গ্রীষ্মের শুরুতেই ডায়রিয়ার প্রকোপ

 রাজধানীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) বাইরে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারী করছেন গাজীপুর থেকে আসা আফজাল হোসেন। তিনি জানান, গতকাল (শনিবার) থেকে তার নাতনি বমি আর পাতলা পায়খানা করছিল। প্রাথমিকভাবে বাড়িতে স্যালাইন পানি খাওয়ালেও সুস্থ্য হয়নি। পরে এক প্রতিবেশীর পরামর্শে নাতনিকে মেয়ে-জামাইসহ কলেরা হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। তার নাতনি বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছে, শরীরের অবস্থা আগের চাইতে ভালো, স্যালাইন ও পথ্য চলছে। বৈশাখ মাস আসতে না আসতেই হঠাৎ করেই গ্রীষ্মের তাপদহ শুরু হয়ে গেছে। রাজধানীসহ সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ এবং পেটের পীড়া। যেমন- ডায়রিয়া, বমি, পাতলা পায়খানা, আমাশয় ও কলেরায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গরমের তীব্রতায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। বিগত কয়েক দিনে সারাদেশে তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এপ্রিলের শেষ দিকে তাপমাত্রা আরও বাড়বে । বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আবহাওয়া সহনীয় মাত্রায় না থাকলে অন্য বছরের তুলনায় চলতি বছর পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হঠাৎ গরম বেড়ে যাওয়ায় লোকজন রাস্তার খাবার বিশেষ করে শরবত ও নানা ধরনের পানীয় পান করছেন। বাসাবাড়ির পানির উৎস, রাস্তার ও হোটেলের বাসি-পচা দূষিত খাবার থেকে ডায়রিয়া ছড়াচ্ছে।
আইসিডিডিআরবিতে প্রতিঘণ্টায় ভর্তি হচ্ছে গড়ে ২২ জন
রাজধানীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) বা কলেরা হাসপাতালে প্রতিঘণ্টায় ভর্তি হচ্ছেন ২২ জন। ভর্তি রোগীদের সবাই গরমের কারণে পানিবাহিত নানা রোগবালাইয়ে আক্রান্ত। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১১ এপ্রিল হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৩৩ জন, এরপর ১২ এপ্রিল ৪৯৪ জন, ১৩ এপ্রিল ৪৮৫ জন, ১৪ এপ্রিল ৪৭০ জন এবং ১৫ এপ্রিল শনিবার হাসপাতালটিতে ভর্তি হন ৫৩৯ জন যা বিগত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভর্তি হন ২১২ জন। অর্থাৎ হাসপাতালটিতে প্রতিঘণ্টায় ভর্তি হচ্ছেন ২২ জন রোগী! রোগীদের অধিকাংশই ডায়রিয়া বা কলেরায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গরম যত বাড়বে রোগীর সংখ্যা ততই বাড়তে থাকবে বলে আশঙ্কা করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে রোগীর অতিরিক্ত চাপ সামলাতে হাসপাতালটি সদা প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক এবং হাসপাতাল প্রধান ডা. আজহারুল ইসলাম খান। ডা. আজহারুল ইসলাম খান বলেন, গরমের কারণে পানিবাহিত রোগের প্রবণতা বেড়েছে। তাই আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে। বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে আমরা প্রস্তুত। রোগীর সংখ্যা বেশি হলে প্রয়োজনে হাসপাতালের সামনে তাঁবু টাঙিয়ে অস্থায়ীভাবে শয্যাসংখ্যাও বাড়ানো হবে। তবে ডায়রিয়াজনিত কারণে কোনো রোগীর মৃত্যুর ঘটনা এখনও ঘটেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি জানান, বারান্দাসহ আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে ৬৫০ জন রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। এর বেশি হলেই হাসপাতালের সামনের ফাঁকা অংশে তাঁবু টাঙিয়ে সবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। মহাখালীর এ হাসপাতালটির টিসি ওয়ার্ডে কথা হয় সাভার থেকে আসা গৃহবধূ আফরোজা আক্তারের সঙ্গে। পরম মমতায় যিনি শিশু সন্তানের সেবা করছিলেন। তিনি বলেন, গতকাল সকাল থেকে তার দেড় বছর বয়সী সন্তান রিমি’র বমি শুরু হয়। সেই সঙ্গে খিঁচুনি আর পাতলা পায়খানা। স্থানীয় এক চিকিৎসকের পরামর্শে মহাখালীর কলেরা হাসপাতালে আসছি। তার চিকিৎসা চলছে, এখন সে কিছুটা সুস্থ। ডায়রিয়াল ডিজিজ ইউনিট প্রধান ডা. আজহারুল ইসলাম খান বলেন, আমাদের দেশে মার্চ-এপ্রিল এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বরকে ডায়রিয়ার পিক সিজন ধরা হয়। গত সপ্তাহ থেকে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। ঘনবসতিপূর্ণ এসব এলাকার মানুষ মূলত বিশুদ্ধ পানির সংকটের কারণেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া অতিরিক্ত গরমের কারণে খাবারে দ্রুত পচন ধরছে। সেই খাবার খেয়েও অনেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক