রোহিঙ্গা সমস্যা- দ্বীপান্তর সমস্যার সমাধান নয় by আলী ইমাম মজুমদার

ভারত বিভাগ–পূর্ব যুগে দেশে রাজনৈতিক অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের একটি কারাগারে পাঠানো হতো। নিয়ম-নীতির বেড়াজাল আর দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থার কারণে তারা প্রায় সারা জীবনের জন্য পরিবারের সঙ্গে হয়ে পড়ত সম্পর্কবিহীন। একপর্যায়ে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যাঁরা ভারতের স্বাধীনতার প্রচেষ্টা নেন, তাঁদের অনেককেও সেখানে পাঠানো হয়েছে। সেই শাস্তি ব্যাপকভাবে দ্বীপান্তর বলে পরিচিত ছিল। এখন এ ধরনের শাস্তির যুগ শেষ হয়েছে। বিভিন্ন দ্বীপে সাহসী মানুষ বসতি স্থাপন করছে বাঁচার তাগিদে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস তাদের নিত্যসঙ্গী। প্রায়ই তাদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে অনেক আলোকিত ব্যক্তিত্বও এসব দ্বীপে বসবাস করেন। শিক্ষা-সংস্কৃতিরও ঘটেছে ব্যাপক প্রসার। তবে আলোচিত বিষয়টি এরূপ কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে চালান করে দেওয়া সম্পর্কে নয়; বরং শিবিরে জীবনযাপনকারী ৩২ হাজার লোকের একটি দ্বীপে স্থানান্তর প্রসঙ্গ।
খবরে প্রকাশ, কক্সবাজার জেলার দুটি শরণার্থী শিবিরে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর হাতিয়ার একটি চরে স্থানান্তরের প্রাথমিক প্রক্রিয়া চলছে। তারা মিয়ানমারের আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে এ দেশে এসেছিল ১৯৯১ সালে। এসেছিল প্রায় আড়াই লাখ। দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় অন্যরা স্বদেশে ফিরে গেছে বিভিন্ন পর্যায়ে। অবশিষ্টদের ভাগ্যে রয়ে গেছে সিকি শতাব্দীর শিবিরজীবন। ইতি অজানা। সেই সময়ে এখানে জন্ম লাভ করা বহু শিশু আজ শিশুর মা-বাবা। বাংলাদেশ সরকার ও উদ্বাস্তুবিষয়ক জাতিসংঘ হাইকমিশনের যৌথ ব্যবস্থাপনায় শিবির দুটি পরিচালিত হয়। শিবিরবাসীর অনেকেই শিক্ষা-দীক্ষাহীন। অনেকটা অমানবিক পরিবেশে বসবাস করছে দীর্ঘকাল। নিজের বলতে কিছুই নেই। উপেক্ষিত সর্বত্র। তাই এ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ স্থানীয় প্রভাবশালী দুর্বৃত্তদের হাতের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয় কখনো কখনো। জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমে। তবে তারা সবাই অপরাধী নয়। অপরাধ দেশের সর্বত্রই ঘটে চলেছে। তবু পরিস্থিতির শিকার এ লোকগুলোকে পাইকারিভাবে অপরাধী বলে চিহ্নিত করেছে কেউ কেউ।
শিবিরে বসবাসকারীদের বাইরেও প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও পাশের জেলাগুলোর জনজীবনে মিশে আছে। হয়তোবা ধীরে ধীরে সেই সংখ্যা বাড়ছেও। যে অবস্থায় তারা আরাকান প্রদেশে আছে, তা গণমাধ্যমের কল্যাণে সবারই জানা। তাই সেখান থেকে যে যেভাবে যেদিকে পারছে পালাতে চাইছে। এমনকি অকূল সমুদ্রে মাছ ধরার নৌকায় পাড়ি দিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে বিপুলসংখ্যক নর-নারী ও শিশু। এভাবে আমাদের দেশ থেকেও কিছু লোক যাচ্ছে বটে। তবে তাদের উদ্দেশ্য উন্নত জীবনযাত্রার সন্ধান। আর রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশুরা এটি ছাড়াও নিরাপত্তার সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে। মনে হয়, বিশ্ববাসীর তাদের জন্য তেমন কিছু করার নেই। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘের মহাসচিব তাদের নাগরিকত্ব ও মানবাধিকারের বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার মিয়ানমারকে চাপ দিয়েছেন। এখন দিচ্ছেন আরও অনেকে। কিন্তু তাতে তেমন ফল পাওয়া যাবে, এমনটা মনে হয় না। সে দেশের মানবাধিকার আন্দোলনের জন্য বিশ্বনন্দিত নেত্রী অং সান সু চিও আজ চুপ মেরে আছেন। মনে হচ্ছে তাঁরা রোহিঙ্গাদের সে দেশ থেকে সমূলে বিতাড়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সম্প্রতি ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বহুজাতিক সম্মেলনেও তাঁদের অনড় অবস্থানের কারণে মানব পাচার প্রতিরোধ কার্যক্রমে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি।
অন্যদিকে, পরিস্থিতির শিকার আমাদের জনবহুল দেশটি। সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী সব অনুপ্রবেশ সামলাতে পারে না। তাই প্রায়ই কিছু না কিছু ঢুকে পড়ছে আমাদের দেশে। অবশ্য শিবিরের বাইরে জনগণের সঙ্গে মিশে যাওয়া রোহিঙ্গারা পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করে। কম মূল্যে শ্রম পাওয়া যায় বলে তাদের চাকরি জুটে যায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কল্যাণে। তাঁদেরই কেউ কেউ আবার বিভিন্ন সভা-সমাবেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ও সামাজিক বিরূপ প্রভাব নিয়ে সরব আলোচনায় লিপ্ত হন। শিবিরে বসবাসকারীদের হাতিয়ায় সরিয়ে নেওয়া হলেও অচিহ্নিতরা থেকেই যাবে যার যার নতুন ঠিকানায়। সেটা যাই হোক, ধরে নেওয়া হয় শিবির দুটি অন্য পার থেকে শরণার্থী আসাকে হয়তো উৎসাহিত করছে। তবে বিষয়টি অনেক ব্যাপক ও গভীর। শিবির তুলে দিলেও প্রাণ বাঁচাতে ও পেটের টানে তাদের আসা ঠেকানো কঠিন।
