বেকায়দায় পড়েছেন পুতিন

এই ২১ ডিসেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্রেমলিনে রাশিয়ার বিত্তশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। যে মানুষেরা ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ২১৩ বিলিয়ন ডলার, যেটা প্রায় রাশিয়ার ফেডারেল বাজেটের সমান। ফলে পুতিন যে তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বিশেষ করে, আগামী বছর যেহেতু রাশিয়ায় নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যদিও সেটা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কিছু হবে না। এই কিছুকাল আগে পর্যন্ত এ ধরনের বৈঠক বছরে সাধারণত একবারই হতো।
কিন্তু ২০১৭ সালে এই বৈঠক তিনবার হলো। ব্যাপারটা হলো, ক্রেমলিনে এত ঘন ঘন এই বৈঠক হওয়ার উৎসাহ কেন দেখা যাচ্ছে? তবে যাঁরা রাশিয়ার বিত্তশালী গোষ্ঠীর কার্যকলাপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁদের জন্য এটা অনুমান করা কঠিন নয়। নভেম্বরের ২২ তারিখ রাশিয়ার বিত্তশালী ও সিনেটর সুলেইমান কেরিমভকে ফ্রান্সের নিসে শহরে গ্রেপ্তার করা হয়। এখন তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। এরপর ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ রাশিয়ার আলফা ব্যাংকের ডাচ সাবসিডিয়ারি প্রাঙ্গণে তল্লাশি চালিয়ে তাঁর সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়। এই ব্যাংকের মালিক হলো মাইকেল ফ্রিডম্যান, পিওতর আভেন, আলেক্সি কুজমিচেভ ও জার্মান কান গোষ্ঠী, যাদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ৩ হাজার ৫৬০ কোটি ডলার। এ ছাড়া ১৩ ডিসেম্বর ডেইলি বিস্ট–এর এক তদন্তে জানা যায়, সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া এফবিএমই ব্যাংকের সাইপ্রাস শাখায় মিখাইল প্রোখোরভের ২৩টি হিসাব আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যাংকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তুললে ব্যাংকটি লাইসেন্স হারায় এবং গ্রাহকদের হিসাব স্থগিত করা হয়। অন্যদিকে পুতিনের বন্ধু ও ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের মালিক গেনাদি টিমশেঙ্কো ও তাঁর কোম্পানি নোভাটেক এখনো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে আছে। রাশিয়ার সবচেয়ে ধনী মানুষ ও টিমশেঙ্কোর অংশীদার লেওনিদ মিখেলসনকেও নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেওয়া হয়েছে, তিনি আবার নোভাটেকের একজন মালিকও বটে। ভাজিত আলেকপেরভের মালিকানাধীন রাশিয়ার বৃহত্তম বেসরকারি তেল কোম্পানি লুকঅয়েল ও লেওনিড ফেদান এখনো নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছে। আরও কয়েকজন রুশ ধনকুবের নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য তালিকায় আছেন। মোদ্দা কথা হলো, রাশিয়ার ক্ষমতাকাঠামোর প্রায় অর্ধেক বিদেশের মাটিতে বিপদে আছেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র যখন নিষেধাজ্ঞার তালিকা আরও দীর্ঘ করবে, তখন বাকি অর্ধেকও এই তালিকায় চলে আসতে পারে। ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ ধনকুবেরদেরই এই তালিকায় আসার সম্ভাবনা আছে। রাশিয়ার বিরোধী দলের অনেক নেতাই এ ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনকে সহযোগিতা করছেন। একসময় পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকাটা রাশিয়ায় পুঁজি বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হলেও এখন তা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানা গেছে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিষেধাজ্ঞার নতুন তালিকা আসার আগে রাশিয়ার অনেক ধনকুবের ক্রেমলিনের অনুষ্ঠানে পারতপক্ষে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। রাশিয়ার এই ধনকুবেররা পশ্চিমের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তাই নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে এ ধরনের উপলব্ধি বিস্ময়কর কিছু নয়। এই কিছুদিন আগেও আন্তর্জাতিক পরিসরে পুতিন