জামায়াতি বিএনপি বনাম হেফাজতি আওয়ামী লীগ!

এদেশের মানুষ এতটা শংকিত হতো না যদি বিতর্কের প্রথম পক্ষ আওয়ামী লীগ না হতো। যে দল জন্মলগ্নের সাম্প্রদায়িক গন্ধ তাড়াতে ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের আগে আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘মুসলিম’ শব্দ উঠিয়ে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়েছিল। আইয়ুব আমলে অসাম্প্রদায়িক আদর্শ সামনে রেখেই আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে অসাম্প্রদায়িক আদর্শই আওয়ামী লীগকে শক্তি জুগিয়েছিল মুসলিম লীগকে পরাস্ত করতে। আর মহান মুক্তিযুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ছিল মূলনীতির অন্যতম। আবার ১৯৭৫-এর পর থেকে প্রতিপক্ষ বিএনপির সমালোচনা করেছে আওয়ামী লীগ দলটির পাকিস্তানপন্থার কারণে। ধর্মীয় মৌলবাদী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধায় বিএনপিকে কঠিন সমালোচনা করেছে আওয়ামী লীগ। ২০১৩-এর ৫ মে শাপলা চত্বরে তাণ্ডব করার পর আওয়ামী লীগ নেতারা এ মৌলবাদী দলটির কঠিন সমালোচনা করেছিলেন। এদেশের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার সাধারণ মানুষ রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের কাছেই খুঁজেছে আশ্রয়। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগকে এ একটি কারণেই সহ্য করে আসছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে নানা কার্যকরণ সূত্রে হেফাজতে ইসলামের মতো একটি কট্টর ইসলামী মৌলবাদী দলের সঙ্গে সমঝোতা হওয়ায় সবাই যেন হোঁচট খাচ্ছে। তাই চারদিক থেকে ক্ষুব্ধতা ও হতাশা প্রকাশ পাচ্ছে। অবশ্য ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হেফাজতের সঙ্গে কোনো সমঝোতার কথা অস্বীকার করেছেন। আমরা এ আওয়ামী লীগ নেতার কথায় আস্থা রাখতে চাই। তাতে হয়তো আশঙ্কা আর হতাশা বয়ে বেড়াতে হবে না। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, ঘটে যাচ্ছে, তাতে মানুষ আশ্বস্ত হতে পারছে না। জনাব কাদেরের কথা মানলে বুঝতে হবে সব ঘটনাই কাকতালীয়। ঘটনাক্রমে শুধু মিলে যাচ্ছে। সচেতন মানুষ এখন শাপলা চত্বর আর বায়তুল মোকাররম অঞ্চলে হেফাজতি তাণ্ডব-উত্তর সব ঘটনা মেলাতে চেষ্টা করছে। প্রেক্ষাপটটা অবশ্য পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে। নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে এদেশের মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিল। আর আওয়ামী লীগ নেতারা হয়েছিলেন দিকভ্রান্ত।
তখন ক্ষমতার শক্তিতে জন্ম নেয়া বিএনপিকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আর এ ভ্রান্তির কারণেই অহেতুক তারা বঙ্গবন্ধুকে নামিয়ে এনে জিয়াউর রহমানের প্রতিপক্ষ করে বঙ্গবন্ধুকে জিতিয়ে দেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এ বিশাল মানুষটিকে কতটা টেনে নামানোর চেষ্টা হল তা বুঝতে চাইলেন না। হতাশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে নিয়ে ভালোই খেলেছিলেন তখন বিএনপি নেতারা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগেই বিএনপি জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক বানাতে পারল। ১৫ আগস্টকে বেগম জিয়ার নতুন জন্মদিন বানাতে পারল। সম্ভবত দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে একটি বিএনপিভীতি কাজ করেছে। শাপলা চত্বরে হেফাজতের বিপুল সংঘশক্তি এবং বিএনপির প্রকাশ্যে হেফাজতকে সমর্থন দেয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। বিএনপি যাতে এ সংঘশক্তিকে কাছে না পায় সেজন্য তৎপর হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগ নেতারা। শক্ত হাতে শাপলা চত্বরে হেফাজতকে দমন করতে পারলেও সতর্ক হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি সামনে রেখে জন্ম হয় গণজাগরণ মঞ্চের। গণজাগরণ মঞ্চের তারুণ্যের শক্তি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। এক পর্যায়ে হেফাজতের প্রতিপক্ষ হয়ে পড়ে গণজাগরণ মঞ্চ। এর মধ্য দিয়ে হেফাজত নারীনীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য তুলে আবার আন্দোলনের হুমকি দেয়। দু-একজন নারী সাংবাদিক সে সময় লাঞ্ছিতও হন। সম্ভবত এ সময় থেকে সতর্ক হয়ে পড়ে সরকার। