জনপ্রতিনিধিদের জনবিচ্ছিন্নতা by ফরিদুল আলম

সম্প্রতি বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় গত কয়েকদিন ধরে প্রকাশিত হওয়া একটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ না দিয়ে পারলাম না, আর তা হলো আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধিদের বিশেষ করে মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের প্রতি সীমাহীন উদাসীনতা। ভাবতে অবাক লাগে ১০ম জাতীয় সংসদের এ পর্যন্ত ৫টি অধিবেশনের ১২২টি কার্যদিবসে মন্ত্রীদের মধ্যে শত ব্যস্ততার পরও সর্বোচ্চ উপস্থিতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর, ১০৫ কর্মদিবস, যিনি সরকারের দায়িত্বের বাইরেও দলের প্রধান। অপরদিকে উপস্থিতির দিক দিয়ে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এ পর্যন্ত সংসদে তার উপস্থিতি মাত্র ৩০ দিন। এক্ষেত্রে অবশ্য বর্তমান বিরোধী দলের নেত্রী রওশন এরশাদের উপস্থিতি যথেষ্ট সন্তোষজনক, অন্তত বিগত সংসদের বিরোধী দলের নেত্রীর তুলনায়। ৯ম সংসদের বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যেখানে মোট ৪১৮ কর্মদিবসের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১০ দিন সেখানে বর্তমান বিরোধী নেত্রী ইতোমধ্যে ১২২ কার্যদিবসের মধ্যে ৬২ দিন উপস্থিত থেকেছেন। এদিকে গত ৪ জুন জাতীয় বাজেট পেশের পর থেকে অর্থমন্ত্রীর সংসদে না থাকা বাজেট বক্তৃতায় উপস্থিত সাংসদদের নিরুৎসাহিত করছে। প্রথা অনুযায়ী বাজেট অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনা চলাকালে অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতি এক রকম বাধ্যতামূলক। কেননা যে বাজেট তিনি উত্থাপন করেছেন তার ওপর সাংসদদের আলোচনা পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে সেই বাজেটে তিনি প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনয়ন সাপেক্ষে সংসদের নিকট তা পাস করার জন্য প্রস্তাব করবেন। এখানে স্বয়ং তিনি যদি উপস্থিত না থাকেন তাহলে এর মানে দাঁড়ায় সংসদে উপস্থিত সাংসদদের বক্তব্যের কোনো গুরুত্ব তার কাছে নেই এবং এই আলোচনা অনেকটা অর্থহীন। আমরা জানি সংসদের অধিবেশন চলাকালে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, সুতরাং সংসদের আলোচনা যত অর্থবহ হয় জনগণের করের পয়সার তত সদ্ব্যবহার হয় এর মাধ্যমে।
আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশেষ করে সংসদীয় শাসন পদ্ধতিতে সংসদকেই জাতীয় সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূল বলে ধরে নেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় যেখানে এক ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছাই বেশী প্রাধান্য পায় সেখানে সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদের ভেতর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জন আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে বলেই বর্তমানে এই ব্যবস্থা বেশি জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থা হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। আইন সভা বা সংসদের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন করা, সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাজকে তদারক করা বা পর্যবেক্ষণ করা, সংসদীয় কমিটিগুলোর সক্রিয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা তথা প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করা। এ ছাড়াও আইন সভার সদস্যদের সংসদের ভেতর প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করা, নোটিস প্রদান করা এবং জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করার মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করাও অন্যতম দায়িত্ব। উল্লেখ্য, বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে জনপ্রতিনিধিত্ব করার চেয়েও সাংসদদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে আইন প্রণয়ন করা এবং সরকারের সকল মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম আইনের আলোকে যথার্থভাবে সম্পাদিত হচ্ছে কিনা তার তদারক করা। কিন্তু বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে সাধারণ মানুষের কাছে সংসদ সদস্যদের আকাক্সক্ষা হচ্ছে এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাস্তাঘাটের সংস্কার, বেকারত্ব দূরীকরণ তথা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সাংসদদের কাছে পাওয়া। এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য জনগণ নয়, বরং রাজনীতিবিদদের এতদিন ধরে জনগণকে ভুল বুঝিয়ে তাদের স্বীয় ফায়দা হাসিলের চেষ্টাই দায়ী। আর এই সকল কারণেই সাংসদ তথা নির্বাচিত আইনপ্রণেতারা আইনসভার ভেতরের চাইতে নিজের পদ পদবিকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের চেষ্টাকেই বড় করে দেখেন। এ প্রসঙ্গে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত টিআইবির এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে তাদের পরিচালিত জনমত জরিপে নির্বাচিত সাংসদদের অধিকাংশই পুনঃনির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদের কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ না নেয়া, আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজে অনুপস্থিত থাকা এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারাকে দায়ী করা হয়। এর পাশাপাশি জনগণ মনে করেন যে, নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড জড়িয়ে পড়া এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করার ফলে এই সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।
