নকশিকাঁথায় পারভীনের ভাগ্য বদলের গল্প by এমএম মাসুদ

“তুমি তো ঢাকায় থাকো, হামার ক্যাঁথাটা ঢাকায় লিয়্যা যাইয়ো তো, বেচতে পারো কিনা। বেচতে পারলে হামাকে তখন টাকা দিয়ো। না হইলে  ক্যাঁথা ফ্যারত দিলেই হইবে। শুইনছি ঢাকাতে নাকি ক্যাঁথার ভালো দাম পাওয়া যায়।” পাড়ার ননদ-ভাবিরা তাদের তৈরি নকশিকাঁথা পারভীনের হাতে দিয়ে ঠিক এ কথাগুলোই বলতো বলে জানান নারী উদ্যোক্তা পারভীন আক্তার। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশন (এসএমই) আয়োজিত জাতীয় এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার-২০১৭তে তিনি বর্ষসেরা নারী মাইক্রো উদ্যোক্তা নির্বাচিত হন। সময়টা ১৯৯৭ সাল। মাত্র ২০ বছর বয়সে পারভীন বউ হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এসেছেন। লক্ষ্মীপুর জেলার মেয়ে পারভীন কি তখন ভাবতে পেরেছিলেন এই নকশিকাঁথাই তার ভাগ্য বদলে দেবে?
শূন্য থেকে শুরু হয় পারভীনের যুদ্ধ। পারভীন জানান, ননদ-ভাবিদের তৈরি করা কাঁথা ঢাকায় এনে পরিচিতদের কাছে বিক্রি করে তাদের টাকা ফেরত দিতেন। তখন স্বল্প পরিসরে স্বপ্নহীন এই ব্যবসায় শুধু গ্রামের সূচিশিল্পীদের তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দেয়াই ছিল তার লক্ষ্য। দিনে দিনে তার স্বপ্নের পরিধিও বাড়তে লাগলো। কিন্তু শুরুতেই পুঁজির অভাব। স্বামীর কাছে সারাক্ষণ টাকার জন্য হাত পাততেন পারভীন। বিরক্ত হয়ে একদিন ৫০ হাজার টাকা পারভীন আক্তারের হাতে তুলে দেন তার স্বামী। এরপর গল্পের মোড় অন্যদিকে ঘুরতে শুরু করে।
কীভাবে দিনদিন ব্যবসা বড় হলো? জবাবে পারভীন বলেন, ‘রাজশাহী নকশি ঘর’ নামে শুরু হয় তার ব্যবসা। গ্রাহক চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০০৭ সালে’ পারভীন নিজেই কাপড় ও সুতা কিনে পছন্দের ডিজাইনের নকশিকাঁথা তৈরি শুরু করেন। একইসঙ্গে খুঁজে বের করেন সেই সব সূচিশিল্পীদের যাদের হাতের কাজ ভালো। কিন্তু বিনিয়োগের সার্মথ্য নেই। তাদের নকশিকাঁথার কাপড় ও সুতা কিনে দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন গ্রাহকের চাহিদা। কাঁথা তৈরি শেষ হলে ন্যায্য পারিশ্রমিক দিয়ে কাঁথাগুলো ঢাকায় নিয়ে আসতেন।
পারভীনের স্বপ্ন দিনদিন বড় হতে শুরু করে। ‘কোটিপতি’ হওয়ার এক অদম্য বাসনা তৈরি হয় তার মনে। ২০১৩ সালের কথা। ঢাকার সামারাই কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত দেশীয় পণ্য প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন পারভীন। এখানেই ফ্যাশন হাউজ সাদাকালো আর টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির প্রতিষ্ঠান দু’টির সঙ্গে পরিচয় হয় পারভীনের। তাদের সঙ্গে কথা বলার পর ব্যবসা বড় করার নতুন সূত্র পান তিনি। ধীরে ধীরে দেশের ভেতরে অনুষ্ঠিত ছোট-বড় নানা মেলায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন। বড় হতে থাকে তার ব্যবসার পরিধি। বর্তমানে প্রায় আড়াইশ কর্মী নিয়মিত রাজশাহী নকশি ঘরের জন্য নকশিকাঁথা তৈরি করছেন। মৌসুমে তা বেড়ে চারশ থেকে পাঁচশ জনে দাঁড়ায়।
বর্ষসেরা এই নারী উদ্যেক্তা বলেন, এই গল্পের বর্ণনার মতো এতটা মসৃণ ছিল না তার পথচলা। স্বামী, সংসার, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা আর শ্বশুড়বাড়ির কাজকর্ম সামলে তবেই ব্যবসার জন্য সময় বের করতেন তিনি। এরপর মার্কেটিংয়ে ‘বায়ার’ বা ক্রেতা পাওয়া যেত না। ‘দেশের সামাজিক পরিস্থিতিও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য খুব সহনশীল নয়’- সে কথাও মনে করিয়ে দিলেন পারভীন। সব পরিস্থিতিকে সামাল দিতে হয়েছে খুব ঠাণ্ডা মাথায়। কিন্তু আজ পারভীন একজন প্রতিষ্ঠিত নারী উদ্যোক্তার একজন।
পারভীন আক্তারের বিশ্বাস, মাত্রই পথ চলা শুরু। এখনও পথের অনেকটাই বাকি। তার স্বপ্ন এখন দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে। তিনি চান নিজের উৎপাদিত পণ্য নিজেই বিদেশে পাঠাবেন। আরো বেশিসংখ্যক মানুষকে সম্পৃক্ত করবেন এই ব্যবসার সঙ্গে। দেশের অর্থনীতিতে রাখবেন অবদান।
পারভীনের উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে নকশিকাঁথা, নকশি থ্রি-পিস, বেড কভার, কুশন কভার ও পাটের কাজ। বর্তমানে পারভীনের এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সুখে জীবনযাপন করছেন। স্বামীও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।

No comments

Powered by Blogger.