ক্ষুব্ধ ও হতাশ ১৪ দলের শরিকরা

হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ এবং তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদকে স্নাতকোত্তর মর্যাদা দেয়ার ঘোষণায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বেশিরভাগ শরিক। শরিক দলের নেতারা বলছেন, আমরা একদিকে একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলছি, অন্যদিকে একেক ধরনের মাদ্রাসার জন্য একেক ধরনের আইন করার মধ্য দিয়ে একই দেশে বহু ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছি- যা সুখকর নয়। এ সিদ্ধান্ত দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও পেছনে ফেলে দেবে।
তারা আরও বলেন, হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মাশ্রয়ী দল ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা এবং তাদের সঙ্গে আপস করা হলে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের চেতনাবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। জোটের শরিক দলগুলো মনে করছে, হেফাজতে ইসলামের দাবি ও চাপের মুখে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বেশকিছু সংশোধনী আনা, সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ১১ এপ্রিল গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক এবং ওই বৈঠকে শর্তহীনভাবে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদকে স্নাতকোত্তর মর্যাদা দেয়ার ঘোষণা, সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরানোর দাবির প্রতি সমর্থন- প্রভৃতি ঘটনা ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্পর্কোন্নয়নেরই অংশ। বিশেষ করে ঢাকার শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারি দলের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছিল, সে বিশ্লেষণটি সামনে রাখলে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সাম্প্রতিক মেলবন্ধন অনেকটা অস্বাভাবিক। একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্বার্থে নতুন সম্পর্ককে আরও সৃদৃঢ় করতেই শাসক দলটির পক্ষ থেকে নেয়া নানা উদ্যোগও ক্রমেই দৃশ্যমাণ হচ্ছে। তবে ভোটের রাজনীতিতে এ উদ্যোগের সুফল ঘরে তোলা নিয়ে প্রশ্ন আর সন্দেহের শেষ নেই জোট শরিকদের। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ। এ ঘটনা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বাম প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একসময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
এ জোটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং তাকে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়া। এ লক্ষ্য নিয়ে ১৪ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন ও ক্ষমতায় এসে সরকার পরিচালনা করছে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতার অর্থ হবে দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া। এতে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ ফজলে হোসেন বাদশা জানান, ১৯ এপ্রিল দলের পলিটব্যুরোর সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে ওয়ার্কার্স পার্টির অবস্থান পরিষ্কার করা হবে। তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা শিক্ষা বোর্ড গঠনের কোনো অর্থ নেই। তারা তো মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনেই থাকতে পারে। আর একেক ধরনের মাদ্রাসার জন্য একেক আইন কেন হবে? জানা গেছে, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদকে স্নাতকোত্তর মর্যাদার ঘোষণা দেয়া নিয়ে ১৪ দলীয় জোটের অন্য শরিক দলগুলোর মধ্যেও অস্বস্তি কাজ করছে। সরকারের এ অবস্থানকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন না তারা। শরিক নেতারা বলেন, ধর্মাশ্রয়ী দল সংগঠনগুলোর এ ধরনের দাবি মেনে নেয়া হলে আগামীতে তারা আরও অনেক বিষয়ে অগ্রসর হতে পারে, যা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা এবং বাংলাদেশের ভিত্তিতে আঘাত করবে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি বলেন, ‘হেফাজত গোষ্ঠীকে ছাড় দেয়া হলে তারা আবারও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। 
এ গোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধে।’ ওয়ার্কার্স পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পলিটব্যুরোর আনিসুর রহমান মল্লিক বলেন, ‘হেফাজতের দাবি মেনে যা যা করা হচ্ছে, এতে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি মদদ পাবে।’ গণতন্ত্রী পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুর রহমান সেলিম বলেন, ‘এতে করে সাম্প্রদায়িক শক্তি উৎসাহিত হবে। যারা এ দেশকে সাম্প্রদায়িক দেশ বানাতে চায়, তারা দিবাস্বপ্নের মধ্যে আছে। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।’ ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এনামুল হক বলেন, ‘হেফাজতের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসা ঠিক হয়নি। তারা কখনও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করবে না। এর সুফল আওয়ামী লীগের ঘরে উঠবে না।’ জাসদের আরেক অংশের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান এমপি বলেন, হেফাজতের সঙ্গে আপস দেশকে অন্ধকার যুগে ঠেলে দেবে। কমিউনিস্ট কেন্দ্রের যুগ্ম আহ্বায়ক অসিত বরণ রায় বলেন, এ ঘটনা সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তিকে আরও উৎসাহিত করবে।

No comments

Powered by Blogger.