জংলি পাহাড়ি পথে তোজেংমা

নতুন এক ঝর্ণার খোঁজ মেলে নাম তার তোজেংমা। দে-ছুটের ভ্রমণ পাগলারা-নতুন কোনো কিছু দেখার টানেই ঘর ছাড়তে পছন্দ করে। ঢাকা থেকে রাতের বাসে ছুটি প্রকৃতির রাজা খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা। যানজট মুক্ত থাকায় ভোর সাড়ে চারটার সময় পৌঁছাই। আগে থেকেই গেস্ট হাউসে রুম বুকিং থাকায় বাড়তি ঝামেলা না করেই সোজা রুমে। গাইডের অপেক্ষায় কিছুটা সময় চিৎ কাত হয়ে শুয়ে নেই বিশ্রাম। অতঃপর সকাল ৯টায় রুম থেকে বের হয়ে নাশতা শেষে বাইকে ছুটি আলমগীর টিলা।  মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছাই। এবার ভরসা দু’পা। সকাল দশটায় হাঁটা শুরু। উঁচু-নিচু টিলা-পাহাড়-ঝিরি-ঝোঁপঝাড়, জঙ্গল দিয়ে শুধু হাঁটছি। আমরা ছয় জন গাইড ৫ জন, মোট এগারো জন। গাইড ৫ জন কারণ প্রধান গাইড তিনি নিজেই তোজেংমা ঝর্ণা চেনেন না। তাই আমাদের সবার নিরাপত্তা ও সুবিধার জন্য তিনি আরও চারজন সঙ্গে নিয়েছেন।  কেউ চেনেন না শুধু লোকেশন নির্ভর করে এমন নিঝুম-বুনো পাহাড়ি পথে হাইকিং, ট্র্যাকিং সত্যিই অন্যরকম রোমাঞ্চকর। নৈঃশব্দের বুনো পরিবেশে একটা সময় পথ হারিয়ে ফেলি।  ভুল পথে উঠে যাই উঁচু এক পাহাড়ে। কি আর করা নামতে হবে আবারও তবে বাড়তি পাওনা চূড়া থেকে দেখা চারপাশের অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কিছুটা শুকনো খাবার পেটে পুরে নব উদ্যমে ছুটি।
বিশাল দেহের এক সঙ্গী কচি এদের আজ নেই কোনো ক্লান্তি।  যেন সাথি হতে পারাটাই ওদের বিশাল প্রাপ্তি। মনের আনন্দে হেঁটে চলি - যেখানে হারিয়েছিলাম পথ সেখানে এসে এবার ঝিরি পথ ধরি। কিছুটা দূর এগিয়ে যাওয়ার পরেই এক অন্য রকম ভালোলাগা রহস্য ঘেরা অনুভূতি মনে দোল দেয়। বয়ে যাওয়া পানির বিপরীতে হাঁটা, পায়ের নিচে মরণ ফাঁদ পাথর খণ্ড, ছোট ছোট কংক্রিট, মাথার ওপর ডালপালা, দু’পাশে গভীর জঙ্গল-সূর্যের রশ্মিও যেখানে হার মেনেছে সেই রকম ঝিরি পথে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই অ্যাডভেঞ্চারের ষোল কলা পূর্ণ করা। বেলা প্রায় দুটো, আবারও বিরতি। নিজের মনকেই জিজ্ঞাসা করি তুই জাভেদ হাঁটিস কি করে এই একশ’ কেজির দেহটা নিয়ে? হাঁটি কি করে জানিস মনের শক্তিতে, ফুটে থাকা নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ শুঁকে, অচেনা-অজানাকে জানার আগ্রহ থেকে। ভর দুপুরেও অন্ধকার এমন পরিবেশে কিছুটা সময় জিরিয়ে নেয়ার পর আবারও শুরু হাইকিং। গড়িয়ে যাওয়া পানির তীব্রতাই বলে দেয় আর বেশি দূরে নয় লুকিয়ে থাকা বুনো সৌন্দর্য তোজেংমা ঝর্ণা। ঠিক ঠিকই আধা ঘণ্টার মধ্যেই রিমঝিম ছন্দ তোলা পানির শব্দ ভেসে আসে কানে। আনন্দে চোখে মুখে সবার চিক চিক হাসির ঝিলিক।  