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা হয়তো এসময় থেকেই হেফাজতের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় চলে আসেন। দারুণ নৈপুণ্যে গণজাগরণ মঞ্চকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়। হেফাজত সন্তুষ্ট হয়। সরকারও সম্ভবত কিছুটা নিরাপদবোধ করে।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের অনুমোদন ও নীতিনির্ধারকদের মন্তব্য হেফাজতের সুরের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। তাই চারদিক থেকে নানা প্রতিবাদ ও হতাশা প্রকাশ পাচ্ছে। তবে আমরা আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য মতোই মনে করতে চাই সরকার নিষ্পাপ; যা ঘটছে সব কাকতালীয়। যখন অভিজ্ঞ মহল কথা তুলছিল, কওমি মাদ্রাসাগুলোর কারিকুলাম সংস্কার করে আধুনিক করা প্রয়োজন, তখনই হেফাজত দাবি তুলে মূল ধারার জাতীয় শিক্ষাক্রম তাদের অভিরুচি মতো মৌলবাদী চরিত্রে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। আর আমরা লক্ষ্য করলাম কাকতালীয়ভাবে অসম্ভব সম্ভব হয়ে উঠল। স্কুলপাঠ্য টেক্সটবুক বোর্ডের বই হেফাজতের দাবির প্রতিফলনে পুনর্বিন্যাসিত হল। হেফাজতের দাবি মতো দেশের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে কওমি মাদ্রাসার কারিকুলামে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মর্যাদা দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়া হল। আমাদের সাধারণজ্ঞান বলে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণীর সিলেবাস অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাঠদানের জন্য যোগ্য শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো আছে কিনা এসব নির্ধারণ করতে হয়। এ কারণে কওমি মাদ্রাসার জন্য এত বড় সিদ্ধান্তের আগে প্রয়োজন ছিল বিশেষজ্ঞ কমিটির পর্যবেক্ষণ ও অনুমোদন। আমরা জানি না এসব জরুরি বিষয় নিষ্পন্ন করে অমন সিদ্ধান্ত হল কিনা। হেফাজত দাবি তুলল সুপ্রিমকোর্টের সামনে সংস্থাপিত ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি সরাতে হবে। আমরা ক’বছর আগে বিমানবন্দরের কাছে সড়ক দ্বীপের লালন ভাস্কর্য ভাঙার হেফাজতি উন্মাদনা দেখেছিলাম। মনে আছে, সে সময় ইসলামী ধর্মাদর্শ ব্যাখ্যা করে মূর্তি আর ভাস্কর্যের পার্থক্যটি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখে; কিন্তু দেখেছিলাম যারা মূর্তি আর ভাস্কর্যের ফারাক না বুঝে রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীস্বার্থ অর্জনের জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাদের দাবির কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিল সরকার। এতকাল পর আবার একই দৃশ্যের অবতারণা; কিন্তু এবার কাকতালীয় হলেও বলতে হবে হেফাজত জোরজবরদস্তি করার আগেই যেন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হেফাজতের নেতাদের মতো করেই এ ভাস্কর্য নির্মাণকে সমালোচনা করা হল। ভাস্কর্য অপসারণের পক্ষে মত প্রকাশ করা হল। কিন্তু যতই কাকতালীয় হোক বা আওয়ামী লীগ নেতারা একে যতই রাজনৈতিক কৌশল বলে প্রচার করতে চান না কেন, আমরা মনে করি এর জন্য বুমেরাংয়ের প্রত্যাঘাত হজম করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। হেফাজতে ইসলামের নেতারা কি সাধারণ ধার্মিক মুসলমানের কাছে নির্ভেজাল ধর্মনেতা হিসেবে শ্রদ্ধেয়? তারা কি নির্লোভ হয়ে শুধু ধর্ম রক্ষায় নিয়োজিত? তারা কি লক্ষ্য অর্জনের জন্য মিথ্যাচার ও প্রতারণা করছেন না? হেফাজতের নেতারা যদি তাদের বলা মতো ধর্মীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সৎ ও নির্ভীক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন, তবে ধর্মনিষ্ঠ মুসলমানের সমর্থন তারা পেতে পারতেন।
