স্বাস্থ্য খাতে যে মানবসম্পদ প্রয়োজন

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সমকালে 'কোথায় যাবেন এত চিকিৎসক' শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ পড়ে মনে হওয়া স্বাভাবিক, দেশে এখন চিকিৎসকের সংকট তো নেই-ই বরং প্রাচুর্য আছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের একটি সমীক্ষার প্রেক্ষাপটে সংবাদটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৬ কোটি মানুষের বিপরীতে চিকিৎসকের চাহিদা ছিল ৬৩ হাজার ৩৯৫ জন, অথচ জোগান ছিল ৭৪ হাজার ৯২৪। সে হিসাবে ১১ হাজার ৫২৯ জন চিকিৎসক 'উদ্বৃত্ত' ছিলেন। এটা চিকিৎসকদের জন্য উদ্বেগের ব্যাপার হলেও রাষ্ট্রের জন্য আনন্দের। যেখানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে পর্যন্ত চিকিৎসকের প্রচণ্ড সংকট আছে, সেখানে বাংলাদেশে কি-না চিকিৎসক 'উদ্বৃত্ত' আছে- এটা আশা জাগানিয়া বিষয় বটে! তবে বিআইডিএসের সমীক্ষা গভীরভাবে খতিয়ে দেখলে এতে বড় ধরনের অসঙ্গতি পাওয়া যাবে। প্রতি ২৫২২ জনের জন্য একজন চিসিৎসক হিসাব করার কারণে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, আমাদের বোধ হয় অনেক চিকিসৎক আছেন। কোন যুক্তিতে ২৫২২ জনের জন্য একজন চিকিসৎক প্রয়োজন, সেটা স্পষ্ট হওয়া দরকার ছিল। কারণ 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' অর্জনের জন্য প্রতি ১০০০ জন মানুষের বিপরীতে ৪.৪৫ জন স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রয়োজন। সেই দলে চিকিৎসকের সংখ্যা হতে হবে গড়ে ১.৫৬ জন। সে হিসাবে উল্লিখিত ২৫২২ জনের জন্য প্রায় চারজন (৩.৯৩) চিকিৎসক প্রয়োজন আর ১৬ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজন প্রায় আড়াই লাখ চিকিৎসক। বাংলাদেশে বর্তমানে মেডিকেল ও ডেন্টাল মিলিয়ে মোট চিকিৎসকের সংখ্যা এখন এক লাখের নিচে। কাজেই এখনও আমাদের চিকিৎসকের ঘাটতি আছে এবং উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের আরও চিকিৎসক প্রয়োজন। দেশে শুধু চিকিৎসকই নয়, অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরও তীব্র ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের বিরলতম দেশগুলোর একটি, যেখানে ডাক্তারের সংখ্যা নার্স সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। সঠিক উপায়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য একটি স্বাস্থ্য কাঠামোতে চিকিৎসকের সঙ্গে আনুপাতিক হারে নার্সও থাকতে হবে। তা ছাড়া দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা দানকারীসহ বিভিন্ন শ্রেণির যে সংকট বিরাজমান, সেটা নিরসনে আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্য মানবসম্পদ নীতি থাকা প্রয়োজন। কেবল জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নয়, স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য জরুরি বিষয়, যেমন রোগের ধরন পরিবর্তন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক প্রগতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন- এসব নানা দিক বিবেচনায় রেখে আমাদের ভাবতে হবে, আগামীর বাংলাদেশে আমরা কেমন স্বাস্থ্যসেবা চাই এবং সেটা নিশ্চিত করতে আমাদের ঠিক কী পরিমাণে জনশক্তি প্রয়োজন।
এ পরিমাণটি ঠিক করা গেলে আমাদের ভাবতে হবে, আগামীর বাংলাদেশে আমরা কেমন স্বাস্থ্যসেবা চাই এবং সেটা নিশ্চিত করতে আমাদের ঠিক কী পরিমাণে জনশক্তি প্রয়োজন। এই পরিমাণটি ঠিক করা গেলে আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কীভাবে এই জনশক্তিকে গড়ে তুলব। আমাদের নজর দিতে হবে স্বাস্থ্যশিক্ষার দিকে। সরকারি ও বেসরকারি সব মেডিকেল, ডেন্টাল, নার্সিং ও অন্যান্য বিদ্যাপীঠে যেন সঠিক মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া হয়- সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আগামীর স্বাস্থ্য খাতের সেনানীরা যদি পেশাগতভাবে দক্ষ না হন, তাহলে দেশের ভেতরে কিংবা বাইরে কোথাও তাদের দ্বারা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাবে না। স্বাস্থ্যশিক্ষা বিশ্বের