পরিবহন খাতে বিপর্যয়, বসে আছে ৫০ শতাংশ যান

চট্টগ্রাম শহরে ১৬ ফেব্রুয়ারি হরতালে বাসে আগুন l ছবি: প্রথম আলো
টানা দুই মাসের অবরোধ-হরতালের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে যানবাহন। এ কারণে দিনে ঢিলেঢালা, রাতে অচল—এমন চিত্র এখন মহাসড়কগুলোতে। ফলে পরিবহন খাতে নেমে এসেছে বিপর্যয়।
পরিবহন মালিক সমিতিগুলোর হিসাবে, এখনো ৫০ শতাংশ বাস-ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানসহ বাণিজ্যিক যান বসে থাকছে। গত দুই মাসে আগুন-পেট্রলবোমা হামলা-ভাঙচুরে যানবাহনের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২৫ কোটি টাকা। আর বসিয়ে রাখা যানগুলো থেকে মালিকেরা আয়বঞ্চিত হচ্ছেন দৈনিক ১৫০ কোটি টাকা করে। রেলে ১৮৩টি নাশকতার ঘটনায় সময়সূচিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। তবে দু-একটি ঘটনা বাদ দিলে সেই তুলনায় নৌপথ ছিল মোটামুটি নিরাপদ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির হিসাবে, গত ৬ জানুয়ারি থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাস-ট্রাক-ট্যাংকলরিসহ প্রায় ৮০০ যানবাহন পোড়ানো হয়েছে। ভাঙচুর হয় প্রায় ১ হাজার ২০০টি যান। এসব তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও পাঠানো হয়েছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত যানবাহনের মালিকদের মধ্যে ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। পর্যায়ক্রমে আরও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ভাঙচুর ও পোড়ানোর কারণে এ পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ ১২৫ কোটি টাকা। তাঁরা হিসাব করে দেখেছেন, সারা দেশের সব বাস-ট্রাক বন্ধ থাকলে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হন মালিক-শ্রমিকেরা। এর মধ্যে তাঁদের আয়, ব্যাংকঋণের সুদ ও অফিস খরচও রয়েছে।
পরিবহনমালিকেরা জানান, সরকার গত ১০ ফেব্রুয়ারি মহাসড়ক ধরে চলা যাত্রীবাহী যান রাত নয়টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানোর সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। ফলে ভোর ছয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্তই দূরপাল্লার বাস ছাড়া হচ্ছে। অথচ স্বাভাবিক সময়ে দিনের তুলনায় রাতেই যাত্রী ও যানবাহন দ্বিগুণ চলে। এখনো বিচ্ছিন্নভাবে রাতে কিছু বাস চলছে। তবে সব মিলিয়ে দূরপাল্লার বাস চলাচলের হার ৪০ শতাংশের বেশি নয়।
ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানসহ পণ্যবাহী যান ২৪ ঘণ্টাই চলে। এখন ৩০-৪০ শতাংশ পণ্যবাহী যান বসে আছে।
মালিক সমিতির নেতারা মনে করছেন, চলমান অবরোধ-হরতালে দূরপাল্লার পথে বাস-ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানসহ বাণিজ্যিক যানের চলাচল ৫০ শতাংশের বেশি হবে না। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, গত এক সপ্তাহে যেভাবে যানবাহনে আগুন ও শ্রমিকদের পোড়ানোর ঘটনা বেড়েছে, আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই।
রাতে বিভীষিকা: রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার ভোর ছয়টা থেকে বুধবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত দৌলতদিয়া ঘাট পার হয়ে ঢাকার দিকে গেছে ২ হাজার ৪১টি যানবাহন। এর মধ্যে ট্রাক ৯৩৮টি, ব্যক্তিগত গাড়ি ৭৪০ ও বাস ৩৬৩টি। স্বাভাবিক সময়ে পার হয় এর দ্বিগুণ। মঙ্গলবার রাত ১০টা থেকে বুধবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত পার হয় ৫১১টি যান। এর মধ্যে বাস ৬৮টি।
বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার ভোর থেকে বুধবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় এই সেতু দিয়ে যানবাহন চলেছে ৯ হাজার ৩০০টি। এর মধ্যে রাতে চলে ৪ হাজারটি, এর ৮০ শতাংশই ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। বাকি ২০ শতাংশ বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি। স্বাভাবিক সময়ে সেতু দিয়ে দৈনিক যান চলে সাড়ে ১২ হাজার।
মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাখালী টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ বাস চলাচল করছে। তবে এর ৯০ শতাংশই দিনে চলে। স্বাভাবিক সময়ে চলে প্রায় এক হাজার বাস।
সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে স্বাভাবিক সময়ে আন্তজেলা পথে বাস চলে দেড় হাজারের বেশি। এখন রাতে বাস ছাড়ে না। দিনে চলে ৬০০ থেকে ৭০০ বাস।
রেলে বড় ক্ষতি সময়সূচি বিপর্যয় ও আয় হ্রাস: রেলওয়ে সূত্র জানায়, এবারের অবরোধ-হরতালে রেলে ১৮৩টি নাশকতার মধ্যে রয়েছে ফিশপ্লেট খুলে ফেলা, রেললাইন উপড়ে ফেলা, ট্রেনে ও লাইনে আগুন দেওয়া। এতে রেলের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। নাশকতার ফলে বড় ক্ষতি ট্রেনের সময়সূচির বিপর্যয়। আন্তনগর ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা ৮৫ শতাংশ থেকে এখন ৬০ শতাংশে নেমেছে।
গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে রেলের ঢাকা বিভাগীয় অঞ্চলে যাত্রী কমেছে দুই লাখ। আয়ও কমেছে প্রায় দুই কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতেও অবস্থা একই রকম।

No comments

Powered by Blogger.