এক বছরেও নূর হোসেনের মামলায় চার্জ গঠন হয়নি by পরিতোষ পাল

নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশের দায়ে ফরেনার্স আইনে করা মামলা এক বছর পেরিয়ে গেলেও আদালতে চার্জ গঠন করা সম্ভব হয়নি। ফলে তাকে বাংলাদেশের ফেরত পাওয়া এখনও দুরূহ বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। গ্রেপ্তারের এক মাসের মধ্যেই অবশ্য উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসাতের মুখ্য বিচার বিভাগীয় হাকিমের আদালতে নূর হোসেনকে ফেরত চেয়ে বাংলাদেশ যে আবেদন করেছে সেটি নথিভুক্ত হয়েছিল বলে জানিয়েছেন সরকারি কৌঁসুলি বিকাশরঞ্জন দে। তারপর আর এ নিয়ে আদালতে সরকারি কৌঁসুলির তরফে নতুন করে আর কোন আবেদন জানানো হয়নি। তবে গত একবছরে একডজনেরও বেশি বার আদালতে নূর হোসেনকে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু গত ১৮ই আগস্ট পুলিশ চার্জশিট দাখিল করলেও প্রত্যেকবারই মামলার তিন আসামি একসঙ্গে হাজির না থাকায় চার্জ গঠন করা যায়নি বলে তদন্তকারী পুলিশ অফিসার জানিয়েছেন। তবে ফরেনার্স আইনের ১৪ ধারায় করা এই মামলায় নূর হোসেনের সর্বোচ্চ ৫ বছর জেল হতে পারে। নূর হোসেন বর্তমানে দমদম সংশোধনাগারে রয়েছেন। বন্দিদের সঙ্গে তিনি খোশ মেজাজেই সময় কাটান বলে জেল সূত্রে জানা গেছে। শেষবার গত ২২শে এপ্রিল নূর হোসেনকে তার এক সঙ্গীসহ বারাসাত আদালতে হাজির করা হয়। কিন্তু মামলার অপর জামিনে থাকা আসামি উপস্থিত না থাকায় শুনানি হয়নি। পরবর্তী হাজিরার দিন ধার্য হয়েছে ২২শে  জুলাই। যদিও এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে মন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ কর্তারা বারে বারে নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তৎপরতার কথা জানালেও ভারতে সেই ধরনের কোন তৎপরতার প্রতিফলনের কথা মামলার সঙ্গে যুক্ত পদাধিকারীরা জানাতে পারেননি। মামলায় এখনও পর্যন্ত নূর হোসেন কোন আইনজীবী দেননি। তবে তার সঙ্গে অন্য দুইজন আইনজীবী দিয়ে জামিনের চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে খান সুমন ধরা পড়ার কয়েক মাসের মধ্যেই জামিন পেয়ে গিয়েছেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, ১০ই জুন বৈধ কাগজপত্র নিয়েই তিনি বিমানে করে কলকাতায় এসেছিলেন। মনে করা হচ্ছে, মামলা প্রলম্বিত করার কৌশল হিসেবেই তিন আসামিকে এক করা সম্ভব হচ্ছে না।  গত বছরের ১৪ই জুন  কলকাতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরে কৈখালিতে ভিআইপি রোডের উপর সুবিশাল ইন্দ্রপ্রস্থ আবাসনের এ ব্লকের একটি বাড়ির চার তলার ৫০৩ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল নূর হোসেন ও তার দুই সহযোগী খান সুমন ও ওহিদুল জামান। গত ১৫ই জুন বারাসাত আদালতে পুলিশ যে কেস ডায়েরি পেশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার শিমরাইলের বাসিন্দা নূর হোসেন ওরফে চেয়ারম্যান, বন্দর থানার কুড়ি পাড়ার ওহিদুল জামান শালিম ওরফে শালিম ও ফতুল্লা  থানার বাসরবাদের খান সুমন ওরফে বিট্টুকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে বিদেশী আইনের ১৪ ধারায় মামলা করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, এরা বসিরহাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল। এদের কাছে ভারতের ও বাংলাদেশের ১১টি সিম কার্ড এবং ভারত ও বাংলাদেশের কয়েক হাজার টাকা পেয়েছে। তবে এদের কাছে কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ আদালতে জানিয়েছে। পুলিশ প্রথম দিকে নূর হোসেনকে হেফাজতে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশী অপরাধী ও তার কনটাক্টম্যানদের খোঁজে তল্লাশি চালালেও পরবর্তী সময়ে আর রিমান্ডে নেয়া হয়নি। এরপর থেকে সে জেল হেফাজতে রয়েছে। ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, গত বছরের ২৭শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহৃত হন। অপহরণের পরপরই নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে মামলা করা হয়। মামলার পর অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিলেও তিন দিনের মাথায় শীতলক্ষ্যা নদীতে অপহৃতদের লাশ ভেসে ওঠার পর লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান নূর হোসেন। নূর হোসেন ও তার সহযোগীরা র‌্যাবকে ছয় কোটি টাকা দিয়ে নজরুলসহ সাতজনকে হত্যা করিয়েছেন বলে নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন। তার অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব-১১-এর তখনকার অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাকে অবসরে পাঠানো হয়। এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হন। আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে আরিফ ও রানা ওই ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেন। নূর হোসেনের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের বিনিময়ে তারা নজরুলসহ সাতজনকে খুন করেছেন বলে স্বীকারোক্তি দেন। তবে ঘটনার পর থেকেই নূর হোসেন পলাতক ছিলেন। র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নূর হোসেন কলকাতায় পালিয়ে গেছেন। তাকে ধরার জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছিল। ভারতের কাছেও পাঠানো হয়েছিল সেই আবেদন। সেই নোটিশের ভিত্তিতেই নূর হোসেনকে শনাক্ত করেছিল বিধান নগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দারা। আদালতে হাজির হবার প্রথম দিকে নূর হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন যে, তিনি রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার। আর বাংলাদেশে মামলা হওয়াতেই তিনি ভারতে চলে এসেছেন। কে তাকে ফাঁসিয়েছে তার নাম বলতে অস্বীকার করলেও তিনি জানিয়েছেন, যে তাকে ফাঁসিয়েছে সেই তাকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে। একপর্যায়ে তিনি দাবি করেছিলেন, নজরুলের সঙ্গে তার কোন বিরোধ ছিল না। তিনি র‌্যাবকে কত টাকা দিয়েছেন জানতে চাইলে রাগত ভঙ্গীতে নূর হোসেন বলেছিলেন, র‌্যাবকে কেন টাকা দেব ? কোন টাকাই আমি দিইনি। তবে পরবর্তী কালে নূর হোসেন সাংবাদিকদের কাছে আর কোন কথাই বলেন নি।

No comments

Powered by Blogger.