নিষেধাজ্ঞার থোড়াই কেয়ার উত্তর কোরিয়ার

বিশ্বনেতাদের হুমকি-ধমকি কেয়ার না করে পারমাণবিক পরীক্ষা ও কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ায় উত্তর কোরিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া চাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে মৌলিক চাহিদার সঙ্গে যুক্ত কিছু আমদানিপণ্য রয়েছে, আর রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আনার মতো কিছু রপ্তানিপণ্য। এসব পণ্যের আমদানি-রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে উত্তর কোরিয়াকে আহার-বিহারে কোণঠাসা করে ওই কর্মসূচি থেকে বিরত রাখার চেষ্টা চলছে অবিরাম। দেশটির অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিতে যতই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হোক না কেন, বাস্তবে তেমন কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েই চলেছে। পাঁচ বছর ধরে এই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত শুক্রবার দক্ষিণ কোরিয়ার পরিসংখ্যান সংস্থা স্ট্যাটেসটিকস কোরিয়া তাদের বিবৃতিতে জানায়, গত বছর উত্তর কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ৫ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৩৪০ মার্কিন ডলার (১.৪৬ মিলিয়ন ওন) হয়। তাদের এক গ্রাফে দেখা যায়, ২০১১ সালের পর এটাই সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়। সে বছর ৭ শতাংশের বেশি বেড়েছিল। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ায় মাথাপিছু আয় ৩১ দশমিক ৯৮ মিলিয়ন উন, যা উত্তরের তুলনায় ২২ গুণ বেশি। স্ট্যাটেসটিকস কোরিয়া জানায়, ২০১৬ সালে উত্তর কোরিয়ায় জনসংখ্যা ২ কোটি ৪৯ লাখ আর দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা ৫ কোটি ১৩ লাখ ছিল। অতি নিভৃতকামী উত্তর উত্তর কোরিয়া কখনো তাদের সরকারি আর্থিক হিসাব, এমনকি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হারও প্রকাশ করে না। ফলে এর সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। দেশটি কখনো তাদের বাণিজ্যের পরিসংখ্যান জানায় না। তেমনি জানায় না এর সম্পদের পরিমাণ। তবে বিভিন্ন দেশের সরকারি সংস্থা, নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৯১ সাল থেকে উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরে আসছে।
আর এসবের ওপর ভিত্তি করে পর্যবেক্ষকেরা অনুমান করে থাকেন। স্ট্যাটেসটিকস কোরিয়ার প্রতিবেদনে উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়। যেমন গত বছর উত্তর কোরিয়ায় প্রতি ঘণ্টায় ২৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়া প্রতি ঘণ্টায় উৎপাদন ছিল ৫৪০ দশমিক ৪ বিলিয়ন কিলোওয়াট, যা উত্তর কোরিয়ার তুলনায় ২৩ গুণ বেশি। এবার দেখা যাক মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা। উত্তর কোরিয়ার প্রতি ১০০ জনে ১৪ দশমিক ২৬ জন মোবাইল ব্যবহার করে। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিটি মানুষ একাধিক মোবাইল ব্যবহার করে। দক্ষিণ কোরিয়ার মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ৯০ হাজার ২০০ কোটি ডলার, যা উত্তর কোরিয়ার চেয়ে ১৪০ গুণ বেশি। উত্তর কোরিয়ার এই পরিমাণ ৬৫০ কোটি ডলার। গত জুলাইয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক হিসাবে দেখায়, গত বছর উত্তর কোরিয়ার জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ, যা দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ার এ পরিমাণ ২ দশমিক ৮ শতাংশ। এসব তথ্যই প্রমাণ করে, ১৭ বছরে ধরে পিয়ংইয়ংয় দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক অগ্রগগির পথে এগিয়ে চলেছে। দেশটির বর্তমান শাসক কিম জং-উন যতই বলুক না কেন যে তাঁরা কোনো ধরনের সংস্কার করছেন না, কিন্তু এই উন্নয়নের পেছনের অন্যতম কারণ হলো, তাঁরা অর্থনীতিতে বাজারব্যবস্থায় গতি এনেছেন। রাষ্ট্র পরিচালিত কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল ইউনিফিকেশনের একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক হং মিন বলেন, উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাজারব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশটির রেশনিং-ব্যবস্থার পরিবর্তে সেখানকার লোকজন এখন নিজেদের আয়-উপার্জনের জন্য বাজারব্যবস্থার ওপর নির্ভর করছে। তবে সেখানকার বাজারে এখন ‘জোর যার মুল্লুক তার’ অবস্থা। বাজার তৈরিতে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার যে পরিস্থিতি, তা এখনো তৈরি হয়নি। দুর্নীতেতে ভরা তারা। উত্তর কোরিয়ার বড় বন্ধু প্রতিবেশী বিশ্বশক্তি চীন। তাদের সঙ্গেই সবেচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় দেশটির। গত জুলাইয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার-নিয়ন্ত্রিত কোরিয়া ট্রেড-ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সির এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১৬ সালে উত্তর কোরিয়ার ব্যবসার সাড়ে ৯২ শতাংশই হয়েছে চীনের সঙ্গে। উত্তর কোরিয়া চীনে কয়লা, খনিজদ্রব্য, পোশাক ও কিছু খাদ্যসামগ্রী রপ্তানি করে। আর চীন থেকে আমদানি করে পেট্রোলিয়াম, ইস্পাত, যন্ত্রাংশ, গাড়ি ও ইলেকট্রনিকসামগ্রী। