‘যেন কারবালার ময়দান থেকে ফিরে এসেছি’

কঙ্কালসার দেহ। পরনে জীর্ণ বসন। উষ্কখুষ্ক চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। নির্যাতনের আঘাতে শরীরে কালচে দাগ। কারও আবার গভীর ক্ষত। এসব নিয়েই দেশে ফিরেছেন সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় উদ্ধার হওয়া ৬২ বাংলাদেশী। দেশে ফিরে বর্ণনা দেন সাগর থেকে উদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের ওপর চালানো বর্বর ও অমানুষিক আচরণের। তাদের বর্ণনায় উঠে আসে- দিনের পর দিন খেতে না দেয়া, নিয়মিত শারীরিক নির্যাতনসহ নানা লোমহর্ষক কাহিনী। বলেন, কখনও কখনও এক মুঠো ভাত দিলেও পানি দেয়নি। যেন কারবালার ময়দান। পানির জন্য বুক ফেটে গেলেও পানি পাওয়া যায়নি। পানির কথা বললেই নেমে আসতো নির্যাতন। সে নির্যাতনের মাত্রা এতই ভয়াবহ ছিল যে, সইতে না পেরে তাদের অনেক সঙ্গীই মারা গেছেন। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অর্ধমৃত অবস্থায়ই সাগরে ফেলে দেয়া হয়েছে তাদের। চোখের সামনে এমন মৃত্যু দেখে ভুলেই গিয়েছিলেন বেঁচে ফেরার কথা। কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় হয়েছে, তাই ফিরতে পেরেছেন- আর দেশের মাটিতে পা রেখে তারা বললেন, যেন কারবালার ময়দান থেকে ফিরে এসেছি। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় বাংলাদেশ বিমানের বিজি-১৮৭ ফ্লাইটে করে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান হতভাগা এই ৬২ বাংলাদেশী। এদের মধ্যে রয়েছেন ৪০-৪৫ বছর বয়সীরা। রয়েছেন ২০-২৫ বছরের যুবক। আবার ১২-১৩ বছরের কিশোরও রয়েছে। এরা সবাই দালালের খপ্পরে পড়ে অবৈধ সমুদ্রপথে পা বাড়িয়েছিলেন। কেউ জেনে, কেউ না জেনে। বাড়ি থেকে রওনা দেয়ার আগেই কারও কাছ থেকে দালালরা হাতিয়ে নিয়েছিল মোটা অঙ্কের টাকা। আবার কাউকে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করেছে মুক্তিপণ। বৃহস্পতিবার বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদেরকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। আইওএম-এর ঢাকার সিনিয়র সমন্বয়কারী শাকিল মনসুর জানান, সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়ায় উদ্ধার হওয়া ৭১৬ জন বাংলাদেশীর মধ্যে প্রথম দফায় এই ৬২ জন দেশে ফিরলেন। সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় গত ১১ই মে লংকাবি দ্বীপের উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয় তাদের। কুয়ালালামপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন তাদের শনাক্ত করে নামের তালিকা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই করে তাদের যাবতীয় কাগজপত্র মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঈদের আগেই বাকিরা নিরাপদে দেশে ফিরতে পারবেন। ফিরে আসা বাংলাদেশীদের অধিকাংশই কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, জয়পুরহাটের বাসিন্দা। এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় থাইল্যান্ড থেকে ৪৭ জন বাংলাদেশী অভিবাসীকে ফিরিয়ে আনা হয়।  বৃহস্পতিবার ফিরে আসা ৬২ জনের মধ্যে ছিল ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার বড়বাড়ি গ্রামের আবদুল মজিদের ছেলে কিশোর রাজিব ও মনির হোসেনের ছেলে মোস্তফা কামাল। বিমানবন্দরে তাদের নিতে আসা চাচা আবুল কালাম জানান, আমরা ভেবেছিলাম তারা মারা গেছে। এদের হারানোর শোকে গত ৪ মাস ধরে বাড়িতে সবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় এদের মা-বাবা। তারা নিখোঁজ হওয়ার পর যশোর জেলার জগদীশপুর গ্রামের ওয়াহিদ দালাল তাদের ফিরিয়ে দেবে বলে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। পরে একেক জনের পরিবার ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা দেয়  তাকে। কিন্তু ৩ মাসেও তাদেরকে ফেরত দিতে পারেনি। এরপর মামলা করার কথা বললে দালাল ওয়াহিদ নানা ধরনের হুমকি দেয়। সে বলে- আমার ভাই সচিব। কেউ আমার কিছু করতে পারবে না। তারপর থেকে তাদের ফিরে আসার আশা ছেড়ে দিয়েছিল সবাই। কিন্তু গত ১৯দিন আগে পুলিশ বাড়িতে গিয়ে জানায় তারা বেঁচে আছে। এরপর থেকেই বাড়িতে খুশির বন্যা। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। আবুল কালাম আরও জানান, একইসঙ্গে যাওয়া আরও দুই কিশোর তাদের গ্রামের মৃত সাঈদের ছেলে উজ্জ্বল এবং সামাদের ছেলে উজ্জ্বল এখনও ফেরেনি। তারা এখনও মালয়েশিয়াতেই আছে। তিনি দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। একই জেলার শৈলকুপা উপজেলার আড়ুয়াকান্দি গ্রামের কালাম বলেন, হাটগোপালপুর গ্রামের মনোয়ারের মাধ্যমে ৩ মাসে আগে এ পথে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখন বুঝতে পারেননি তাদের সঙ্গে এমন করা হবে। বলেন, দেড়মাস একটি পাহাড়ে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করেছে তারা। পরে ট্রলারে করে সাগরে নিয়ে গিয়েও নির্যাতন করেছে। বগুড়ার সালাম। কঙ্কালসার দেহ। দেখে মনে হয় বহুদিন ধরে অভুক্ত রয়েছেন এ মানুষটি। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই তিনি দুই বাহু ও পিঠ বের করে দেখান। সেসব জায়গায় কালচে দাগ। পেশায় কৃষিজীবী সালামের বাড়ি কাহালু উপজেলার পাঁচখুর গ্রামে। বলেন, ৬ মাস আগে স্ত্রীকে জানিয়েই তিনি মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য একইগ্রামের কামরুল দালালের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হন। কিন্তু কামরুল তাকে টেকনাফ পৌঁছে দিয়েই উধাও হয়ে যায়। পরে অন্যরা তাকে ট্রলারে উঠিয়ে নেয়। এরপর ট্রলারে চলতে থাকে নির্যাতন। ওই সময় বাড়িতে ফোন করে দালাল কামরুলকে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে বলে জানান। তিনি বলেন পানির ওপরে থাকতেই টাকা চেয়েছিল। বাড়ি থেকে টাকাও দিয়েছে। কিন্তু নির্যাতন থামেনি। তিনি বলেন, প্রতিদিন খুব মারধর করতো। ২ বেলা একমুঠো করে শুধু ভাত দিতো। কিন্তু পানি দেয়নি। পানি চাইলে আরও মারধর করতো। তাদের মারধরের কারণে অনেকেই মারা গেছে। আবার অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় জ্যান্তই সাগরে ফেলে দিয়েছে। দীর্ঘ তিনমাস তারা এভাবেই কাটিয়েছেন সাগরে। বেঁচে ফিরবেন এ আশা কখনই ছিল না। ভেবেছিলেন অনেক সঙ্গীর মতো একদিন তিনিও মারা যাবেন। তিনি আরও বলেন, তারা যে ট্রলারে ছিলেন তাতে ৪৫০ জন মানুষ ছিল। এদের সবাই বাংলাদেশী। এর মধ্যে ৬৫ জন মারা গেছে। এদের বেশির ভাগই নির্যাতন এবং পানির অভাবে মারা গেছেন। অসুস্থ হয়ে গেলে আধমরা অবস্থায়ই সাগরে ফেলে দিয়েছে। নির্যাতনে চিহ্ন তার শরীরে লেগে থাকা দাগ দেখিয়ে বলেন, দেশে জেল খাটলেও ভাল। প্রতিদিন এত মারধর তো কবরে না। ফিরে আসা প্রত্যেকের জীবনেই ঘটেছে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা। প্রত্যেকের শরীরেই রয়েছে ক্ষত। অনেকেই কথাও বলতে পারছেন না ঠিকমতো। সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা মনেই করতে চান না তারা। বলেন, এসব কথা বলে বুঝানোর না। আইওএম-এর কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাকিল মনসুর বলেন, ফিরে আসা ৬২ জনের মধ্যে বাবুল নামে ১ জন অসুস্থ থাকায় তাকে বিমান থেকে নামানোর পরেই অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। তিনি উদ্ধার হওয়ার পর মালয়েশিয়াতে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন।
শাকিল আরও বলেন, দেশটিতে উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার কোনভাবেই তাদের আনবে না। এজন্য ভেরিফিকেশনের জন্য একটু সময় লাগছে। সেদেশে উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে ৭১৬ জনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঈদের আগেই তাদের ফেরত আনা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.