মৃত্যুর দায় কমাতে আইন সংশোধন- নাগরিক জীবনকে আরো হুমকিতে ফেলবে

মানবাধিকার সংস্থা, কূটনীতিকদের হাতে গুম-খুনের তালিকা
নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর দায় থেকে নিজেদের হেফাজত করতে আইন সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে পুলিশ। তারা নিজেদের সুবিধার্থে এ আইনের সংজ্ঞা ও তদন্ত কার্যক্রমে পরিবর্তন, সাজা কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে। নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘ সনদের কার্যকারিতা দিতে এ আইন করা হয়েছিল। সহযোগী এক দৈনিকে প্রকাশিত এসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের শিকার আওয়ামী লীগের এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে বেসরকারি বিল হিসেবে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) বিল উত্থাপন করেছিলেন। অনেক যাচাই-বাছাই শেষে ২০১৩ সালে বিলটি সংসদে পাস হয়। কিন্তু দুই বছর পর যখন সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যুর ঘটনা এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ বাড়ছে, তখন এ আইনে সংশোধনী চাইছে পুলিশ।
পুলিশের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এ আইনের কারণে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, হরতাল, অবরোধ, বিােভ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম থেকে জনসাধারণের জানমাল রায় আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর কার্যকর পদপে নেয়ার েেত্র বাধার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
প্রস্তাবে আইনে ‘হেফাজতে মৃত্যু’ বলতে সরকারি কোনো কর্মকর্তার হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু, অবৈধ আটকাদেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গ্রেফতারের সময় কোনো ব্যক্তির মৃত্যুকেও বোঝানোর পরিবর্তে কেবল সরকারি কর্মকর্তার হেফাজতে থাকাকালে নির্যাতনের কারণে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু অথবা গ্রেফতারের সময় ফৌজদারি কার্যবিধি এবং অন্য কোনো প্রচলিত আইনের বিধানের অধীনের কৃতকাজ ব্যতিরেকে মৃত্যুকে বোঝানোর কথা বলা হয়েছে। আইনে সংুব্ধ ব্যক্তি যদি মনে করেন যে, পুলিশের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্ভব নয়, তবে তিনি আদালতে আবেদন করবেন এবং আদালত যদি সন্তুষ্ট হন, তবে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবেন। এর পরিবর্তে পুলিশ প্রতিবেদন দেয়ার পর যদি সংুব্ধ ব্যক্তি মনে করেন যে, পুলিশ প্রতিবেদন যথার্থ নয়, সেক্ষেত্রে তিনি যদি আদালতে আবেদন করেন এবং আদালত যদি তার আবেদনে সন্তুষ্ট হন, সেক্ষেত্রে  আদালত একজন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবেন মর্মে ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। এটি আসলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির প্রতিকার প্রাপ্তিকে অনিশ্চিত করে তুলতে পারে।
এ আইনের অধীনে সব অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণীয়, অ-আপসযোগ্য ও জামিন-অযোগ্য হবে মর্মে বিধান পরিবর্তন করে এই অপরাধকে জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য হিসেবে বিবেচিত করার কথা বলা হয়। এ ছাড়া আইনে কোনো মামলা নিষ্পত্তিকালে আদালত প্রয়োজনে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যূন সাত দিনের অন্তরীণ আদেশ দিতে পারবেন মর্মে বিধানের বিলুপ্তি চেয়েছে পুলিশ। আইনে কোনো ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন সংশোধন করে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এবং সর্বনি¤œ দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া আইনে নির্যাতনের সময় কারো মৃত্যুতে নির্যাতনকারীর অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পরিবর্তে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা ও তিপূরণ একই রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আমরা মনে করি, দেশে যখন পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের মহোৎসব চলছে, তখন এ ধরনের সংশোধনী এনে শাস্তি কমানো এবং দায় থেকে কৌশলে মুক্তি রাখার ব্যবস্থা নাগরিক জীবনকে আরো বেশি হুমকির মধ্যে ঠেলে দেবে। কোনোভাবেই এ ধরনের সংশোধনী অনুমোদন করা উচিত হবে না। এ ছাড়া সরকারের সামনে এই উপলব্ধি থাকা দরকার যে, যারা আজ ক্ষমতায় আছেন, তারা কাল নাও থাকতে পারেন। আর সে ক্ষেত্রে তারা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। এ কারণে রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোতে কোনো বাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতা কায়েম হওয়ার মতো সংশোধনী আনা সঠিক হবে না।

No comments

Powered by Blogger.