কণ্টকমুক্ত হোক নারীর যাত্রাপথ by সেলিনা হোসেন

জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো পালন করার রেওয়াজ আমাদের দেশে বরাবরই ছিল। কিন্তু সাড়ম্বর আয়োজন করে আন্তর্জাতিক নানা দিবস পালনের রেওয়াজ বলতে গেলে খুব পুরনো নয়। যোগাযোগ ও প্রযুক্তির বিকাশের ফলে পৃথিবীর জাতিগুলো ক্রমান্বয়ে কাছাকাছি এসেছে। এর ফলে পরস্পরের সম্পর্কে জানা-বোঝার সুযোগ ঘটছে যেমন, তেমনি অপরের অর্জনগুলোকে সম্মিলিতভাবে সবার অর্জন হিসেবে পালনের সুযোগও ঘটেছে কিংবা ঘটছে। এ হলো মানুষের আন্তর্জাতিক আচরণের অংশ। আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি তাই আজ সবার মাতৃভাষা দিবস। বহু বছর ধরে আমরা মে দিবস পালন করি শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর স্পর্ধার দিন হিসেবে। আমাদের জাতীয় দিবসের পাশাপাশি এ দিনগুলো আমাদের আন্তর্জাতিকতাকে নতুন মহিমা ও মর্যাদা দিয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ইতিমধ্যে নারী দিবস পালনের শতবর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে। অনেকেই বলেন, নারী দিবস পালনের ইতিহাস আর নারী আন্দোলনের ইতিহাস প্রায় সমান্তরাল। আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে নারী অগ্রযাত্রার সূচনা করেছিল সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। এবারের প্রেক্ষাপটে যদি আমাদের দেশে নারীর সার্বিক দিক পর্যালোচনা করি, তাহলে কী দেখতে পাই? এ সঙ্গে এই প্রশ্নও দাঁড়ায় যে, সেদিকে ফিরে তাকানোর দিন শুধু আজই-বা কেন হবে? প্রত্যেকটি দিনই যদি এই প্রেক্ষাপটে আলোচনা-পর্যালোচনায় গুরুত্ব পায়, তাহলে নিশ্চয়ই এর শুভ প্রভাব সমাজে পড়বে। দূর করা সম্ভব হবে নানারকম অসঙ্গতি। যখন আমরা এবার নারী দিবস পালন করছি, এর কয়েক দিন আগে সমকালে প্রকাশিক একটি সচিত্র প্রতিবেদন দৃষ্টি কাড়ার পাশাপাশি কিছু প্রশ্নও দাঁড় করিয়েছে। এই প্রতিবেদনে প্রকাশ, যৌতুকের দাবিতে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতন সইতে না পেরে বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মাথায় ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন অর্চনা রানী সরকার। ২২ বছরের অর্চনা ২ মার্চ সন্ধ্যায় কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর রেলস্টেশনের কাছে আত্মহত্যা করেন ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে। ওই ঘটনায় অর্চনার স্বামী শুধাংশু সরকার ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে পুলিশ গ্রেফতার করে। বিয়ের সময় অর্চনার বাবা যৌতুক দিলেও স্বামীর পরিবারের লোকজনের অর্চনার ওপর চাপ ছিল আরও যৌতুক আদায়ের। মূল্যবোধের অবক্ষয় ও মানবিকতার যে আকালের কথা আমরা বলি, এরই মর্মন্তুদ শিকার হলো অর্চনা। এ যাবৎ কত অর্চনাকে যৌতুকের জন্য জীবন বলি দিতে হয়েছে এর পরিসংখ্যান মেলালে প্রশ্ন জাগবে সমাজ থেকে এই অন্ধকার দূর করা যাচ্ছে না কেন? নারী নির্যাতন রোধে, যৌতুকের বিরুদ্ধে এ সমাজে আন্দোলন ইতিমধ্যে কম হয়নি কিংবা এখনও তা থেমে নেই। নারী নির্যাতন রোধে দেশে কঠোর আইনও রয়েছে। কিন্তু তারপরও নারী নির্যাতনের মতো অভিশাপের অপছায়া আমরা দূর করতে পারছি না। এখনও গণমাধ্যম কিংবা বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে নারী নির্যাতনের নানামুখী চিত্র প্রায়ই চোখে পড়ে। অর্চনা একটি মাত্র মর্মন্তুদ দৃষ্টান্ত। এ রকম ঘটনার সব খবরই যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হয়, তাও নয়। অন্তরালেও থেকে যায় অনেক ঘটনা। সমাজে-পরিবারে নানাভাবে নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্বের অনেক দেশ থেকে ভিন্ন। এখানে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। তারপরও এখানে নারীরা আর্থ-সামাজিক পরিবেশ নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে মজবুত হচ্ছে শ্নথভাবে হলেও। সম্প্রতি নারী নির্যাতনের বিচারের ক্ষেত্রেও অনেকটা গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি ঘটনার দ্রুত বিচার হয়েছে এবং এমন দৃষ্টান্ত কখনও কখনও হতাশার মধ্যেও আমাদের আশার আলো দেখায়। কিন্তু এতেই স্বস্তি খুঁজলে চলবে না। এ রকম তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। নারীর জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান, চাকরি ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করার দাবি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।
স্বাধীনতা অর্জনের আগে এ দেশে নারী শিক্ষার বিষয়টি ছিল উপেক্ষিত। কিন্তু এখন অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকারের প্রশ্নে আমাদের অর্জনকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ যেমন বেড়েছে, তেমনি ক্ষমতায়নেও তাদের অবস্থান আগের চেয়ে ইতিবাচক। