হাঁ-বাজেট না-বাজেট by মাহবুব তালুকদার

চাচা বললেন, দেশের অবস্থা নিয়ে তুমি এত কথা বলো। কিন্তু এবারের বাজেট নিয়ে তো তুমি কোন কথাই বললে না।
বললাম, আমি অর্থনীতিবিদ নই যে, বাজেট সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতো মতামত দিতে পারবো। তবে বাজেট সম্পর্কে আমার নিজস্ব কিছু প্রতিক্রিয়া আছে।
কী রকম? চাচা জানতে চাইলেন।
চাচা! এবারের বাজেট হচ্ছে অত্যন্ত ব্যতিক্রমী বাজেট। মাননীয় অর্থমন্ত্রী নিজেই একজন ব্যতিক্রমী মানুষ।
কী কারণে তাকে ব্যতিক্রমী বলছো?
তিনি একজন নমস্য ব্যক্তি। তার হাসিটি বড়ই প্রাণখোলা। ‘রাবিশ’, ‘স্টুপিড’ ইত্যাদি শব্দের সহজাত ব্যবহারের জন্য তিনি আলোচিত। তবে আমার মনে ও মননে তিনি আসন পেতেছেন সৃজনশীল চিন্তাভাবনার কারণে।
কি সেই সৃজনশীলতা?
ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে একবার তিনি বলেছিলেন, একদিন জোড় সংখ্যার গাড়ি এবং একদিন বেজোড় সংখ্যার গাড়ি চালালে সমস্যার সমাধান হবে। আরও একটা প্রস্তাব ছিল তার।
কি প্রস্তাব?
গাড়ি রাস্তায় চলতে হলে চারজনের কম যাত্রী থাকলে হবে না। একজন বা দুজন যাত্রী থাকলে গাড়ি চলবে না। তবে এ প্রস্তাবগুলো কার্যকর করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
কথাগুলো তার পক্ষে গেল, না বিপক্ষে গেল?
পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আমি ভাবি না। তবে কথাগুলো খুবই মৌলিক চিন্তা বলে আমার মনে হয়েছে। এরকম ব্যতিক্রমী চিন্তার মানুষকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না।
চাচা গম্ভীরমুখে বললেন, মুহিত স্যারের কথা থাক। তার প্রণীত বাজেটকে তুমি ব্যতিক্রমী বলছো কেন?
আমি জানালাম, সেই আদিকাল থেকে দেখে আসছি বাজেট পেশের আগের দিন সরকারি দল ব্যানার-প্ল্যাকার্ড তৈরি করে বাজেটের স্বপক্ষে অভিনন্দন জানিয়ে রাজপথে মিছিল করে। অন্যদিকে বিরোধী দল গণবিরোধী বাজেট পেশের নিন্দা জানিয়ে পাল্টা শোভাযাত্রা করে। এবারের বাজেট পেশের পর তেমন পক্ষে-বিপক্ষে শো-ডাউনের আয়োজন দেখা যায়নি। এ জন্য এটা ব্যতিক্রম।
এটাও আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর হলো না।
তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটা চমক। সেদিক থেকে এটা ব্যতিক্রম। এ ধরনের বাজেট তারাই দিতে পারেন, যারা মনে মনে কবি।
মুহিত স্যার মনে মনে কবি?
অবশ্যই। আমি তাকে মনেপ্রাণে কবি বলিনি। মনে মনে কবি বলেছি।
বাজেটের সঙ্গে কবির সম্পর্ক কি?