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, গত ফেব্রুয়ারিতে চীন প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়া থেকে কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এমনকি সেখানে তেল পাঠানো কিছুটা সীমিত করে। কিন্তু মার্কেটপ্লেসের খবরে বলা হয়, এই নিষেধাজ্ঞার কারণে আট মাস ধরে উত্তর কোরিয়ার তার কয়লা ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ায় বিক্রি করে আসছে। গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকান পাবলিক মিডিয়ার রেডিও প্রোগ্রাম মার্কেটপ্লেসকে কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনসের যুক্তরাষ্ট্র-কোরিয়ার নীতিবিষয়ক কর্মসূচির পরিচালক স্কট স্নাইডার বলেন, ‘আমার যত দূর জানি, আমার মনে হয় না এই অবরোধ খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পেরেছে। এখন মাছ ও পোশাক রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। অথচ এগুলোই এখন উত্তর কোরিয়ার বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস।’ দক্ষিণ কোরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়া গত বছর বহির্বিশ্বের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার রপ্তানি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ রপ্তানির ৭০ শতাংশই এসেছে মৎস্যজাত পণ্য থেকে। স্নাইডার বলেন, ‘আমরা উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শিশুসুলভ খেলা খেলছি। দেশটির জন্য একটি পথ বন্ধ করে দিলে তারা অন্য পথ বের করে নিয়েছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছে। উত্তর কোরিয়ায় যত পণ্য ঢোকে, তা চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমেই আসে। পরমাণু কর্মসূচিকে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম অথবা খাদ্য ও জ্বালানির জন্য চীনের প্রথম সারির কোম্পানি ও চীনের অংশীদারদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। আর এটিই দেশটির অর্থনীতিকে সচল রাখে। এসব নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উত্তর কোরিয়ার তেমন গা না করার আরেকটি কারণ অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে না চাওয়া বলে মনে করেন স্নাইডার। তিনি বলেন, কিম জং-উন নিজের শাসনব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে রাখার একটি উপায় এই পরমাণু কর্মসূচি। এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজের দেশের জনগণের কাছে তাঁর ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। কেননা, তারা যদি ক্ষমতা দেখাতেই চাইত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রুতা ভুলে আলোচনার টেবিলে আসার আমন্ত্রণ জানাত না।
ব্যাংক অব কোরিয়ার এক কর্মকর্তা সিন সিওং বলেন, উত্তর কোরিয়ার এই বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ তাদের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচি। কারণ, এসবের জন্য তাদের নানা ধরনের উপাদান তৈরি করতে হয়। আর এসব উপাদান তাদের জিডিপিতে ভূমিকা রেখেছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৬ সালে উত্তর কোরিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। তবে এর সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা নিশ্চিত নয়। কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক পলিসির প্রধান গবেষক লিম সো-হো বলেন, গত বছরের জারি করা এসব নিষেধাজ্ঞা পিয়ংইংয়ে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারণ, দক্ষিণ কোরিয়া যখনই নিজ দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা স্থাপনের ঘোষণা দেয়, তখনই চীন তাদের দেওয়া কিছু নিষেধাজ্ঞায় ঢিলেমি দেয়। তবে চীন যদি জ্বালানি রপ্তানির হার কমিয়ে দেয়, তাহলে উত্তর কোরিয়ার ভারী শিল্পকারখানা ও উৎপাদন ক্ষেত্রে ঝুঁকির মুখে পড়বে। উত্তর কোরিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২০০০ সালের পর থেকে দেশটি বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিতে নামে। আর এখন দেশটির আয়ের বড় উৎস এটি। পর্যটন খাতও আয়ের একটি ক্রমবর্ধমান উৎস। রাশিয়ার সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম ক্যাসপারস্কির এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সিএনএনের খবরে বলা হয়, গত বছর থেকে দেশটির আয়ের আরও একটি সম্ভাবনাময় উৎস হয়েছে ব্যাংক হ্যাকিং। এ ছাড়া বলা হয়, দেশটির শাসকগোষ্ঠী জোর করে সস্তায় অন্যত্র শ্রমিক পাঠিয়ে তাদের পকেট ভারী করছে। ধারণা করা হচ্ছিল, পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেই উত্তর কোরিয়াকে অনেকটা শায়েস্তা করা যাবে। ঠেকানো যাবে দেশটির পরমাণু কর্মসূচি। কিন্তু এখন সেই দিন মনে হয় আর নেই। ২০১৬ সালে উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। এটি দেশটির প্রতি বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

No comments

Powered by Blogger.