ট্রাম্পের ঘটনাবহুল এক বছর by মিসবাহুল হক

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক বছর পূর্ণ করতে চলেছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারণার সময়েই বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে সমালোচিত হন তিনি। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পরেও সেই ধারা অব্যাহত থাকে। তার বিভিন্ন বিতর্কিত পদক্ষেপ দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এক বছরে ট্রাম্পের আলোচিত ও সমালোচিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
২০শে জানুয়ারি: দায়িত্ব গ্রহণ
এ বছরের ২০শে জানুয়ারি ডনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি বৈদেশিক বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করার ঘোষণা দেন।
তার মতে, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাবে। পাশাপাশি বিভিন্ন চুক্তিতে সহযোগী দেশের ঘাটতির দায় থেকে মুক্তি পাবে যুক্তরাষ্ট্র।
২৩শে জানুয়ারি: টিপিপি চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২৩শে জানুয়ারি ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এশিয়া নীতির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রসহ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১২টি দেশ টিপিপি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তির প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা। এই লক্ষ্যে দেশগুলোর মধ্যে বিনা শুল্কে বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু করা হয়।
২৭শে জানুয়ারি: ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা
এদিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বহুল আলোচিত একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। যার মাধ্যমে মুসলিমপ্রধান ছয়টি দেশের নাগরিকদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশটি পরে কয়েক দফা সংশোধন করা হয়। তবে ওয়াশিংটনের আদালত এই আদেশ আংশিকভাবে স্থগিত ঘোষণা করে। একই সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিবাসন বিষয়ক আরো দুটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। একটিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের নির্দেশনা দেন। অন্যটিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অভিবাসীদের রাষ্ট্রীয় সহায়তা সীমিত করা হয়।
৭ই এপ্রিল: সিরিয়া আক্রমণ
সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায় দেশটির শায়রাত বিমান ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ৭ই এপ্রিল এই হামলার অনুমতি দেন ট্রাম্প। তবে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে রাশিয়া। উল্লেখ্য, সিরিয়া যুদ্ধে সরকারি বাহিনীকে সহায়তা করে রাশিয়া।
১৮ই মে: নাফটা চুক্তির আধুনিকায়ন
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (নাফটা) চুক্তি আধুনিকায়ন করার নির্দেশনা দেন। বাণিজ্যবিষয়ক মার্কিন দূত লাইথিজার নাফটা চুক্তি আধুনিকায়নের বিষয়ে হোয়াইট হাউজের মনোভাব কংগ্রেসে উত্থাপন করেন। এই চুক্তির অন্য দুই অংশীদার হল মেক্সিকো ও কানাডা। ১৯৯৪ সালে নাফটা চুক্তি কার্যকর হয়। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনতে চুক্তি পুনরালোচনা করার মনোভাব ব্যক্ত করেন তিনি।
২০-২৭শে মে: ট্রাম্পের প্রথম বিদেশ সফর
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম-বারের মতো বিদেশ সফরে যান ট্রাম্প। ২০-২৭শে মে সৌদি আরব, ইসরাইল, পশ্চিম তীর, ইতালি, ভ্যাটিকান সিটি ও বেলজিয়াম সফর করেন তিনি। রিয়াদে আরব ও মুসলিমপ্রধান দেশের নেতাদের সম্মেলনে অংশ নেন ট্রাম্প।
১লা জুন: প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়
জুন মাসের প্রথম দিনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৮৮টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর আওতায় বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি এমন পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
৫ই জুন: কাতার সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
কাতার সন্ত্রাসবাদের মদদ দিচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে ৫ই জুন দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের হঠকারিতায় দেশটি সমর্থন দিচ্ছে এমন অভিযোগও তোলা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রাথমিকভাবে এই অবরোধে সমর্থন দেন। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিস কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে সচেষ্ট হন।
১৬ই জুন: কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক
প্রেসিডেন্ট ওবামা তার শাসনামলে কিউবার সঙ্গে উদার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। কিন্তু এ বছরের ১৬ই জুন ট্রাম্প ওবামা প্রশাসনের নীতির অবসান করে দেশটির ওপর ভ্রমণ ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তবে কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক বহাল রাখা হয়।
৫ই জুলাই: ট্রাম্প-পুতিন সাক্ষাৎ
জার্মানিতে জি-২০ সম্মেলনে অংশ নেন ট্রাম্প। সম্মেলনের ফাকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর এটিই ট্রাম্প ও পুতিনের প্রথম বৈঠক। গত বছরের মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠায় দুই বিশ্ব নেতার এ বৈঠক ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পকে জেতানোর পিছনে রাশিয়ার হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়েছে। এর আগে ওয়ারশোতে বক্তব্য দেন ট্রাম্প। সেখানে প্রথমবারের মতো ন্যাটোর সদস্য দেশুগুলোর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নীতির বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেন তিনি।
৮ই আগস্ট: উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বাকযুদ্ধ
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বাকযুদ্ধ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এক বছরের শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পিয়ংইয়ং যুক্তরাষ্ট্রের গুয়াম দ্বীপে ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করার হুমকি দেয়। প্রতিক্রিয়ায় ৮ই আগস্ট ট্রাম্প উত্তর কোরিয়াকে সতর্ক করে বলেন, দেশটি যদি এই ধরণের হুমকি দেয়া অব্যাহত রাখে তাহলে তাদেরকে ‘আগুন ও বারুদের’ জবাব দেয়া হবে। মূলত এই হুমকি থেকেই উত্তর কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র হুমকি আদান-প্রদান শুরু হয়। দুই দেশের বাকযুদ্ধ এখনো চলছে।
৫ই সেপ্টেম্বর: ওবামার অভিবাসন নীতি বাতিল
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বহুল আলোচিত ডিফারড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভালস (ডিএসিএ) নীতি বাতিল করেন। ২০১২ সালে বারাক ওবামা এই নীতি চালু করেছিলেন।
১৩ই অক্টোবর: ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি
ছয় বিশ্ব শক্তি ও ইরানের মধ্যে ২০১৫ সালে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন টু কংগ্রেস (জেসিপিওএ) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে পারমাণবিক কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনার বিনিময়ে ইরানকে অর্থনৈতিক অবরোধ থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
৬ই ডিসেম্বর: জেরুজালেম ঘোষণা
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কয়েক শতকের মার্কিন নীতি লঙ্ঘন করে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি দাবি করেন, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তিনি মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশনা দেন। তার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরব হয়েছে গোটা বিশ্ব। মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির জরুরি অধিবেশন বসে তুরস্কে। এতে ট্রাম্পের জেরুজালেম ঘোষণা প্রত্যাখান করে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মুসলিম নেতারা ট্রাম্পের ঘোষণাকে বিপজ্জনক আখ্যা দেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ট্রাম্পের ঘোষণার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। কয়েকটি দেশ ছাড়া সবগুলো দেশই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তে অবিচল। দেশটি তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত প্রকাশকারী দলগুলোকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.