হু-হু করে বাড়ছে ঋণের সুদ হার

হু-হু করে বাড়ছে ব্যাংক ঋণে সুদ হার। কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। মূলত বছরের শুরু থেকেই বাড়ছে ঋণের সুদ হার। বিনিয়োগে খরার কারণে কয়েক বছর ধরে ব্যাংক ঋণের সুদ হারে নিম্নমুখী প্রবণতা ছিল। উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে (১০ শতাংশের নিচে) নেমে আসে। দুই মাস ধরে ঋণে সুদ হার বাড়তে শুরু করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত জানুয়ারিতেই ১৯ ব্যাংকের সুদ হার গড়ে দুই অঙ্কের ঘরে গিয়ে ঠেকে। তবে একক ঋণ হিসেবে ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো ব্যাংকের সুদ হার সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এটি বিনিয়োগের জন্য খুবই খারাপ সংবাদ। এ প্রবণতা বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতিবাজ, ব্যাংক লুটপাটকারী ও ঋণখেলাপিদের শাস্তির ব্যবস্থা না করে উল্টো তাদের দায় ভালো উদ্যোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটি দেশে অর্থনীতির জন্য মোটেই শুভ নয়। এ অশুভ চক্র থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরও উদ্বেগ জানিয়েছেন। সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদ হার বেড়ে যাওয়া ব্যবসার জন্য খারাপ। এমনকি দেশের জন্যও খারাপ। তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ঋণে সুদ হার না বাড়ানোর অনুরোধ জানান। সংশ্লিষ্টদের মতে, অত্যধিক চাহিদা, তারল্য সংকট এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) পরিপালনের কঠোরতা আরোপের কারণে ঋণে সুদ হার বাড়ছে। গত ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে ঋণের সুদ হার বাড়ায় ব্যাংকগুলো। ফেব্রুয়ারিতে এ হার আরও বেড়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে ফেব্রুয়ারির হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। মাত্র ৮ থেকে ৯ শতাংশের সুদ ক্ষেত্রবিশেষে লাফিয়ে সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে উঠেছে। তবে গড়ে সুদ হার বাড়ানো হয়েছে ২ থেকে ৫ শতাংশ। বর্তমানে ১৯ ব্যাংকের সুদ হার গড়ে দুই অঙ্কে পৌঁছালেও মার্চের প্রথম থেকে বাকি ব্যাংকগুলোও তাদের ঋণের সুদ হার দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে আসবে বলে জানা গেছে।
গত বছর ৮ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণ পাওয়া গেলেও চলতি বছর ঋণ পেতে সুদ দিতে হবে সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদ হার কিছুটা কম হলেও অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকের ঋণের সুদ হার বেড়েছে। গত ডিসেম্বরে ১৬টি ব্যাংকের ঋণের সুদ হার দুই অঙ্কে পৌঁছালেও জানুয়ারিতে এসে ১৯টি ব্যাংকের ঋণের সুদ হার দুই অঙ্কে পৌঁছায়। মেয়াদি, চলতি, এসএমই, শিল্প এবং ভোক্তাসহ সব ঋণের ক্ষেত্রে গড়ে ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ সুদ নিচ্ছে এবি ব্যাংক, ১১ দশমিক ৭ শতাংশ ন্যাশনাল ব্যাংক, ১২.০৭ শতাংশ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ১২.৩৯ শতাংশ ইউনিয়ন ব্যাংক, ১৩.০৯ শতাংশ এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, ১০ দশমিক ২০ শতাংশ আইএফআইসি ব্যাংক, ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ ঢাকা ব্যাংক, ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ ওয়ান ব্যাংক, ১০ দশমিক ৩৬ শতাংশ এক্সিম ব্যাংক, ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ প্রিমিয়ার ব্যাংক, ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ ব্র্যাক ব্যাংক, ১২ দশমিক ৫৩ শতাংশ এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ মেঘনা ব্যাংক, ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মিডল্যান্ড ব্যাংক, ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ফারমার্স ব্যাংক, ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ এনআরবি ব্যাংক এবং ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে মধুমতি ব্যাংক। এ বিষয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকারি আমানত তুলে নেয়ায় এবং নতুন করে আমানত না আসায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। এটি মোকাবেলায় ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করছে। আমানতের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। যার কারণে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ হারও কমাতে পারছে না। আমরাও চাই ঋণের সুদ হার কমাতে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের সরকারি আমানত দিতে হবে। জানা গেছে, গত বছরে দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ব্যাপক হারে বাড়ছে ঋণ বিতরণ। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ে ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়া নভেম্বরে ১৯ দশমিক ০৬, অক্টোবরে ১৮ দশমিক ৬৩, সেপ্টেম্বরে ১৯ দশমিক ৪০, আগস্টে ১৯ দশমিক ৮৪ ও জুলাইয়ে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ফলে অধিকাংশ ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়ে যায়। পাশাপাশি আমদানি দায় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কিনেছে ব্যাংকগুলো। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) সীমা কমিয়ে দিয়েছে, যা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে। নতুন করে যেসব ব্যাংক এই সীমা অতিক্রম করছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নেমেছে ব্যাংকগুলো। এতে আমানতের সুদ হারও বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। আগে যেখানে ৩ থেকে ৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করত, এখন ৮ থেকে ১২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে ব্যাংকগুলো। আমানতের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে ঋণের সুদ হার। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, নতুন বছরের শুরু থেকেই ব্যাংক ঋণের সুদ হার বেড়েছে। এটা আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছি।

No comments

Powered by Blogger.