কিন্তু মানুষ কি প্রশ্ন তুলবে না ২০১৩ সালের মে মাসে তাদের ঢাকা প্রবেশের সময় মুচলেকা দিতে হয়েছিল, তারা ওয়াদা করেছিলেন সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে যাবেন; কিন্তু তারা ওয়াদা ভঙ্গ করেন। নারীনীতির বিরুদ্ধে কঠিন কঠিন কথা বলেছেন হেফাজত নেতারা। তারা দেশ পরিচালনায় নারী-নেতৃত্বকে অস্বীকার করেছেন। আবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে দাবি আদায় করছেন! বাংলাদেশের মানুষ এত মূর্খ নয় যে, এসব বিবেচনা করছে না। আমার পরিচিত এক মাওলানা সাহেবের একটি ব্যাখ্যা এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনিও কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। একটি মসজিদের ইমাম। বেশ পড়াশোনা করেন। তার কোরআন-হাদিস আর তাফসির চর্চা আমাকে আকৃষ্ট করে। কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যার সংকটে আমি মাঝে-মধ্যে তার শরণাপন্ন হই। বললেন, ‘কওমি ধারার পড়াশোনা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত ধর্মের অনুসারী করতে সাহায্য করে। ইসলামী আদর্শ সম্পর্কে প্রকৃত পথনির্দেশনা আছে এখানে; কিন্তু এ অঞ্চল থেকে বেড়ে ওঠা হেফাজতে ইসলামের নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমি একমত হতে পারি না। সংগঠনের প্রয়োজনে তারা যে আপস করছেন এবং চাতুর্যের আশ্রয় নিচ্ছেন তা আমার কাছে ইসলামসম্মত মনে হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি দিয়েছিলেন তিনি। বললেন, যে মূর্তিকে ঈশ্বর, আল্লাহ বা দেবতা মেনে পূজা করা হয় তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। হেফাজত নেতারা যদি সুপ্রিমকোর্টের সামনের ভাস্কর্য সরানোর দাবি করে একে খুব অন্যায় বলা যাবে না; কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে একই আদর্শের কারণে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের সামনে বঙ্গবন্ধুর যে ম্যুরাল আছে সেখানে তো বিভিন্ন দিবসে ফুল অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানানো হয়, এর বিরুদ্ধে আরও আগে কথা বলা উচিত ছিল হেফাজত নেতাদের। এখানে তো তারা নীরব থাকছেন। মাওলানা সাহেব অনেক উদারভাবে ধর্ম ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত বিবেচনা আলাদা। আমি দেখছি সুপ্রিমকোর্টের সামনে ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য দেখে কারও পূজা করার ইচ্ছে জাগবে না। আল্লাহ বা দেবতার প্রতীক ভেবে শেরেকও করবে না। একইভাবে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে ফুল দেয়ায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিই শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়।
এখানেও শেরেক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমার মনে হয় না এসব ভাস্কর্য বা ম্যুরালে ইসলাম ধর্মের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বা মুসলমানের ঈমান নষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ আছে।’ সবশেষে মাওলানা সাহেব বললেন, এসব সুবিধাবাদী চরিত্রের হেফাজত নেতাদের প্রকৃত মুসলমানরা পছন্দ করবে না। আমাদের বক্তব্য এখানেই। এমন স্খলিত হেফাজত নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের কৌশলগত সম্পর্ক কোনো লাভ কি বয়ে আনবে? আওয়ামী লীগ এখন অনেক বেশি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এ অবস্থায় কোনো জুজুর ভয়ে নিজদলীয় আদর্শকে জলাঞ্জলি দেয়া কেন? একবার নির্বাচনী কৌশল করতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমীরের দোয়া চাওয়ায় যে কলংকের দাগ লাগিয়েছিল আওয়ামী লীগ, এখনও রাজনীতির মাঠে সেই উদাহরণ উঠে আসে। থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত আমার এক ছাত্র বলছিল, আমরা যেমন বিএনপিকে বলি জামায়াতি বিএনপি। এখন আওয়ামী লীগকে বলতে হবে হেফাজতি আওয়ামী লীগ। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গর্ব করি, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য আর চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে চাই, এখনকার বাস্তবতায় রাজনীতির মাঠে আমাদের কিন্তু তেমন বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগের ভুল পথে চলা আমাদের পীড়া দেয়। আমরা আতংকবোধ করি। তাই আমরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে প্রার্থনা করতেই পারি, নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাসী থেকে তারা যাতে কৌশলের নামে দলীয় আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.