পানির উৎস ধরে এগোতেই সামনে পড়ে ইয়া উঁচু এক পাহাড়। প্রকৃতির আপন খেয়ালেই পাহাড়টি দুই ভাগ হয়ে সেই কল্পকাহিনীর আলী বাবার চিচিং ফাঁক দুর্গের রুপ ধারণ করে আছে। এসবই প্রকৃতির লীলাখেলা। আমিও ক্ষণিকের জন্য আলীবাবা সেজে চিৎকার দিয়ে বলে উঠি ‘চিচিং ফাঁক তোজেংমা’। পিচ্ছিল পাথর টপকিয়ে সুড়ঙ্গর ভেতরে ঢুকতেই চোখ কপালে ওঠে। আরে এ যে সত্যি সত্যি বাস্তবের ধন-দৌলতের দুর্গ। শুধু এর ব্যবহার জানতে হবে। ভাগ হয়ে যাওয়া দুই পাহাড়ের দুই পাশ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম পানির ধারা। তবে সেই পানির পরশ পেতে চাই আরেকটু ধৈর্য্য। কিন্তু অতি উচ্ছ্বাসী সঙ্গীরা পারে তো লতায় ঝুলেই কাছে যেতে চায় তবে মাথা ঠাণ্ডা রেখেছে মারুফ। আপনারা কিন্তু ভুলেও লতায় ঝোলার চেষ্টা করবেন না। মনে রাখবেন আপনি বাংলার টারজান হওয়ার জন্য সেখানে যাননি। গিয়েছেন প্রকৃতির রহস্যময় সৌন্দর্যের খোঁজে।
সেই প্রকৃতি ও পরিবেশের সান্নিধ্য পেতে হলে কিছুটা তো কষ্ট করতেই হবে। গুহার রূপের আচ্ছন্নতায় না পড়ে সজাগ দৃষ্টিতে বড় বড় ধারালো চোখা পাথর মাড়িয়ে চলে যাই একেবারে তোজেংমার কাছাকাছি। আহ্ কি শান্তি। পুরো নির্জনতায় জঙ্গলি পরিবেশে গুহা আকৃতির দুই পাহাড়ের ওপর থেকে দুটো ঝর্ণার সফেদ পানি তীব্র গতিতে ছুটে এসে, আলিঙ্গন করছে একই বিন্দুতে। পানির ক্ষিপ্রতায় সৃষ্টি হওয়া প্রাকৃতিক বাথটাবে সাঁতার কাটা যাবে অনায়াসে। ঝর্ণা দুটোর উচ্চতা খুব বেশি নয় তবে তোজেংমার রয়েছে ভিন্ন রকম বৈশিষ্ট আর উদ্ভুত আকৃতির নজর কাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ঝর্ণার আছড়ে পড়া পানির তীব্রতাও বেশ। মনে হল সারা বছরই যেন পানির রিমঝিম ছন্দ তোলা আওয়াজের ধারাবাহিতকা থাকে অটুট। তোজেংমা থেকে জলীয় বাষ্প আর সুবিধাজনক স্থানের অভাবে ঝর্ণা দুটোর আরও বেশি আকর্ষণীয় ছবি তুলতে বারংবার ব্যর্থ হলাম। এখনও অধিকাংশ ভ্রমণপিপাসুর কাছে অচেনা-অজানা রয়েছে তোজেংমা ঝর্ণার রূপ রহস্য। ঝর্ণার আশপাশে নেই কোনো বসতি, তাই তোজেংমা নামের আভিধানিক অর্থ কি তাও এবারের জন্য আড়ালেই রয়ে গেল। নয়নাভিরাম প্রকৃতির মলাটে সাজানো রুপবতী-গুণবতী-লজ্জাপতী পাহাড়ের কোলে নিজেকে লুকিয়ে রাখা অসম্ভব ভালো লাগার এই তোজেংমার শুভ্র পানিতে প্রায় ঘণ্টা খানেক ভিজে ফেরার পথ ধরি। আহ্ সেই ভেজার আনন্দ লিখে জানানো সম্ভব নয়। গুহা মুখে এসে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠি বিদায় তোজেংমা বিদায়।
