কূটনৈতিক উদ্যোগও শর্তের বেড়াজালে

শিগগির চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। পরিস্থিতি উত্তরণে কূটনীতিকদের সম্মিলিত উদ্যোগ খানিকটা 'ইতিবাচক' মনে হলেও তা আদৌ সুফল বয়ে আনবে কি-না, তা নিয়েও কম সংশয় নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও আন্দোলনকারী বিরোধী দল বিএনপির পাল্টাপাল্টি শর্তের বেড়াজালে আপাতত আটকা পড়েছে এই উদ্যোগ। বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ, সহিংসতা-নাশকতা বন্ধ এবং টানা অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি প্রত্যাহারের শর্ত দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, মধ্যবর্তী নির্বাচন এজেন্ডাভুক্ত করে সংলাপের ঘোষণা, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার এবং দলের নেতাকর্মীদের মুক্তির শর্ত দিয়েছে বিএনপি। কার্যত দু'পক্ষই যার যার আগের অবস্থানেই অনড়। গভীর এই সংকট নিরসনে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে নারাজ উভয় পক্ষ।বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কূটনীতিকদের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট এ ব্যাপারে অনেকটা নিষ্পৃহ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সরকারের অনড় মনোভাবের প্রেক্ষাপটে বিএনপিও অনির্দিষ্টকালের অবরোধের মধ্যেই আগামীকাল রোববার থেকে হরতালসহ আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে সংকট নিরসনে সহিংসতা বন্ধ করে সংলাপে বসতে নাগরিক সমাজের উদ্যোগেও সাড়া দেয়নি দুই দল। পরে সে উদ্যোগটিই বিতর্কিত হয়ে পড়ে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান গতকাল সমকালকে বলেন, কূটনীতিকদের তৎপরতাকে তারা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। বরফের ওপর কিছুটা উত্তাপ পড়তে শুরু করেছে। তবে বল এখন সরকারের কোর্টে। তিনি আশা করেন, কূটনীতিকদের উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে সরকার সংকট সমাধানে এগিয়ে আসবে।খালেদা জিয়ার সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকারী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, সংকট নিরসনে সরকারকেই একটি সমঝোতার পথ খুঁজে বেরকরতে হবে। কূটনীতিকদের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিনিও।
সূত্র জানায়, বৈঠককালে পশ্চিমা ১৬ কূটনীতিক বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সংলাপের উদ্যোগের পরিবেশ তৈরিতে টানা অবরোধ-হরতাল স্থগিত, সহিংসতা-নাশকতা বন্ধ, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়ার শর্ত দিয়েছেন। বৈঠকে সংকট উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা অর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠকের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকটি করেছেন বলেও জানান কূটনীতিকরা।তবে খালেদা জিয়া তাদের মাধ্যমে পাল্টা কয়েকটি শর্ত দিয়েছেন। এর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে সব দলের অংশগ্রহণে মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য সংলাপের উদ্যোগ ঘোষণা, দলের নেতাকর্মীদের মুক্তি, সভা-সমাবেশে বাধা না দেওয়া এবং তার চলাচলে বাধা দূর করা অন্যতম। কূটনীতিকরা বিএনপি নেত্রীর দেওয়া শর্তগুলো সরকারকে জানিয়ে দিয়েছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি।
সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া কূটনীতিকদের সঙ্গে দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। বিএনপি নেত্রী জানান, সংবিধানের ধারাবাহিকতার কথা বলে আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করেছে। তারা এক বছর সরকারকে সময় দিয়েছেন। সরকার সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। একই সঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, সরকার বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে তাকে, তার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। খালেদা জিয়া দলের খুন ও গুম হওয়া নেতাকর্মীদের একটি তালিকাও কূটনীতিকদের হাতে তুলে দেন। অবশ্য খালেদা জিয়ার সঙ্গে ১৬ কূটনীতিকের বৈঠকের ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দু'দলই অস্তিত্ব লড়াইয়ে নেমেছে। আওয়ামী লীগ চায় বিএনপিকে ধাক্কা দিতে দিতে খাদে ফেলে দিতে। যেভাবে গ্রেফতার ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তাতে একসময় বিএনপি নিঃশেষ হয়ে যাবে বলে মনে করে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে চলমান আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ পাবে এবং সরকারের পতন অনিবার্য বলে মনে করে বিএনপি। এরপর দেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে তারা অচিরেই আবার ক্ষমতায় আসবে। এ পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কম।
এদিকে জনমতের বিপরীতে 'ইস্যুবিহীন' আন্দোলন করতে গিয়ে এবং সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে সারাদেশেই বিএনপি নেতাকর্মীরা কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন বলেও মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, রাজপথে নেমে আন্দোলনের পরিবর্তে চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি কার্যকর করার কৌশল বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত।সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলছেন, বিএনপি জোট লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে গেলেও তাতে কোনো ধরনের জনসম্পৃক্ততা ঘটাতে পারেনি; বরং জনগণ তাদের এই সহিংস আন্দোলন, বিশেষ করে পেট্রোল বোমা মেরে ও নৃশংস কায়দায় মানুষ পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় সবিশেষ ক্ষুব্ধ।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সংলাপ প্রশ্নে কূটনীতিকদের আহ্বানে সরকার কোনো চাপ অনুভব করছে না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কিসের সংলাপ? ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে কোনো সংলাপ হবে না। আর ওই নির্বাচনের আগে যে সংলাপ হবে_ সেটি বিএনপির সঙ্গে নয়, নির্বাচন প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে।দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, বিএনপি এখন সংলাপের নামে বিদেশি প্রভুদের কাছে ধরনা দিয়ে অনুনয়-বিনয় করছে। এতে লাভ হবে না। জনগণ না চাইলে কোনো বিদেশি প্রভুই তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারবে না।

No comments

Powered by Blogger.