বিমানবন্দর পার্কিংয়ে গাড়ির পার্টস চুরির হিড়িক

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দুই নম্বর টার্মিনালের সামনের কার পার্কিং এলাকায় দিনের আলোতে এক দিনে ৩০টি গাড়ির গুরুত্বপূর্ণ পার্টস চুরি হয়ে গেছে। রোববার দুপুরে এ দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটে। কর্মরত পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), আনসার, বিমানবাহিনী, অ্যাভসেক ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার চার স্তরের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই এ গণচুরির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা বিমানবন্দরজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। প্রশ্নের মুখে পড়েছে আন্তর্জাতিক এ বিমানবন্দরের ভাবমূর্তিও। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। কেউ কারও কথা শোনেন না। সবাই ব্যস্ত ধান্ধায়! অভিযোগ আছে, এসব বাহিনীর অসাধু ব্যক্তিরাই এ গাড়ির পার্টস চুরি সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। পার্কিং এলাকার ইজারাদার ও দায়িত্বরত সংস্থার অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। এ চক্রটিই বিমানবন্দরের ভেতরে-বাইরে চোরাচালান সিন্ডিকেটকে সহায়তা, চোরাই পণ্য বাইরে বের করে দেয়া ও গাড়ির পার্টস চুরির কাজে সহায়তা করছে। এসব আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে সিভিল এভিয়েশনের কতিপয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটে। অভিযোগ আছে, এ কার পার্কিং এলাকাগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ১০-১২টি গাড়ির পার্টস চুরি হচ্ছে। মানুষ টাকা দিয়ে পার্কিংয়ে গাড়ি রেখেও চুরির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। জামাল নামে একজন ড্রাইভার জানান, রোববার দুপুরে গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ-২২-৭৫৬৯) নিয়ে তিনি বিমানবন্দরের মেসার্স শফিক অ্যান্ড ব্রাদার্সের পার্কিং জোনে যান। সেখানে তিনি গাড়ি রেখে বাথরুমে যান, ৫ মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে দেখতে পান তার গাড়ির দুটি পার্টস নেই। নাজিম নামে একজন ড্রাইভার জানান, তিনি গাড়ি রেখে তার স্যার আসছে কিনা দেখতে ক্যানোপি এলাকায় যান। ৬-৭ মিনিট পরে ফিরে এসে দেখতে পান তার গাড়ির দুটি লুকিং গ্লাস নেই। রহমত নামে অপর একজন ড্রাইভার জানান, গাড়ির ভেতর ঘুমিয়ে ছিলাম, উঠে দেখি গাড়ির একটি লুকিং গ্লাস, দুটি বিট খুলে নিয়ে গেছে। পার্কিংয়ে থাকা একজন ড্রাইভার জানান, ইজারাদারের কতিপয় লোক এ চুরির সঙ্গে জড়িত। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ চক্রের সদস্যদের সবাইকে চেনেন। কিন্তু অভিযোগের ভাগ পাওয়ায় এরা কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, ইজারাদার ও তার লোকজনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলে এ গাড়ির পার্টস চুরির সদস্যদের খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।
অন্যথায় এ ভয়াবহ চুরি দিন দিন বাড়তেই থাকবে। রোববার বিকালে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের মেম্বার (অপস) এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান, শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম, বেবিচকের পরিচালক প্রশাসন সাইফুল ইসলামকে জানানো হয়েছে। এ ঘটনায় তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাড়ির পার্টস চুরির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার ও মালামাল উদ্ধারের জন্য দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ওই পার্কিং এলাকার ইজারাদারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে দায়িত্বে অবহেলার জন্য লিজ বাতিলের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পার্কিং এলাকাটি সিসিটিভির আওতায় আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বেবিচকের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিমের বরাত দিয়ে মেম্বার অপারেশন এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ওই পার্কিংয়ের ইজারাদার মেসার্স শফিক অ্যান্ড ব্রাদার্স। আইন অনুযায়ী তারাই ওই এলাকার রক্ষক। সাধারণ মানুষ টাকা দিয়ে পার্কিংয়ে গাড়ি রাখেন। ইজারাদারের দায়িত্ব হচ্ছে, সব গাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পার্কিং থেকে কোনো গাড়ির পার্টস চুরি হলে ইজারাদারই এ জন্য দায়ী হবেন। এ ঘটনায় অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ইজারাদার কোম্পানির দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি জানান। একই সঙ্গে ওই এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন। জানা গেছে, বিমানবন্দরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এখনও সিসিটিভির আওতার বাইরে। ভিআইপি চেক-ইন পয়েন্টের স্ক্যানারটি দীর্ঘদিন অচল। ৮নং গেটে নেই ভেহিকল স্ক্যানার। এমনকি নেই ম্যানুয়াল স্ক্যানারও। কার্গো গেটের অবস্থাও একই রকম। এয়ারসাইট থেকে গাড়ি বের হচ্ছে কোনো ধরনের চেক ছাড়াই। অথচ গেটে দণ্ডায়মান আনসার, এপিবিএন, বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী থাকলেও তারা অন্য ধান্ধায় ব্যস্ত। তাদের চোখের সামনে দিয়েই অহরহ বের হচ্ছে গাড়ির পর গাড়ি। কোন গাড়িতে কি যাচ্ছে সে সম্পর্কেও নেই কারও কোনো ধারণা। আর সিসিটিভির অবস্থা আরও নাজুক। অভিযোগ আছে, যুক্তরাজ্য থেকে দরপত্র ছাড়াই সিকিউরিটি কোম্পানি রেডলাইন ২ বছর নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ দায়িত্ব পালন করার পরও রয়ে গেছে নিরাপত্তার ফাঁকফোকর। যে কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না চোরাচালান ও গাড়ির পার্টস চুরি। মাঝে মাঝে আস্ত গাড়িও হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এ ত্রুটি যে আসলেই উদ্বেগের সেটা স্বীকারও করেছেন খোদ শাহজালালের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম। বলেছেন, এ অবস্থায় চোরাচালান চেক দেয়া শতভাগ সম্ভব নয়। যদিও চোরাচালান প্রতিরোধের দায়িত্ব কাস্টমসের।

No comments

Powered by Blogger.