সময় গরমে অতিষ্ঠ মানুষ রাস্তাঘাট ও ফুটপাতে অস্বাস্থ্যকর শরবত পান করেও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এই গরমে সুস্থ থাকতে হলে বেশি করে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। খোলা বা বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। রাস্তা বা ফুটপাতের সরবত ও এ ধরনের পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ডায়রিয়া হলে যেহেতু শরীর থেকে পানি চলে যায় এবং গরমের কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই কেউ আক্রান্ত হলে খাবার স্যালাইন খাওয়ানো অব্যাহত রাখতে হবে। রোগী যদি দুর্বল হয়ে পরে তাই যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
প্রতিবছর বিশ্বে ৫ লাখ মৃত্যু
চলতি মাসের ১৩ তারিখ বৃহস্পতিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় দুইশ’ কোটি মানুষ দূষিত পানি পান করছে। বিশ্বব্যাপী মানুষের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিতকরণ এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন প্রয়োজন। নিরাপদ পানি নিশ্চিতকরণে বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর প্রতিটি রাষ্ট্রকে জোর দিতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি বলছে, প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ দূষিত পানি পানের ফলে পানিবাহিত রোগে মারা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান মারিয়া নেইরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, বর্তমানে প্রায় দুইশ’ কোটি মানুষ মলমূত্র দ্বারা দূষিত পানি পান করছে। এর ফলে কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড এবং পোলিওর মতো রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। দূষিত পানির কারণে ডায়রিয়াজনিত রোগে প্রতিবছর ৫ লাখ মানুষ মারা যায় এবং অন্যান্য আরও কঠিন সব রোগে আক্রান্ত হয়। দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় মতো ডায়রিয়া থেকে সাবধান না হলে এবং বিশুদ্ধ পানি পানের বিষয়টি নিশ্চিত করা না গেলে বাংলাদেশেও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি
সুস্থ থাকতে যেমন শরীরে ভিটামিন ডি-এর প্রয়োজন তেমনি সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সান প্রটেকশন ছাড়া সারা বছরই সকাল ১০টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত সরাসরি সূর্যের তাপ গ্রহণ না করাই উত্তম। যারা রোদে কাজ করেন তাদের ত্বকের কোষে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সূর্যালোকে বেশি থাকলে ত্বকের অকাল বার্ধক্য দেখা দিতে পারে। চিকিৎসাবিদ্যার পরিভাষায় একে ফটো এজিং বা রোদজনিত বার্ধক্য বলা হয়। ত্বকে এই অকাল বার্ধক্যের ছাপ হিসেবে ত্বকের বলীরেখা বাড়তে পারে। ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হতে পারে ও ত্বকের রঙের পরিবর্তন ঘটতে পারে।
শরবতের নামে বিক্রি হচ্ছে বিষ
গরমে পিপাসা মেটানোর জন্য অনেকেই রাস্তার পাশের অস্বাস্থ্যকর ঠাণ্ডা পানি বা শরবত পান করছেন। গরমের এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। অস্বাস্থ্যকর-নোংরা উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয় এসব পানি। আর পানিতে ব্যবহার করা বরফও নোংরা উৎসের। তাই শরবতের নামের এসব বিষ খেয়ে অসুস্থ হচ্ছেন অনেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অস্বাস্থ্যকর শরবত খেয়ে ডায়রিয়া, হাম, জলবসন্ত, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-বি এবং সি’সহ পেটের নানারকম রোগ দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে লিভার ও কিডনির। পানীয়টাকে মুখরোচক করার জন্য ব্যবসায়ীরা এতে যোগ করেন নানারকম রং আর স্যাকারিন। যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে দূষিত খাদ্য খেয়ে ও পানি পান করে প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় ২০ লাখ মানুষ মারা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ জানান, প্রকৃতিতে তাপমাত্রার সঙ্গে বাতাসের আর্দ্রতা বেশি। ফলে পানিশূন্যতা তৈরি হচ্ছে। পিপাসা মেটাতেই বাইরে পানীয় বা অন্য খাবার খাচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। বাইরের খোলা জায়গার এসব পানীয় বা খাবারের অধিকাংশই দূষিত। দূষিত পানি পানের কারণে এ বছর ইতোমধ্যেই ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়াও দূষিত পানি এবং পচা-বাসি খাবার খেয়ে অনেকে জন্ডিস, টাইফয়েডসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.