কিভাবে যাবেন : ঢাকার গাবতলী-ফকিরাপুল-সায়েদাবাদ হতে দিনে রাতে প্রতিদিন খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালা বিভিন্ন পরিবহনের এসি/নন এসি বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৫২০ থেকে ৫৮০ টাকা ৯০০ টাকা মাত্র। দীঘিনালা হতে মোটরবাইকে আলমগীর টিলা। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। যাওয়ার সময়ই ফেরার বিষয়টা মোটরবাইক চালকের সঙ্গে ঠিক করে রাখুন নতুবা গাড়ি পেতে ঝামেলা হবে।
কোথায় থাকবেন : দীঘিনালা বাজারে বিভিন্ন গেস্ট হাউস রয়েছে। ভাড়া ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত তবে মৌসুম অনুযায়ী ভাড়ায় তারতম্য ঘটে।
খাবেন কোথায় : গেস্ট হাউসগুলোর পাশেই বেশ কিছু খাবারের হোটেল রয়েছে, খাবার শেষে বিল পরিশোধের আগে কী কী খেলেন সেই হিসাব কষে নিন সঠিকভাবে। অন্যথায় এক আইটেমের বিল দুইবার দেয়া লাগতে পারে।
খরচপাতি : খরচ জনপ্রতি এক রাত দুই দিনের জন্য ২৫০০ টাকা হলেই যথেষ্ট। অবশ্য খরচটা নির্ভর করে অনেকটা নিজেদের সামর্থ্যরে ওপর।
গাইড : তোজেংমার পথে এখনও তেমন কোনো প্রফেশনাল গাইড মিলবে না। দুর্গমের বুনো গন্ধ শোঁকার আর নতুনত্ব দেখার তীব্র বাসনা যাদের শুধু তাদের জন্যই পাহাড়ি জংলি পথের তোজেংমা ঝর্ণা দেখার সাধ্য রয়েছে। গাইড চার্জ নির্দিষ্ট কোনো টাকা নির্ধারণ করা নেই। সারা দিনের জন্য সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা দিলেই যথেষ্ট। যদি কারও সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে তাহলে নিচে দেয়া ফেসবুক আইডিতে পরামর্শ নিতে পারেন।
টিপস্ : তাজেংমা ঝর্ণা এখনও লোক চক্ষুর অন্তরালে সুতরাং টিমে অন্তত ছয়/সাতজন হলে ভালো হবে। এর অবস্থান দুর্গমে তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে শুকনো খাবার, স্যালাইন, পানি ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে নিন, সঙ্গে চটের ব্যাগ রাখুন সেখানেই বর্জ্য ফেলুন, চলতি পথে উপজাতি কোনো সম্প্রদায়ের সঙ্গে অসদাচরণ ও ভাব বিনিময় হতে বিরত থাকুন, দলপতির নির্দেশনা ও একতাবদ্ধভাবে ট্রেইল করবেন। মনে রাখবেন তোজেংমার পথ এখনও বুনো আর জংলি সুতরাং আপনার অতি উচ্ছ্বাস যেন অন্যের কষ্টের কারণ হয়ে ভ্রমণে বিঘ্ন না ঘটায়।

No comments

Powered by Blogger.