মিয়ানমার সরকার তাদের দেশে অধিবাসী রোহিঙ্গাদের জন্য দেশটিকে জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করেছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে নাগরিক অধিকার, সম্পদের মালিকানা এমনকি বেঁচে থাকার অধিকারও। সেই রাষ্ট্রটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ এ হতভাগ্য আদম সন্তানেরা। আর এদের ৯০ শতাংশই বসবাস করে আরাকান অঞ্চলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালেও রোহিঙ্গা বিতাড়ন কার্যক্রম চলে। আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে মিয়ানমার রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান চালায়। হাজার হাজার রোহিঙ্গা যুদ্ধবিধ্বস্ত দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তখনকার বঙ্গবন্ধু সরকারের দৃঢ়তায় মিয়ানমার তাদের ফেরত নিতে বাধ্য হয়। আবার ’৭৭ সালে আসে প্রায় দুই লাখেরও অধিক। কূটনৈতিক চাপে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তাদেরও ফেরত নেয় সে দেশ। তবে ১৯৯০ সালে যারা এল, রয়ে গেছে তাদের রেশ। আর অবশিষ্টদের বিতাড়নের প্রক্রিয়াও থেমে নেই। মিয়ানমারকে তাদের এ নীতি থেকে বিরত করতে না পারলে সমস্যাটি রয়েই যাবে।
কক্সবাজারের বনজঙ্গল কেটে এর পরিবেশ বিপর্যয় রোহিঙ্গারা করছে—এমন অভিযোগ হামেশাই করা হয়। আর এ বনজঙ্গল উজাড়ের মূল নায়কেরা সাধু সেজে থাকতে চান। আমাদের দু-তিনটি জেলাতেই রোহিঙ্গা রয়েছে। এর বাইরে দেশের সর্বত্র খাল–বিল, নদী–নালা, পাহাড়, জঙ্গল বিরান করছে কোন রোহিঙ্গারা? জঙ্গি কার্যক্রমও কিছু পরিমাণে আছে দেশের অন্যত্রও। তাই এসব বিষয়ে শুধু রোহিঙ্গাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। অবশ্য এ বক্তব্য তাদের এ দেশে আসা বা থাকতে দেওয়ার সপক্ষে নয়। রোহিঙ্গারা এ দেশে আসবে না এবং যারা এসেছে, তারা নিজ দেশে ফিরে যাবে—এটাই আমাদের নীতি। এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। জনবহুল এ দেশটিতে আমরা নিজ জনগণকে স্থান দিতে পারছি না। আটকে পড়া পাকিস্তানিরা তো রয়েই গেল। তবে রোহিঙ্গারা আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ থেকে বারংবার আসে, ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরেও আসে, তাদের ফেরত নেয় না মিয়ানমার সরকার। তাই এ বিষয়টি আমাদেরও সমস্যা বটে। এটা বিশ্বসমাজকে অব্যাহতভাবে জানাতে হবে। সব প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার এর একটি স্থায়ী সমাধানে।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বিশ্বসমাজ একেবারে চুপ করে আছে, এমনটি বলা যাবে না। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের সহায়তায়ই শিবিরগুলো পরিচালনা করা হয়। তবে এসব শিবিরবাসী রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ভুটান থেকে শরণার্থী হওয়া প্রায় এক লাখ নেপালিকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ নিয়ে নিয়েছে। আর পত্রপত্রিকার তথ্য অনুসারে, ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মাঝে মাত্র ৯২৬ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন সম্ভব হয়েছে। এ দেশগুলো হলো কানাডা, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়া। সমস্যার ব্যাপকতা আর এসব দেশের সামর্থ্যের বিবেচনায় বলতে হবে, এ যেন পর্বতের মূষিক প্রসব। তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলো অত্যন্ত অনুদার নীতি অনুসরণ করছে। অথচ তাদের রয়েছে বিশাল ভূখণ্ড ও অঢেল সম্পদ। প্রয়োজন রয়েছে প্রচুর শ্রমশক্তির। মালয়েশিয়া অতিসম্প্রতি এ ধরনের কিছু করার কথা আলোচনায় এলেও এর আকৃতি ও প্রকৃতি অস্পষ্ট।
তবে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন শেষ প্রচেষ্টাই বলতে হবে। প্রথমে দেখতে হবে মিয়ানমার যেন তাদের স্বীয় মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বসবাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে। তখন সম্ভবত তারা অনেকেই অন্য কোথাও যেতে এমনভাবে আগ্রাসী প্রচেষ্টা নেবে না। আর আমাদেরও শিবিরবাসীর দ্বীপান্তরের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগটির সব দিক তলিয়ে দেখা দরকার। এতে আদৌ সমস্যা সমাধান না হয়ে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করবে কি না, তা নিয়ে ভাবার আছে। আর বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা তো শুধু ৩২ হাজার নয়, কয়েক লাখ। তদুপরি সেই অবশিষ্টরা অচিহ্নিতও বটে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.