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক চিত্র রয়েছে। কিন্তু তারপরও কিছু দিক আমাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত শ্রেণিতে ফেলে রেখেছে। সামাজিক অবক্ষয়জনিত কারণে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মান্ধতা আর অশিক্ষার কারণে নারী তার অধিকার ভোগ করা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। নারী শিক্ষা সম্প্রসারণের মাধ্যমে তাদের অধিকতর আলোকিত করার যে উদ্যোগ রয়েছে, তা আরও দৃঢ়তর করতে হলে ব্যাপকভাবে আমাদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে পালন করতে হবে সামাজিক দায়িত্ব। এ কথা অনস্বীকার্য যে, নানাবিধ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নারী তার সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষ হিসেবে আপন মর্যাদা ও অধিকার আদায়ে এবং শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন দূর করার ক্ষেত্রে অনেকখানি সাফল্য অর্জন করেছে। তারপরও প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা রয়েছে- এই সত্যও এড়ানো যাবে না এবং এসবই দূর করতে দরকার সম্মিলিত প্রয়াস। ধর্ষণ, যৌতুক, সন্ত্রাস, পারিবারিক সহিংসতা এ রকম লাঞ্ছনা ও আক্রমণের পথ রুদ্ধ করতে বিদ্যমান আইনের যেমন যথাযথ প্রয়োগ দরকার, তেমনি দরকার সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো। দেশের নানা আইনও যে কোনো ক্ষেত্রে নারীকে শক্ত আশ্রয় দিতে পারছে না; তার পেছনে রয়েছে এর প্রয়োগে সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল কারও কারও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ত্রুটি এবং তাদের এসব বিষয়ে দায়বদ্ধতা কিংবা জবাবদিহির অভাব। দায়বদ্ধতা-জবাবদিহি-আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ সমাজ, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কল্যাণের জন্য বরাবরই অপরিহার্য বিষয়। এখানে বলতে হচ্ছে, ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের আন্দোলনের দিনটি অক্ষয় হয়ে আছে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে। বাংলাদেশের কর্মযজ্ঞে নারীদের বিপুল অভিষেক ঘটেছে পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের মাধ্যমেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অগ্রযাত্রা সমাজের এগিয়ে যাওয়ারই সূচক নির্ধারণ করে। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা প্রতিটি জাতীয় নীতিতে নারীর মাত্রাটি ব্যাপকভাবে যাতে যুক্ত রাখতে পারি, তা মনে রাখা দরকার। সরকার, প্রশাসন ও সমাজের দায়িত্বশীলদের সম্মিলিত প্রয়াস ও সার্বিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে নারী নির্যাতনের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত ঘটনার তালিকা যাতে আর দীর্ঘ না হয়, সেই পথ সৃষ্টিতে আরও সজাগ, সতর্ক ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। মনে রাখা দরকার, নারীর সমঅধিকারের দাবি নিছক কথার কথা নয়। সমাজের সুষম বিকাশের স্বার্থেই নারীর সমঅধিকারের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হওয়া দরকার। সব ক্ষেত্রে আপন দক্ষতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই নারী তার অধিকারের পরিপূর্ণ যৌক্তিকতা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। সাহিত্য, শিক্ষা, ক্রীড়াঙ্গন, কর্মক্ষেত্র সর্বত্রই মেধা ও সৃজনশীলতার দীপ্তিছটায় নারী আজ তার আপন মহিমায় অধিষ্ঠিত। নারীর এই স্বোপার্জিত গৌরব ও মহিমাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমাদের দেশ ও সারাবিশ্বের নারী সমাজ বিশ্বব্যাপী নারীর পরিপূর্ণ মুক্তি ও অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের প্রদীপ্ত শপথ গ্রহণ করবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে অবশ্যই দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ- এ কথাটি পুনর্বার জোর দিয়েই বলি। শুধু দিবস পালনের মধ্যে একটি গর্বিত আন্দোলনের উত্তরাধিকারে বন্দি হয়ে থাকা, এটি কাম্য নয়। আজকের পৃথিবীতে নারীর চোখে বিশ্ব দেখার বিষয় শুধু নয়, নারীর হাতে বিশ্ব পরিচালনার কথাও উঠছে। নারী সমাজে যে অসম অবস্থা রয়েছে তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে নানা উদ্যোগ চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। অবস্থার উন্নতিও হচ্ছে, তবে তা যাতে আরও গতিশীলতা পায়, লক্ষ্য হওয়া উচিত সেটিই। সমাজে নারী নির্যাতন রোধে যেমন প্রয়োজন সম্মিলিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিষয়টি আরও বেগবান করা, তেমনি সবক্ষেত্রে নারীর অধিকতর নিশ্চিতকরণে দরকার সবার উদার মনোভাবও। নারী নির্যাতন রোধে একদিকে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে অধিকার গতিশীল, অন্যদিকে অন্যায়-অপরাধের প্রশ্রয় কোনো মহল থেকেই যাতে না মেলে তাও নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি কথা হলো, নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন নারী শিক্ষার সুযোগের পথটি আরও প্রশস্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া। অর্চনার বিষয়টি দিয়েই শেষ করি। পরিবারের লোকজনের যে লোভ-লালসা-নির্মমতা-নিষ্ঠুরতা-নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতী এলাকার অর্চনা রানী সরকার, এর দৃষ্টান্তযোগ্য বিচার দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। কঠোর শাস্তি দিতে হবে তার আত্মহত্যার জন্য দায়ী মানুষরূপী পশুদের। শুধু পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন নয়, প্রয়োজনে ফৌজদারি দণ্ডবিধির প্রচলিত আইনে ওই অমানুষদের বিচার করতে হবে। সবশেষে এসে বলব, দূর হোক সব অন্ধকার এবং কণ্টকমুক্ত হোক নারীর যাত্রাপথ।
কথাসাহিত্যিক ও চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ শিশু একাডেমি

No comments

Powered by Blogger.