‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ বজায় রাখতে হবে : আ ন ম মনিরুজ্জামান

প্রথম আলো * ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক বিষয়ে চীনা মনোভাব নজরে পড়েছে কি?
আ ন ম মুনিরুজ্জামান * ওই সমঝোতা স্মারকের বিস্তারিত জানা যায়নি। আর চীনা প্রতিক্রিয়া আপাতত পরিষ্কার নয়। তবে তাদের সরকারি বা আধা সরকারি গ্লোবাল টাইমস বলেছে, চীনের দক্ষিণ এশীয় প্রভাবকে ভারত খর্ব করতে চাইলে চীন তা প্রতিহত করবে।
প্রথম আলো * বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস অ্যাগ্রিমেন্ট (সোফা) সই করতে গেলে ভারত প্রতিবাদ করেছিল। আবার রাশিয়ার কাছ থেকে মিগ-২৯ কেনার সময় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। কিন্তু এবার যুক্তরাষ্ট্র নীরব। মুনিরুজ্জামান* তারা একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। তবে এই অঞ্চলে তাদের স্বার্থে বাধা এলে তারা বাধা দেবে।
প্রথম আলো * অনেকের মতে, দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সঙ্গে যৌথ মহড়া ও প্রশিক্ষণের মতো সামরিক সহযোগিতা চলে আসছিল, তাকেই এবার লিখিত রূপ দেওয়া হয়েছে। দুই দেশের প্রতিরক্ষা কলেজের মধ্যে চুক্তি হয়েছে।
মুনিরুজ্জামান* যে সমঝোতা হয়েছে, তার একটা আঞ্চলিক নিরাপত্তাগত মাত্রা রয়েছে। বিশেষ করে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর সেটা একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। এনডিসি ও ডিফেন্স স্টাফ কলেজের মধ্যে আরও অন্তত ১০টি দেশের সঙ্গে ছাত্র বিনিময় চলছে। তাই ভারতের সঙ্গে কেন চুক্তি করতে হলো, সেটাই প্রশ্ন। সামরিক চিন্তাচেতনায় যদি অন্য কারও প্রভাব পড়ে, সেটা আমাদের জাতীয় সামরিক স্বার্থের পক্ষে যাবে না।
প্রথম আলো * চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক ও ‘কৌশলগত অংশীদারত্বের’ সম্পর্ক থাকতে পারলে, ভারতের সঙ্গে একই ধরনের চুক্তি নয় কেন?
মুনিরুজ্জামান* চীন-বাংলাদেশ সামরিক সহযোগিতা আর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক মৌলিকভাবে আলাদা। ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা একটি সম্ভাব্য চীন-ভারত সংঘাত অরুণাচল প্রদেশকে নিয়ে দেখতে পান। তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সাহায্য ছাড়া তেমন একটি সংঘাতে জয়ী হওয়া ভারতের জন্য কঠিন হবে। এ কারণে নতুন প্রতিরক্ষা সমঝোতার অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে, তেমন সংঘাতে ভারতের পক্ষে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ফেলা। সে কারণেই এ রকম চুক্তি জাতীয় স্বার্থে একেবারেই সমীচীন নয়, বরং ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রথম আলো * অরুণাচল ভারতের অংশ হওয়ার পর চীন বলেছিল, তারা কোনো দিনই এটা মানবে না। ভারত ও চীনের মধ্যে এ ধরনের অনেক বিরোধ থাকা সত্ত্বেও তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্কের উন্নয়ন ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে চলেছে।
মুনিরুজ্জামান* এটা চীন সরকারের ঘোষিত জাতীয় নীতি। তারা বলেছে, এ ধরনের বিরোধ অমীমাংসিত থাকলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে বাধা হবে না।
প্রথম আলো * আপনি কি মনে করেন যে ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি হওয়ার কারণে চীন অবশ্যই বাংলাদেশবিরোধী একটা অবস্থান নিতে পারে?
মুনিরুজ্জামান* সেটা না-ও ঘটতে পারে। কারণ, বাংলাদেশে তাদের যে ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য স্বার্থ রয়েছে, তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক বেশি। বিশেষ করে তাদের ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্ব রয়েছে। কিন্তু তাই বলে এর বিভিন্নমুখী নেতিবাচক প্রভাব নাকচ করা যাবে না।
প্রথম আলো * ভারতের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কি লাভবান হতে পারে না?
মুনিরুজ্জামান* না, আমি মনে করি, সেই বিষয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে। কারণ, ক্ষুদ্র প্রতিবেশী তার বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে এ ধরনের যত বেশি চুক্তিতে যাবে, ততই তার ‘ম্যানুভারিং স্পেস’ সংকুচিত হবে বা বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে। এতে জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই ভারতের সঙ্গে এ ধরনের কোনো সামরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া আমাদের উচিত নয়।
প্রথম আলো * তাহলে চীনের সঙ্গে কেন উচিত?
মুনিরুজ্জামান* ভারত তিন দিক থেকে বাংলাদেশকে বেষ্টন করে আছে। এ কারণে তার সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ অন্যান্য দেশ থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য।
প্রথম আলো * ভারতের সঙ্গে যে সামরিক সমঝোতা হয়ে গেছে, তার কোনো সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব এড়ানোর উপায় কী?
মুনিরুজ্জামান* বাংলাদেশকে অবশ্যই তার স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি বা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে হবে।
প্রথম আলো * ৫০ কোটি ডলারের ঋণের যে চুক্তি হয়েছে, তার আওতায় বাংলাদেশ কী ধরনের সুবিধা পেতে পারে?
মুনিরুজ্জামান* ওই চুক্তির আওতায় কী ধরনের ভারতীয় সরঞ্জাম বাংলাদেশে আনা হবে, তা আমার জানা নেই। তবে ভারত একটি অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। উপরন্তু তারা তাদের অস্ত্রের গুণগত মান সম্পর্কে সুনাম অর্জন করতে পারেনি।
প্রথম আলো * ভিয়েতনামের সঙ্গে ভারত সম্প্রতি একইভাবে ৫০ কোটি ডলারের একটি ঋণচুক্তি সই করেছে। ভিয়েতনামের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চুক্তি সই করার মধ্যে কোনো মিল-অমিল দেখতে পান কি?
মুনিরুজ্জামান* ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের মধ্যে এ ক্ষেত্রে তুলনা করার আদৌ কোনো সুযোগ নেই। বরং বাস্তবতা হলো, দক্ষিণ চীন সমুদ্রে ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের প্রকাশ্য বৈরিতা রয়েছে। সুতরাং ভারত চীনের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছে, এমন একটি দেশের সঙ্গে ওই ঋণচুক্তি করেছে। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই বিপরীত। কারণ, চীনের প্রতিরক্ষা প্রতিনিধিদল যখন ঢাকা সফর করেছে, তখন বাংলাদেশ তাদের আশ্বস্ত করেছে যে দক্ষিণ চীন সমুদ্রে নেওয়া চীনের নীতির প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন রয়েছে।
প্রথম আলো * আপনাকে ধন্যবাদ।
মুনিরুজ্জামান* আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.