আর কত যুগ লাগবে? by আলী ইদ্‌রিস

সংবিধান  অনুযায়ী ও নীতিগতভাবে  দেশটার মালিক জনগণ। কিন্তু জনগণ সরাসরি রাষ্ট্র চালাতে পারে না বলে গণতান্ত্রিক কিংবা সমমানের প্রক্রিয়ায় ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে হয় যারা দেশ চালান। অতি মূল্যবান ভোটটি প্রদানের পর পরই জনগণ নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ক্ষমতাহীন, অকেজো হয়ে পড়েন। আর একটি ভোটের সুযোগ না আসা পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই জনগণকে চালান, নিয়ন্ত্রণ করেন, এমনকি অত্যাচার, অবিচারও করেন। গণতন্ত্রের এ অসুবিধাটুকু মেনে নিলে গণতন্ত্রই প্রতিনিধি নির্বাচনের  সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। ২০০৮ সালে ১৪দলীয় মহাজোটকে আমরা ভোট দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় এনে দিয়েছিলাম ক্ষমতাসীন দলের কর্মকাণ্ড বিবেচনা করেই। সুতরাং রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডই তাদের জয় বা পরাজয়ের জন্য দায়ী। জলের মতো এই সহজ এবং পরিচ্ছন্ন সত্যিটি রাজনৈতিক দলগুলো অনুধাবন করেও না করার ভান করে। তারা আমাদের নেতানেত্রী, হর্তাকর্তা হয়েও, হরতাল অবরোধে, পেট্রলবোমায় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শত শত মানুষ হতাহত হওয়া এবং গত ৫২ দিনে দেশের এক লাখ বিশ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হওয়ার পরও কোন পক্ষই হার মানা দূরে থাক, এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নন, অর্থাৎ কেউ যে কারুর চেয়েও দুর্বল বা কম মর্যাদাসম্পন্ন নয় তা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। ২০ দলের আন্দোলনে এখন জনমানুষ তিক্ত-বিরক্ত। বিশ দল সেটা  অস্বীকার করলেও স্পষ্ট ও নিরঙ্কুশভাবে বলছে না যে, তারা নাশকতায় জড়িত নয়। তবে দেখা গেছে যে, ধরা পড়া অনেকেই ২০ দলের লোক। এদিকে  সরকারের লোকেরাও নাশকতায় হাতেনাতে ধরা পড়ছে। সহিংসতা, নিরপরাধ মানুষ হত্যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, এটা অত্যন্ত ঘৃণার বিষয়। এ খারাপ নজির সৃষ্টি করে রাজনীতিবিদগণ নিজেদের তথা গণতন্ত্রের বিরাট ক্ষতি করলো। কারণ তারা যখন ক্ষমতায় আসবে তখন বিরোধী দল বিভিন্ন অজুহাতে একই কাজ করে সরকার পতনের চেষ্টা করবে।
সুতরাং সমস্ত খারাপ নজির এ হতভাগ্য দেশের জন্য, গণতন্ত্রের  জন্য, অশনি সংকেত। যে দলই রাষ্ট্রীয় বা দলীয় ক্ষমতার বলে প্রতিপক্ষের ওপর অত্যাচার, অবিচার, নির্মম আচরণ করবে তার ওপর প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ নেমে আসবে যা গণতন্ত্র, দেশ, জনমানুষ তথা অর্থনীতিকে অশান্ত, অস্থিতিশীল করে তুলবে। নাশকতা যারাই করুক সেটা গ্রহণযোগ্য নয়, প্রকৃত অপরাধীকে অবশ্যই  আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তি দিতে হবে যাতে জনমানুষের জীবনে শান্তি আসে। সহিংসতায় একশ’র অধিক প্রাণ গেল, শ্রমজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ফুটপাথের হকার, কৃষক ও অনেক পেশাজীবীর রোজগার প্রায় বন্ধ, দেশের রপ্তানি শিল্পের প্রাণ পোশাক কারখানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত, বিদেশী ক্রেতারা একবার অন্য দেশে চলে গেলে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। ইতিমধ্যে দেশে যে এক লাখ বিশ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি সংঘটিত হয়ে গেছে, পারবে কোন রাজনৈতিক  দল দেশের এ ক্ষতি পুষিয়ে দিতে? রাজনীতি কি দেশের সর্বনাশ করার জন্য? সর্বনাশ তো অনেক হয়েছে। এবার কি রাজনৈতিক নেতানেত্রীবৃন্দ নিজেদের  ইগো, শক্তি প্রয়োগ বন্ধ করে অসহায়, জিম্মি জনগণের ভোগান্তি ও দেশের চরম ক্ষতির ব্যাপার বিবেচনায় নিয়ে কিছু ছাড় দেবেন? জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেসে বিদ্ধ হচ্ছে। যারাই ছাড় দেবেন অসহায় জনগণ তাদেরকে মাথায় বসিয়ে পূজা করবে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অথবা  ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্যই তো এত বিবাদ। কোন দেশের ইতিহাসে নেই যে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী হয়। ২০দলীয় জোটের  হিংসাত্মক আন্দোলন বন্ধ করে গণতান্ত্রিক পন্থায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে নেয়া উচিত। তাতে সরকার যদি বাধা দেয় জনগণ সাক্ষী থাকবে, জনগণই হয়তো একদিন তাদের অহিংসা, ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখে রাস্তায় নামবে। অনেক সময় জয় লাভের উদ্দেশ্যে পরাজয় মেনে নিতে হয়, তাতে সম্মান খর্ব হয় না  বরং মর্যাদা বাড়ে। সরকার তো বাধা দিয়েই আসছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নিরঙ্কুশ, নির্লোভ অবস্থানকেও সরকার মেনে নিচ্ছে না। এ হতভাগ্য দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় এলেই ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য যত রকম ফন্দি-ফিকির, কৌশল অবলম্বন করে। তাতে বিরোধী দল, প্রতিবাদ প্রতিরোধ করে। ফলে বিরোধ, অশান্তি, হরতাল- অবরোধ দেখা দেয়। অথচ পাশে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে বাংলাদেশের প্রায় আটগুণ বেশি জনসংখ্যা নিয়েও কত শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, তা দেখে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। সেই শিক্ষা গ্রহণ করতে আমাদের আর কত যুগ লাগবে?
আলী ইদ্‌রিস

No comments

Powered by Blogger.