পূর্বাঞ্চলে শনির দশা ট্রেনে by জাবেদ রহিম বিজন

‘জায়গা জায়গা ট্রেন এমনে পড়তাছে কেরে বুঝতে পারলাম না। বোমাও তো  মারতাছে না কেউ।‘ ট্রেনের হাল-দুর্দশা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশনে তুহুরা বেগম নামের এক মহিলা যাত্রী এমনই বলছিলেন। আরেক যাত্রী রামু দাসের মন্তব্য- ‘মাইনষে কইতাছে অহন বলে ডরেই ট্রেন পইরা যাইতাছেগা’। তবে কারণ যা-ই হোক বাস্তবতা হচ্ছে অঘটন যেন পিছু ছাড়ছে না পূর্বাঞ্চল রেলপথে। রেলকে এখন আর নিরাপদ বাহন মনে করছেন না পূর্বাঞ্চলের যাত্রীরা। অবরোধে রেল সচল রাখতে আনসার মোতায়েন, ট্রেনের ইঞ্জিনে গার্ড, স্পর্শকাতর বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ প্রহরা; তার পরও সচল নেই ট্রেন। বারো রকম কারণে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বারবার এর যাত্রা। বগি লাইনচ্যুত, লাইন বাঁকা হয়ে যাওয়া, ইঞ্জিন বিকল- হররোজ কোন না কোন ঘটনায় অচল রেল যোগাযোগ। মোটকথা, সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছে না ট্রেন। লণ্ডভণ্ড সিডিউল। পূর্বাঞ্চল রেলপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমানাতেই অবরোধের এই দুই মাসে ৯ বার বিপর্যয় ঘটেছে ট্রেনের। ২০১৪ সালে পূর্বাঞ্চলে গড়ে প্রতিমাসে একটি ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছে। ওই বছর মোট ১৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। আর নতুন বছরের দুই মাসেই অঘটনের রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবরোধ শুরু হওয়ার পর ২ দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর এলাকায় চলন্ত ট্রেনকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুড়ে মারে অবরোধকারীরা। এ ঘটনাগুলো ছাড়া অবরোধকারীদের রেলপথে আর কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি। কিন্তু প্রতিটি ঘটনার পর রেলের লোকজন নিজেদের দায় এড়াতে ‘নাশকতা’ বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। আখাউড়া জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় কোন নাশকতা হয়নি। রেলপথ ও রেল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই বারবার ট্রেনে বিপর্যয় ঘটছে। ৫ই জানুয়ারি ঢাকা থেকে কুমিল্লাগামী ডেমু ট্রেনে ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এতে আহত হন দুই যাত্রী। এরপর ১লা ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের শিমরাইলকান্দি এলাকায় ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এছাড়া নাশকতার কোন খবর পাওয়া যায়নি। ২৫শে জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাঘাচংয়ে সিলেট থেকে ঢাকাগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ৩শ’ ফুট রেললাইন। প্রায় সাড়ে ৯ ঘণ্টা ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেট ও নোয়াখালীর ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ থাকে। দুর্ঘটনার কারণে পাঘাচং রেলস্টেশনের সিগন্যাল ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় স্টেশনটির কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পরই রেলওয়ের চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তারা প্রাথমিকভাবে নাশকতার কারণে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে বলে কারণ চিহ্নিত করে। তবে রেলপথের আশপাশ এলাকার মানুষ দুর্ঘটনার জন্য ওই স্থানের দুর্বল রেলপথকেই দায়ী করেন। তারা জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার রেলপথের অনেক স্থানেই ঠিকমতো স্লিপার নেই। আবার স্লিপার থাকলেও তা পচা। বেশির ভাগ স্লিপার ক্লিপ দিয়ে আটকানো নেই। কোথাও কোথাও স্লিপার মাটিতে বসে গেছে। গত ৭ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় চট্টগ্রামগামী নাসিরাবাদ এক্সপ্রেসের ১টি বগি লাইনচ্যুত হয় আখাউড়ার গঙ্গাসাগরে। এতে ৪ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। চাকা খুলে যাওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। ১৩ই ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুনিয়াউটে ঢাকাগামী চট্টলা এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ও ২টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এটি সিগন্যাল ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে ঘটে বলে জানা যায়। ৫ই মার্চ একই স্থানে নোয়াখালী থেকে ঢাকাগামী উপকূল এক্সপ্রেসের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বিঘ্ন ঘটে। লাইনে ত্রুটির কারণে এই দুর্ঘটনা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ১৯শে ফেব্রুয়ারি আশুগঞ্জের অদূরে ঢাকাগামী চট্টলা এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন বিকল হয়ে ২ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। পরদিন ২০শে ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড়হরণ আউটারে ঢাকাগামী কর্নফুলী এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন বিকল হয়ে এক ঘণ্টারও বেশি ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। ২রা মার্চ দুপুরে পাঘাচংয়ে ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেসের একটি বগির চাকায় ত্রুটি দেখা দিলে সিলেট ও চট্টগ্রামের মধ্যে আপ লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ১৬ই ফেব্রুয়ারি আশুগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকায় লাইন বাঁকা হয়ে যাওয়ায় প্রায় ২ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি চিনাইর এলাকায় ৩০-৪০ ফুট রেললাইন বাঁকা হয়ে যায়। এ ঘটনায় বিকাল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। আখাউড়া জংশনের পথ ও পূর্ত বিভাগের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেক কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনায় পড়া ট্রেন উদ্ধারের দায়িত্বে থাকা আখাউড়া লোকোসেড ইনচার্জ মহসীন উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, দুর্ঘটনা যখন হয় পরপর কয়েকটা হয়। চাকরি জীবনে এমনটাই দেখছি। সম্প্রতি যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার কোনটি হয়েছে সাবোটাজে, কোনটি রেললাইনে ত্রুটির কারণে, কোনটি প্রাকৃতিক কারণে। আখাউড়া জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইয়াছিন ফারুক মজুমদার বলেন, আমাদের এলাকায় কোন নাশকতার কারণে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়নি। রেললাইনে ত্রুটি, রেলে সমস্যা ও রেল বিভাগের লোকজনের দায়িত্বহীনতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। রেলপথে সংশ্লিষ্টদের কোন তদারকি নেই। তারা ঠিকভাবে কোন কাজ করে না।

No comments

Powered by Blogger.