শ্রমবাজারে ধস নিষ্ক্রিয় ৫০০ এজেন্সি by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

মুখ থুবড়ে পড়েছে জনশক্তি রপ্তানি বাজার। এ খাত এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। আর নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে খাতের এক হাজারের উপরে উদ্যোক্তা তথা বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি। অর্ধেকেরও বেশি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের এই ব্যবসা এখন নিষ্ক্রিয়। তারা অন্য ব্যবসায় মনোযোগ দিচ্ছেন। হাতেগোনা মাত্র ২০ থেকে ২৫টি এজেন্সি নিয়মিত ব্যবসা করছে বলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) সূত্র জানিয়েছে। বাকিরা কোন রকমে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন। এদিকে নিয়মিত ব্যবসা না করলেও প্রতি তিন বছর পরপর প্রতিটি লাইসেন্সের বিপরীতে ৬০ হাজার টাকা করে জমা দিতে হচ্ছে বলে তারা উল্লেখ করেন। জামানত হিসেবে সাধারণ লাইসেন্সের বিপরীতে ১৫ লাখ টাকা আর যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি নারী কর্মী পাঠাবে তাদেরকে বর্ধিত জামানত হিসেবে আরও ১৫ লাখ টাকা সরকারের কাছে জামানত রাখতে হচ্ছে। বায়রার অনেক সদস্যই জনশক্তি রপ্তানি খাতের ধ্বংসের জন্য সরকারের ভুল নীতি এবং কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। এ ছাড়া সরকারিভাবে লোক পাঠানোর বিরোধিতাও করেছেন সংগঠনের সদস্যরা। তারা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় মাধ্যম জনশক্তি রপ্তানি খাতে এখন চরম অচলাবস্থা বিরাজ করছে। গত পাঁচ ছয় বছরে একের পর এক বাজার হাতছাড়া হয়ে গেছে। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, কাতার, লিবিয়াসহ অন্যান্য দেশে জনশক্তি রপ্তানি নেই বললেই চলে। ফলে জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত এক হাজারের উপরে ব্যবসায়ী  চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন।
‘হ’ আদ্যাক্ষরের এক এজেন্সির মালিক ক্ষোভের সুরে এই প্রতিবেদককে বলেন, গত তিন চার বছর তিনি জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা করছেন না। অন্য ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছেন। আবার সময় সুযোগ এলে এই ব্যবসা করবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশীদের জন্য বিশ্বের শ্রম বাজার অনেকটা সঙ্কুচিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে চাহিদা কমছে। অনেক দেশ আগের মতো কর্মী রপ্তানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানিতে রীতিমতো ধস নেমেছে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশে কর্মীদের কাজের সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। এ অবস্থায় বিশ্ববাজারে কর্মী রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। আর এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া।
বাংলাদেশ থেকে ১৬০টি দেশে এখন কর্মী যাচ্ছে। এর মধ্যে ৬২টি নতুন শ্রমবাজার। এই দাবি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু শ্রমবাজারের গত চার দশকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৬০টির মধ্যে ১০০ দেশ আছে যেখানে গত ৪০ বছরে সর্বোচ্চ ১০০ কর্মীও যায়নি। বাকি ৬০টি দেশের মধ্যে ৪০টিতে নামমাত্র কর্মী গেছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) তথ্য বলছে, চার দশক ধরে প্রচলিত ১১টি দেশেই বাংলাদেশের শ্রমবাজার সীমাবদ্ধ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে সে দেশে কর্মী নেয়া প্রায় বন্ধ। দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতেও ব্যাপক হারে কর্মী নেয়া বন্ধ ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। তৃতীয় বড় বাজার মালয়েশিয়ায় কর্মী যাচ্ছে না চার বছর ধরে। আর কুয়েতের