জরুরি অবস্থার মধ্যেও শ্রীলঙ্কায় মুসলিম স্থাপনায় হামলা অব্যাহত

শ্রীলঙ্কায় উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের হামলা থামছেই না। জরুরী অবস্থার মাঝেও মুসলিম স্থাপনা গুলো লক্ষ্য করে হামলা চালানো হচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মসজিদ, বাদ যাচ্ছেনা কিছুই। মঙ্গলবার রাতভর ক্যান্ডির শহরতলি ম্যানিকিন্নাতে উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের তাণ্ডবের শিকার হয় সংখ্যালঘু মুসলিমরা। পুলিশের মুখপাত্র রুয়ান গুনাশেকারা রয়টার্সকে জানান, রাতভর চলা ওই সংঘাতে অন্তত তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। অস্থিতিশীলতা তৈরির দায়ে সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় ১০টি মসজিদ, শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে৪ মার্চ ২০১৮ রোবাবার রাত থেকে শুরু হওয়া সহিংসতায় এ পর্যন্ত ১০টি মসজিদ, শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত দুইজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। তবে বেসামরিক নাগরিকদের আহতের কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। শ্রীলঙ্কা সরকার জানিয়েছে, যে কারণ দেখিয়ে দাঙ্গা ছড়িয়েছে তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। ক্যান্ডির একজন কর্মকর্তা বিবিসি’কে বলেন, ‘সবকিছু ভেঙে ফেলা হয়েছে। মুসলিমরা এখন সেখানে আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে।’
বাইরে থেকে এ সংঘাত উসকে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন শ্রীলঙ্কা সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী শরৎ আমুনউগামা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, এর পেছনে একটি সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্র রয়েছে। তবে সরকার নিরপেক্ষভাবে আইনের শাসন বাস্তবায়ন করবে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা ছড়ানোর অভিযোগে বুধবার ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়্যাটস অ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সংঘাতকবলিত ক্যান্ডি শহরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। এদিকে দাঙ্গার পেছনে সরকারের নিস্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছে শ্রীলঙ্কার বিরোধী দলগুলো। তাদের অভিযোগ, দাঙ্গায় মোকাবিলায় ব্যর্থতা ঢাকতেই জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে অভিযোগ করেছেন, সরকার ক্যান্ডির সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানে আগ্রহী নয়। তিনি বলেন, ‘এটা কোনও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ফুটে উঠেছে। সরকার তার দায়িত্ব থেকে দূরে সরে গেছে। কেউ এদিকে নজর দিচ্ছে না।’ আরেক বিরোধী দল জানাথা ভিমুক্তি পিরামুনা সরকারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বর্ণবাদ চাষাবাদের অভিযোগ তুলেছে। দলটির এমপি অনুরা দেশনায়েকে পার্লামেন্টে অভিযোগ করেন, সরকার নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই জরুরি অবস্থা জারি করেছে। মানুষের মনের মধ্যে যতদিন বর্ণবাদের চাষ অব্যাহত থাকবে, ততদিন আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব নয়। শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে ১১জন মুসলিম সদস্য রয়েছে। তাদের একজন গৃহায়নমন্ত্রী রিশার্দ বাথিউদ্দিন। তিনি সরকারের কাছে সারাদেশে মুসলিমদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দাবি করেন। এক গুজব থেকে মুসলিমবিরোধী এই দাঙ্গার সূত্রপাত। পর্যটন নগরী ক্যান্ডির মুসলিম মালিকানাধীন দোকানে বৌদ্ধদের খাবারে গর্ভনিরোধক মেশানো হয়েছে; এমন গুজব ছড়িয়ে শুরু হয় অগ্নিসংযোগ।
সহিংসতার মধ্যেই এক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নিহতের খবর আগুনে ঘি ছড়ায়। আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে হামলাকারীরা। ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগ চালানো হয় মুসলমানদের বিভিন্ন স্থাপনায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্যান্ডিতে কারফিউ জারি করে কর্তৃপক্ষ। তবে কারফিউ ভেঙে উচ্ছৃঙ্খল জনতার তাণ্ডব অব্যাহত থাকে। পুড়ে যাওয়া বাড়ি থেকে এক মুসলিমের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা। ক্যান্ডি ছাড়িয়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আরও সংঘাতের আশঙ্কায় মঙ্গলবার দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের ঘটনায় সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কায় মুসলিমবিদ্বেষ বাড়ছিল। জীবন বাঁচাতে কিছু রোহিঙ্গা মুসলিম শ্রীলঙ্কায় আশ্রয় নিলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে দেশটির উগ্রপন্থীরা। গত সেপ্টেম্বরে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বে রাজধানী কলম্বোতে জাতিসংঘের একটি সেফ হাউসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ওপর হামলে পড়ে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। সাম্প্রতিক সহিংসতায় গত কয়েকদিন ধরেই উত্তপ্ত ছিল দেশটির জনপ্রিয় পর্যটন নগরী ক্যান্ডি। গত ফেব্রুয়ারি মাসেও সেখানে বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে সংঘর্ষে পাঁচজন গুরুতর আহত হয়। মুসলমানদের দোকানপাট ও মসজিদে হামলা চালানো হয়। মূলত দীর্ঘদিনের মুসলিমবিদ্বেষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ মাসের গোড়ার দিকে শুরু হওয়া এ দাঙ্গায়।

No comments

Powered by Blogger.