সর্বত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবে স্বীকৃত। কাজেই এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। পরিমাণ ও গুণগত মান- এই দুটি যথেষ্ট পরিমাণে বজায় রেখে জনশক্তি উৎপাদন করার পর তাদের এমনভাবে দেশের অভ্যন্তরে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে, যাতে জনগণ তাদের প্রাপ্য সেবাটি বুঝে নিতে পারে। দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোর সিংহভাগ শহরে অবস্থিত, অথচ মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ গ্রামে থাকে- এ এক চরম বৈষম্য। স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ না করা গেলে চিকিৎসক ও রোগী- উভয়ের শহরমুখিতা বাড়বে। তাতে শহরের যানজট বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যসেবার অবনতি ছাড়া আর কিছু হবে না। কীভাবে স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে দেওয়া যায়, সে জন্য সহজ অথচ কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় আরেক সমস্যা ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য। একই শহরে হৃদরোগে আক্রান্ত বিত্তবান মানুষটি যে সেবা নিতে পারেন, একজন বিত্তহীনের পক্ষে তা ভাবা দুস্কর। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গেলে প্রায় ৬৭ শতাংশ ব্যয়ভারের জন্য আমাদের কোনো প্রস্তুতি থাকে না। এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা থেকে লব্ধ অর্থের সিংহভাগ চলে যায় গুটিকতক বেসরকারি খাতের ক্লিনিক ও হাসপাতাল মালিকদের পকেটে। ফলে 'স্বাস্থ্যসেবা' বাংলাদেশে একটি লাভজনক বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে এবং শব্দটির 'সেবা' অংশটি যেন আজকাল উপহাসে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতির আশু নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। দেশের সিংহভাগ মানুষের আয়ের সঙ্গে যেন চিকিৎসা ব্যয়ের সঙ্গতি থাকে, সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে দক্ষ সেবাদানকারীর সেবা গ্রহণযোগ্য খরচে রোগীর কাছে পৌঁছায়, তা না হলে দেশে যতই চিকিৎসক-নার্স থাকুক তার সুফল জনগণ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। এভাবে যদি আমরা দেশের ভেতরে সংখ্যায় ও মানে যথেষ্ট চিকিৎসা-জনশক্তি গড়ে তুলতে পারি এবং তাদের সেবা সুলভে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারি, তখন আমাদের সুযোগ সৃষ্টি হবে দেশের ভেতরে 'চিকিৎসা পর্যটন' গড়ে তোলার। এতে দেশের জনশক্তি দেশে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। প্রয়োজনে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের চিকিৎসা-পরামর্শ প্রদান থেকে শুরু করে নানাভাবে আমাদের জনশক্তিকে বিশ্বমানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করা সম্ভব। আমাদের চিকিৎসা শিক্ষাকে যদি উন্নত দেশের সমমানে উন্নীত করা যায়, তাহলে দেশের বিদেশি শিক্ষার্থীদের পড়তে আসা এবং দেশের চিকিৎসকদের বিদেশে চিকিৎসা দেওয়া সহজতর হবে। তবে দেশের মানুষের চাহিদা অপূর্ণ রেখে এসব ভাবা কোনোক্রমেই সমীচীন হবে না। আমাদের স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত দায়িত্বশীল সবাইকে মনে রাখতে হবে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বৈষম্যহীন জনমুখী রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, সেটার সংবিধান অনুসারে প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। সেই সেবা দিতে আমাদের একটি সময়োপযোগী স্বাস্থ্য মানব সম্পদনীতি প্রণয়ন আবশ্যক। সেটা সঠিক পরিমাণে সঠিক গুণগত মানের জনশক্তি গড়ে তুলবে এবং তাদের মাধ্যম বাংলার প্রতিটি মানুষকে তার প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবার অধিকারটুকু বুঝিয়ে দেবে। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এবং গবেষণা কর্মকর্তা ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যানেজমেন্ট রিসার্চ, ভারত
mahbub321@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.