জনপ্রতিনিধিদের জনবিচ্ছিন্নতাআমাদের দেশের সংসদ সদস্যরা নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচনী এলাকার জনসাধারণের কাছে হাজারো প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেও নির্বাচিত হওয়ার পর সেই সব প্রতিশ্রুতি পূরণ তো দূরের কথা আইন প্রণয়নের মূল জায়গা অর্থাৎ যেখানে বসে জনগণের জন্য কথা বলার জন্য নির্বাচিত হন সেখানে নিয়মিত উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে বড়ই অনীহা দেখান। ফলে জনগণ তাদের নির্বাচনী এলাকার জন্য জনপ্রতিনিধি পেলেও সেই জনপ্রতিনিধি একবার নির্বাচিত হওয়ার পর জনগণের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতার কথা বেমালুম ভুলে পদের ব্যবহার বা অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজের স্বার্থের বিষয়টিকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ২০০৯ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে প্রধান দুই দলই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সংসদ সদস্য তথা রাজনীতিবিদদের জন্য সুস্পষ্ট আচরণবিধি প্রণয়নের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে সংসদের বাইরে তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের ব্যাপারে আইনগত বাধ্যবাধকতার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার কথা। কিন্তু ৯ম সংসদের পর ১০ সংসদের বর্তমানে ৫ম অধিবেশন চলমান থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। উপরন্তু যতই দিন যাচ্ছে সংসদে কোরাম সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আজকাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশ্নোত্তর পর্বে বা জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা উপস্থিত থাকেন না, তাদের স্থলে অন্যরা প্রশ্নের জবাব দেন, এমন অনেক সময় দেখা যায় স্বয়ং প্রশ্নকর্তা নিজে অনুপস্থিত থাকেন এবং তার হয়ে অন্য কেউ প্রক্সি দিয়ে থাকেন। সংসদের ভেতরেই যদি এমন চিত্র পরিলক্ষিত হয়ে থাকে তবে সংসদের বাইরের চিত্র আরো ভয়াবহ। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে বেশ কয়েকজন সাংসদের ব্যাপারে গোয়েন্দা রিপোর্ট সরকারের হাতে রয়েছে এবং এ ব্যাপারে সরকার ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং দেশের উন্নয়নে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম। সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাশাপাশি জনগণের নিকট জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা থাকলে সংসদ সদস্যদের সম্মান ও মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পাবে। তাই পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্রে যেমন, ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্স, ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভা, কানাডিয়ান পার্লামেন্ট এবং সাউথ আফ্রিকান পার্লামেন্টে সংসদ সদস্যদের জন্য ঈড়ফব ড়ভ ঈড়হফঁপঃ রয়েছে। জনগণের প্রতি সংসদ সদস্যদের যে দায়দায়িত্ব রয়েছে, এর প্রতিফলনের জন্য বাংলাদেশেও এরূপ একটি আইনের প্রয়োজনীয়তা আছে। সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং অধিবেশন কক্ষের ভেতর শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব হুইপদের ওপর থাকলেও বর্তমানে সংসদে হুইপদের অধিকাংশ নিজেরাই অনুপস্থিত থাকার কারণে সংসদের ভেতরের কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে মাননীয় সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার এবং দায়মুক্তির বিষয়টি লিপিবদ্ধ থাকলেও এখানে তাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ববোধের বিষয়ট স্পষ্ট না থাকায় প্রকারান্তরে জনগণ জনপ্রতিনিধিদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই বিশেষ অধিকারবলে মাননীয় সাংসদরা সংসদে তাদের দায়িত্ব পালন সংক্রান্ত সকল বিষয়ে দায়মুক্তি লাভ করেন। এই অবস্থার আলোকে এই সকল জনপ্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতার ভেতর এনে আইন প্রণয়ন করলেও এ ধরনের আইন ভঙ্গ করলে তাদের শাস্তির সম্মুখীন করা কঠিন বিষয়। তবে এ ধরনের উদ্যোগ জনগণের ক্ষমতায়নের পথে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে বিবেচিত হতে পারে। জনগণ অন্তত এ বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারলে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যেও দায়িত্ববোধের সৃষ্টি হতে পারে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোতে মন্ত্রীদের পরিবর্তে সংসদ সদস্যদের মধ্য হতে মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত কমিটিগুলোর সভাপতি নিয়োগদান করা হয় যা পরবর্তীতে ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে। এই ব্যবস্থা প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয়ের কাজে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা এবং মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে স্বচ্ছতা আনয়ন করা, কিন্তু বাস্তবে এই উদ্দেশ্য কতটুকু সফল হয়েছে বা হচ্ছে তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্নও রয়ে গেছে। সংসদ কার্য তো বটেই অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মন্ত্রীরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় নিজেদের লোক দিয়ে এক ধরনের প্রভাববলয় সৃষ্টি করে নিজেদের মতো করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর উদাহরণ উল্লেখযোগ্য। ইতোমধ্যে অনেক ক্ষেত্রে বিতর্কের জন্ম দেয়া এই মন্ত্রী সম্প্র্রতি মৌলভীবাজারের আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থিত পুলিশ, র‌্যাব এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অশ্লীল ভাষায় গালাগালসহ উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে তাকে মুক্তিযোদ্ধা বলে সম্বোধন না করার অপরাধে পিঠে থাপ্পড় পর্যন্ত মেরেছেন। যদিও পরবর্তীতে তিনি এটাকে আদর করে চাপড় মারা বলে উল্লেখ করেছেন। উক্ত মন্ত্রী ওই দিনে পুলিশের কতিপয় কর্তার উদ্দেশে তার কথামতো না চললে পিঠের চামড়া তুলে নেবেন বলে হুঁশিয়ার করে দেন (সূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১২ জুন, ২০১৫)। মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিগুলতে সাংসদের সভাপতি করার মাধ্যমে মন্ত্রিত্ব বঞ্চিত অনেক সাংসদদের ক্ষমতায়ন ঘটলেও এবং এর বৈঠকে মন্ত্রীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলেও এই ব্যবস্থার মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের এবং মন্ত্রীদের দায়িত্বের মুখোমুখি করার মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ করা কতটুকু সম্ভব তা নিয়েও প্রশ্নও রয়েছে। কারণ  এই ব্যবস্থা প্রচলনের পর থেকে এখন পর্যন্ত এমন কোনো দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত হয়নি যার মাধ্যমে মন্ত্রীদের অপরাধি হিসেবে সাব্যস্ত করে গেছে। যে কথা বলছিলাম কেবলমাত্র মন্ত্রিত্ব বঞ্চিত কিছু সাংসদের ক্ষমতায়ন ঘটেছে মাত্র।
বাংলাদেশের সাংসদদের ক্ষেত্রে আজকাল সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগটি উচ্চারিত হয় তা হচ্ছে সরকারি বিভিন্ন নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়া। বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ, পুলিশ সদস্য নিয়োগ, স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ এবং রেলওয়ের কর্মচারী নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে সাংসদদের আগ্রহের ফলে এই সকল নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। আজকাল এমন কথা কোথাও শোনা যায় না যে কোনো ব্যক্তি কেবল নিজের যোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি এই সকল চাকরিতে নিয়োগ লাভ করছে। সর্বত্রই এখন এক ধরনের কোটারি ব্যবস্থার প্রচলন এবং এই ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন আমাদের মাননীয় মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা। অনেক ক্ষেত্রে আজকাল প্রায়ই এমন কথা শোনা যায় যে সরকার এবং সরকারি দল জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও বেশিরভাগ এ সকল চাকরিতে নিয়োগ পাচ্ছে তাদের দলের নেতাকর্মীরা এবং তাদের সরকারি দলের পরিচয়ে এই সকল চাকরিতে নিয়োগলাভে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন স্বয়ং আমাদের আইনপ্রণেতারা। এই সব আইনপ্রণেতার যেখানে দায়িত্ব হচ্ছে আইনের শাসনকে মজবুত করে দেশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা সেখানে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় সব নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে প্রকারান্তরে ভবিষ্যতের দুর্নীতিকেই আরো প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। এতক্ষণ ধরে বাংলাদেশের আইনপ্রণেতাদের তাদের স্বীয় দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়ে আলোচনার পর সঙ্গত কারণেই কিছু প্রশ্নও আসতে পারে এই অবস্থার পেছনে আসলে কোন কারণগুলো মূলত দায়ী। সেই সঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করা সঙ্গত যে বর্তমানের এই অবস্থা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমান্বয়ে এর বিস্তার ঘটছে, তথাপি বর্তমান অবস্থার সাথে কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা সাধারণপভাবেই চলে আসে, যেমন : প্রথমত, ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে যে সব সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন তাদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রটি তেমন একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না; দ্বিতীয়ত, গত ১০ বছরের অধিককাল ধরে অনেক জেলায় বর্তমান সরকারি দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হবার কারণে দলীয় শৃৃঙ্খলা চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক জেলা এবং উপজেলায় বর্তমান কমিটির নেতাদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার নেশা একদিকে যেমন পেয়ে বসছে তেমনই অন্যদিকে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। তার ওপর নির্বাচিত সাংসদ এবং মন্ত্রীরা নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় ক্ষমতার দাপটে দল এবং প্রশাসনে এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছেন; তৃতীয়ত, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দুর্বল বিরোধী দলের দুর্বলতার সুযোগে সরকারি দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন কথাও এখন বহুলভাবে প্রচলিত; চতুর্থত, সরকারের দিক থেকে এই সকল অরাজকতার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ার কারণ হিসেবে এখন অনেকের মধ্যে এই ধারণা প্রবল হয়েছে যে এর মাধ্যমে বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডকে দমন করা যাচ্ছে, যা সরকারের জন্য স্বস্তির বিষয়। ঘটনা যাই হোক না কেন বাংলাদেশের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণে একথা কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে এই অবস্থা এখন কেবল কাগুজে একটি ব্যবস্থা হিসেবে বিরাজ করছে, যা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য মোটেও সুখকর নয়।
লেখক: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশ-বিদেশের রাজনীতির বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.