শ্রমবাজার বন্ধ সাত আট বছর ধরে। বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া ও ইরাকে কর্মী গেলেও সেই সংখ্যা বেশি নয়। ফলে ২০১৩, ২০১৪ এবং চলতি বছরে এসে ওমান, কাতার ও সিঙ্গাপুরেই আটকে গেছে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশী জনশক্তির দ্বিতীয় বৃহত্তর শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতে বড় রকমের ধস নেমেছে। ২০০৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে জনশক্তি রপ্তানি হয় ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন। ২০১০ সালে তা কমে নেমে আসে ২ লাখ ৩৩০৮-এ। আর ২০১৩ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ১৪,২৪১ এবং ২০১৪ সালে ২৪ হাজার ২৩২ জনে। চলতি বছরের প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসে দেশটিতে গেছেন ১৪ হাজার ৩৪৩ জন কর্মী। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই ব্যাপক হারে বাংলাদেশ কর্মী নেয়া বন্ধ হয়ে পড়ে। সেই বছরে দেশটিতে গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ২৪ হাজার কর্মী যেত। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সবচেয়ে শ্রমবাজার সৌদি আরবও ২০০৮ সালের পর থেকে ব্যাপক হারে বাংলাদেশী থেকে কর্মী আমদানি করছে না। সৌদি আরবে ২০০৮ সালে ১ লাখ ৩২ হাজার ১২৪ কিন্তু ২০১৩ সালে সেখানে এ সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৮৫৪ জন। আর ২০১০ সালে গেছেন মাত্র ৭,০৬৯ জন। চলতি বছরে সাড়ে পাঁচ মাসে গেছেন ১০ হাজার ২৯৪ জন কর্মী।
আবার ওমান, কাতার বাংলাদেশীদের আগের মতো ভিসা দিচ্ছে না। ইরাক, কুয়েত ও লিবিয়া সরকারও বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি প্রায় বন্ধ রেখেছে। দেশগুলোতে অল্প পরিসরে কর্মী নিচ্ছে। যদিও এ বছর গতবছরের তুলনায় কর্মী যাওয়ার সংখ্যা খুব সামান্য বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) সাবেক মহাসচিব এবং বর্তমান কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি আলী হায়দার চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, ব্যবসা সব সময় এক রকম যায় না। ব্যবসা প্রায় বন্ধ। চাহিদা সংগ্রহ করতে পারছি না। শ্রমবাজারে নানা জটিলতা আছে। তিনি মনে করেন, নতুন নতুন শ্রমবাজার সমন্বিতভাবে খোঁজতে হবে। সকরকার এ খাতের গতি বাড়ানোর জন্য কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। বড় বড় সঙ্কোচিত শ্রমবাজারকে সম্প্রসারণ করতে হবে। ট্রেডিশনাল বা অনেক বন্ধ বাজার খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, কম অভিবাসন ব্যয়ে অধিক কর্মী বিদেশে যাবে, এটা সবাই প্রত্যাশা করে। কিন্তু কম কর্মী যাওয়া কারোই কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী মানবজমিনকে বলেন, বর্তমানে শ্রমবাজার চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। ট্রেডিশনাল বা অনেক বন্ধ বাজার খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। এসব বাজারে ঢুকতে হবে। সরকারের দিক থেকে নজর বেশি দিতে হবে। তিনি বলেন, গত বছরের চেয়ে যদিও এছরর কর্মী যাওয়া সামান্য বেড়েছে। এটা  হয়েছে নারী কর্মীরা একটু বেশি আগ্রহ দেখিছেন। পুরুষ সংখ্যা বাড়েনি। এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরকে আরও ডায়নামিক হতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব খন্দকার মো. ইফতেখার হায়দার মানবজমিনকে বলেন, জনশক্তি রপ্তানি কখনও কমেনি। এ বছর ইতিমধ্যেই দুই লাখ আঠারো হাজার কর্মী বিদেশ গেছেন। ৯৫ ভাগই প্রাইভেট সেক্টরের মাধ্যমে গিয়েছেন। আশা করি চলতি বছরে পাঁচ লাখ কর্মী যাবে। বায়রার সদস্যরা সরকারকে সহায়তা করে। তারা আমাদের সম্পূরক শক্তি। তাদের একমাত্র হতাশা মালয়েশিয়ায় কর্মী  পাঠানো নিয়ে। এটা কেটে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.