একধরনের দায়মুক্তি ভোগ করতেন। ক্রেমলিন তখন সব ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল, তারা যেমন ইউক্রেন ও সিরিয়ায় সেনা পাঠিয়েছে, তেমনি হ্যাকিং ও ট্রলের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। এমনকি তারা বলকান অঞ্চলের এক দেশে সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোরও চেষ্টা করেছে। প্রথম দিকে পশ্চিমের প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই ধীর ও দুর্বল প্রকৃতির, কিন্তু শেষমেশ তা গতি পেতে শুরু করেছে। তারা এখন নিষেধাজ্ঞার বাইরে যেতে শুরু করেছে। ইউক্রেনে মালয়েশীয় এয়ারলাইনসের বিমান ভূপাতিত হওয়ার ব্যাপারে যে যৌথ তদন্ত দল গঠিত হয়েছে, তাদের তদন্তে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, জানুয়ারিতে তাদের প্রতিবেদনে এক রুশ জেনারেলের দিকে আঙুল তোলা হবে।
রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত যে গ্যাসলাইন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, তা-ও প্রশ্নের মুখে, কারণ এই প্রকল্পের ইউরোপীয় অংশীদারেরা নিজেদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। পুতিন নিশ্চয়ই এর মধ্যে খেয়াল করে থাকবেন যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি প্রকৃত অর্থেই বদলে গেছে। নিশ্চল অর্থনীতি ও আসন্ন বিশ্বকাপ ফুটবল দিয়ে তিনি হয়তো পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা ঝালাই করে নিতে পারবেন। দেখে মনে হচ্ছে, তিনি এক পা পেছনে যেতে রাজি। তিনি ইতিমধ্যে সিরিয়া থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন এবং ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত ডনব্যাস অঞ্চলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছেন। কিয়েভের সঙ্গে বন্দী বিনিময়ের আলোচনাও শুরু হয়েছে। সম্প্রতি ক্রেমলিনের হ্যাকারদের আক্রমণ ও উসকানিমূলক পোস্ট বা ট্রল দেওয়ার প্রবণতাও কমে এসেছে। সম্প্রতি জনগণের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বে পুতিন আগামী মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর কৌশল কী হবে, তা নিয়ে কিছু বলেননি। মনে হয়েছে, এ ধরনের অনুষ্ঠানে তিনি যে বড় ঘোষণা দিয়ে থাকেন, তা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত তাঁর মধ্যে যে আগ্রাসী মনোভাব দেখা যেত, সেদিন সেটা অনুপস্থিত ছিল। যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, তাঁর এই সম্ভাব্য পশ্চাদপসরণের ব্যাপারটা যতটা চাতুরীপূর্ণ হবে, ততটা কৌশলগত হবে না। পশ্চিমা শত্রু না থাকলে পুতিন দেশের ভেতরে নিজের বৈধতার অনেকটাই হারাবেন। তবে এর মানে এই নয় যে রুশ জনগণ যুদ্ধ চায়। সাম্প্রতিক এক জরিপে এর বরং উল্টোটা দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ রুশ জনগণ মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের উন্নয়ন হওয়া জরুরি। তবে এখানে বৈপরীত্য নেই। পুতিন পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলে থাকেন। কিন্তু পশ্চিম বরং রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান শক্তির ব্যাপারে ভীত। তবে তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় বহিঃশত্রু তৈরি ছাড়া পুতিনের পক্ষে সমর্থন সৃষ্টি করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। অর্থাৎ পুতিন ঠিক ততটাই পেছাবেন, পশ্চিম তাঁকে ঠিক যতটা ঠেলে দেবে, এর এক পদক্ষেপ বেশি নয়। ফলে নিষেধাজ্ঞা যে এই পরিপ্রেক্ষিতে শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠেছে, তা আপাতভাবে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যবর্জিত নয়। পুতিন নিজেও অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে অনিশ্চয়তা তৈরি করেন, যেটা এখন পশ্চিম নিজে করছে। তাই ধনকুবেররা তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে চান না।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
রোমান দোবরোখোতোভ: রুশ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.