চাচা! কেবল কবিদের পক্ষেই কল্পনাবিলাসিতা সম্ভব। সে জন্যই অর্থমন্ত্রীদের কবি হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কল্পনাবিলাসী না হলে তারা দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখাবেন কি করে? তাছাড়া, নিজে স্বপ্ন না দেখলে দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখানো সম্ভব নয়। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর এ গুণটি রয়েছে।
তোমার আজকের কথার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি অর্থমন্ত্রীর কথা বাদ দিয়ে বাজেট সম্পর্কে সরাসরি কথা বলো।
ঠিক আছে। আমি তাই-ই বলছি। আমার মতে কোন বাজেট প্রণয়নের আগে পূর্ববর্তী বছরের বাজেটের সাফল্য ও ব্যর্থতার পর্যালোচনা করা উচিত। এডিপি’র বাস্তবায়ন কতখানি সম্ভব হয়েছে, কতখানি হয়নি, কেন হয়নি, তার মূল্যায়ন করা প্রয়োজন ছিল।
হুঁ। এটা একটা কথা হতে পারে।
এই মূল্যায়ন কেবল যে সরকার করবে, তা নয়। বিশেষভাবে বিরোধী দলের উচিত এ ব্যাপারে হোমওয়ার্ক করে দেশের মানুষের কাছে বাজেটের সমালোচনার দিকগুলো তুলে ধরা।
শুধু সমালোচনার কথা বলছো কেন? সাফল্যের কথা বলছো না কেন?
বিরোধী দল যদি সরকারের সাফল্যের গীত গাইতে চায়, তাহলে তা তারা করতে পারে। অবশ্য আমাদের দেশের সংসদের বিরোধী দল তো সরকারেরই অংশ।
কেন? আমাদের সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ তো বাজেটের সমালোচনাও করেছেন।
কিছু সমালোচনা না করলে বিরোধী দলের তকমাটা থাকে না, সম্ভবত সে কারণেই করেছেন।
তুমি বাজেটের আলোচনা করতে গিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছো।
বাজেটে রাজস্ব আদায় বাড়াতে করের আওতা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু করদাতাদের সেই অর্থের কত অংশ দুর্নীতি ও অপচয়ে খরচ হবে, তা বলা হচ্ছে না।
এ কথার অর্থ কি?
দুর্নীতি থেকে রক্ষা পেতে বাজেটে কিছু অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল।
সে তো আছেই। দুদককে সরকার যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে।
আমি দুদকের কথা বলছি না। তাদের দুর্নীতিমুক্তির সার্টিফিকেট জারি নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলছি না।
তাহলে?
আমি ন্যায়পালের কথা বলতে চাই। আমাদের সংবিধানে ন্যায়পালের কথা আছে। কিন্তু মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের দুর্নীতির সুরক্ষা দিতে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
আশ্চর্য! মন্ত্রী-এমপি বা প্রভাবশালীদের সমালোচনা করা ছাড়া তোমার কি আর কোন কাজ নেই?
আছে। তবে চোখের সামনে যা দেখা যাচ্ছে, তার চিত্রটি প্রথমে তুলে ধরা উচিত।
ঠিক আছে। বলে যাও।
চাচা! সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ১৬ জন এমপি’র কর্মকাণ্ডে সরকার বিব্রত বলে খবর ছাপা হয়েছে। এরা খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, জমি দখলসহ নানা অপকর্মে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বলে পত্রিকাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। পত্রিকায় তাদের নামও উল্লিখিত আছে। কিন্তু কেউ তা অস্বীকার বা প্রতিবাদ করেছেন বলে জানা যায়নি। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে উপর থেকে সবুজ সংকেত না মিললে কর্তৃপক্ষ নাকি এদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে না।
তুমি বাজেটের আলোচনা করতে গিয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছো।
চাচা! বাজেটের আলোচনা তো কেবল কর আদায় আর খাতওয়ারি অর্থ বরাদ্দের বিষয় নয়। যারা রাজস্ব যোগাচ্ছেন, তাদের অর্থ লুটপাট হচ্ছে কিনা, কারা কিভাবে তা লুটপাট করছে, সে বিষয়টিও সারফেসে উঠে আসা দরকার। আমার মতে সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার মধ্যেই লুটপাটের প্রশ্রয় রয়েছে।
তুমি বড় কঠোর কথা বলছো।
হতে পারে। চোখের সামনে যা দেখছি, তাই বলছি। আমি জানালাম, একটা উদাহরণ দিতে চাই। অন্য একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবরে বলা হয়েছে: ‘টেন্ডারবাজি রোধে সরকার ই-টেন্ডারের ঘোষণা দিলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। বরং সারা দেশের টেন্ডার এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সরকারি দলের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, হানাহানি।’ আরও বলা হয়েছে ‘এমপিদের রামরাজত্ব নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকারি দলে অব্যাহত সংঘাত-সংঘর্ষ’ চলছে। ই-টেন্ডার চালু হলে টেন্ডারবাজি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তা করা সম্ভব হচ্ছে না।
তুমি বাজেট সম্পর্কে কথা বলো।
সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা তো বাজেটেরই অংশ। যে দেশে ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেলে কারও টনক নড়ে না। ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় না, সেখানে করদাতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে রাজস্ব আদায়ের নৈতিক শক্তি থাকে কিনা, তা বিবেচনাযোগ্য।
তোমার আজ কি হয়েছে বলো তো? কিসব কথাবার্তা বলছো?
