার মা পারভিন বেগম। কিন্তু স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ না করে বরং স্বামীর ঘরেই ছেলের কাছে ফিরে যেতে চায় মুক্তা। মুক্তা বলেন, আমি ছেলের কাছে যাইতে চাই। আমি তালাক চাই না। আমার স্বামীর ঘর করতে চাই।  আপনারা শুধু দেখেন আমার স্বামী যেন আমার ওপর আর অত্যাচার না করে। আরেক গৃহবধূ ফারজানা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তার স্বামী পেশায় ব্যবসায়ী। সামাজিক অবস্থানের দিক দিয়ে খুব ভালো অবস্থায় আছেন তারা। দশ বছর বিবাহিত জীবনে কখনই স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান পাননি ফারজানা। সংসার, সন্তান, চাকরি সব এক হাতেই সামলে যাচ্ছেন ফারজানা। তারপরও পদে পদে তার স্বামী ভুল ধরে। ফারজানা বলেন, বিয়ের আগে প্রথম যেদিন আমাকে দেখতে এসেছিল সেদিনই ওকে খুব রাগী মনে হয়েছিল আমার। যেহেতু পরিবারের সম্মতিতেই আমাদের বিয়ে হয়েছিল। তাই আমার মতামতের প্রাধান্য দেয়া হয়নি। বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমার। বিয়ের আগে ভাবতাম যে আমার জীবনসঙ্গী হবে তার সঙ্গে আমার কোনো আড়াল থাকবে না। সংসারের সবকিছু করবো দুজনে মিলে। কিন্তু বিয়ের পর আমার খুব অবাক লাগতো যখন দেখতাম প্রয়োজন ছাড়া সে আমার সঙ্গে কথা বলে না। বাইরে থেকে এসেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে যেত। আমি কথা বলতে চাইলে প্রথমদিকে বিরক্ত হতো। পরের দিকে এত কথা বলো কেন বলে ধমক দিয়ে উঠতো। এমন কি বাসায় তার বন্ধু-বান্ধব  আসলে তারা যাওয়ার পর আমি তাদের সঙ্গে কি কথা বলেছি তা নিয়েও সে অশান্তি করতো। বিয়ের এক বছর পর আমি সন্তান নিতে চাইলেও সে নিতে দেয়নি। যখন আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে সন্তানের কথা বলেছে তখন সে সন্তান নিতে রাজি হয়েছে। বিয়ের পর  আমি তাকে অনেক বদলানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন আমি বদলে গেছি। প্রয়োজন ছাড়া কখনই তার সঙ্গে কথা হয় না আমার। এখন আমার জীবন জুড়েই আমার ছেলে। তাকে নিয়েই আমি স্বপ্ন দেখি। শিক্ষিত চাকরিজীবী হওয়ার পরও সংসার ছেড়ে যাবো এটা কখনো ভাবতে পারিনি। কারণ আমাদের সমাজে নারীরা যতই শিক্ষিত এবং কর্মদক্ষ হোক না কেন স্বামীর ঘরে সে  তো কেবল স্ত্রী। আমার মতো অনেক নারী স্বামীর ঘরে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। যা চার দেয়ালে চাপা পড়ে থাকে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী জুন ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে প্রতি মাসে নারী নির্যাতনের অভিযোগ পড়েছে গড়ে ৭১টি। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের  আইনজীবী পারভীন আকতার খান মেরী বলেন, আমাদের দেশের নারীরা ধৈর্যশীল। তারা সব সহ্য করেও স্বামীর ঘর করতে চায়। তারা নিজেরা নির্যাতিত হলেও আশেপাশের মানুষকে জানাতে চায় না তার স্বামী খারাপ। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল নির্যাতিত নারীদের সবরকম আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে। কিন্তু অনেক নারীই নির্যাতনের শিকার হলেও তারা কোনো প্রতিকার চায় না।

No comments

Powered by Blogger.