চাচা! দেশের আইন যেন কেবল সাধারণ মানুষের জন্য, প্রভাবশালীদের জন্য কোন আইন নেই। দুর্নীতির পেটেই যদি সিংহভাগ কর ঢুকে যায়, তাহলে বাজেটের আকার বাড়ানোর অর্থ দুর্নীতিরও আকার বাড়ানো। ক’দিন আগে ট্রান্সপারেসি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ অর্থাৎ টিআইবি দাবি করেছে প্রধানমন্ত্রী, কেবিনেট মন্ত্রী, উপদেষ্টা, আইনপ্রণেতা, বিচারক, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করে তা নিয়মিতভাবে আপডেট করা হোক। এটা করতে অসুবিধা কি?
এর সঙ্গে বাজেটের সম্পর্ক কি?
আছে। টিআইবি উল্লিখিত মাননীয় ব্যক্তিবর্গ নিয়মিত কর দেন কিনা, কতটা কর দেন, তাদের সম্পদ কি হারে বাড়ে, তা দেশবাসীর জানা প্রয়োজন। কিছুদিন আগে একজন এমপি বলেছেন, ‘ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ তো বাড়বেই।’
টিআইবি’র কথা আর বলো না। ওরা সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
বিএনপি আমলেও টিআইবি’র বিরুদ্ধে একই অভিযোগ ছিল। ঐ সময়ে এ জন্য ডক্টর মোজাফ্‌ফর আহমদকে কম নিগ্রহ পোহাতে হয়নি। তার মানে টিআইবি এখন ঠিক লাইনেই আছে।
তুমি বাজেটের বিষয়ে বলো। বাজেটের ব্যাপারে তোমার কোন সুপারিশ আছে কি?
হ্যাঁ। আমার কমপক্ষে দুটি সুপারিশ আছে।
কী, কী, বলো।
প্রথমটি হলো, বাজেট বাস্তবায়নে দুর্নীতিমুক্ত আর্থিক ব্যবস্থাপনা। এটি না করা গেলে ব্যাপক রাজস্ব আদায় করা হবে কোন মুখে? মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টেও বলা হয়েছে: ‘রাজস্ব আদায়ে ন্যূনতম শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ’।
চাচা সরোষে বললেন, বাংলাদেশের রাজস্ব আদায় নিয়ে কথা বলার তারা কে? যুক্তরাষ্ট্রকে এই অধিকার কে দিয়েছে?
এই অধিকার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। আমি বললাম, যেসব দেশকে যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে, তাদের ব্যাপারে মার্কিনিরা জানতে চায় তাদের ট্যাক্সের টাকা কোথায় কিভাবে খরচ হচ্ছে। যথাযথভাবে তাদের ট্যাক্সের টাকা ব্যয় হচ্ছে কিনা। এ সম্পর্কিত রিপোর্টে রাজস্ব খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ মার্কিন সাহায্য না নিলে তারা এই খবরদারি করতে পারতো না।
চাচা চিন্তিতমুখে বললেন, হুঁ। বুঝলাম। তোমার আরেকটি সুপারিশ কি?
গণতন্ত্রের সংকট নিরসন করা। এটা করা হলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া জিডিপির টার্গেট সাত শতাংশ বা যা-কিছুই ধরা হোক না কেন, তাতে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। আমি জানালাম।

No comments

Powered by Blogger.