মুজতবা আলীর গল্প ও জার্মান যাজকের হিউমার by জয়া ফারহানা

রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন হবে কি? ক্ষমতাসীন হয়ে দুই দলই প্রায়
একই আচরণ করে জনগণের সঙ্গে। অদ্ভুত কাণ্ড, ক্ষমতার বাইরে গেলেও
তাদের ক্ষমতাচারণের প্যাটার্নও একইরকম। নেতিবাচক ভোটের মাধ্যমে দুই দলই
দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন আর ২০১৪ সালের
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত দুই দলই
আওয়ামী লীগ দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল। তার সাফল্যের টুপিতে পালকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কিন্তু শুধু অতীতের অর্জন আর ঐতিহ্যের ওপর ভর করে কোনো দল যে শাসন ব্যবস্থায় নিরবচ্ছিন্ন নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারে না, তার সাম্প্রতিক উদাহরণ দিল্লির বিধানসভার নির্বাচন। ভারতের স্বাধীনতা এনেছে যে রাজনৈতিক দল, এ নির্বাচনে সেই কংগ্রেসের বিশাল ভরাডুবির কারণগুলো খতিয়ে দেখলে তা থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকদেরও শেখার আছে অনেক কিছু। স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্য ও কৃতিত্বের রাজনৈতিক পুঁজি দিল্লির ভোটের বাজারে কোনো কাজে আসেনি। স্বাধীনতার মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে কোনো দল যদি কিছু ব্যক্তি পরিবার এবং গোষ্ঠীর স্বার্থের কাছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়, তাহলে স্বাধীনতার আদর্শ ও চেতনার বিজ্ঞাপনও যে কোনো কাজে আসে না, বিধানসভার নির্বাচন তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। কিন্তু মুশকিল এই যে, পাশের দেশটির নির্বাচন নিয়ে কোনো তুলনামূলক বিশ্লেষণ আমাদের এখানে সম্ভব নয়। তাতে দুই দলের অ্যাক্টিভিস্টরা যতটা না নাখোশ হন, তার চেয়ে শতগুণ বেশি আক্রমণের ঢাল-তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাদের বশংবদ বুদ্ধিজীবী এবং দলীয় মিডিয়া (রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ)। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর বহুল প্রচলিত একটি গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। গল্পটি এ রকম : টম ও ডিক দুই বন্ধু রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ টমের চোখে পড়ল রাস্তায় একটি একশ ডলারের নোট পড়ে আছে। টম সেটা কুড়ানোর আগেই ডিক সেটা তুলে নিল। এবার ডলারের মালিকানা নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে তুমুল ঝগড়ার এক পর্যায়ে টম বলল, সে আগে নোটটা দেখেছে কাজেই ওটা তার প্রাপ্য। ডিক বলল, না, সে আগে দেখেছে। কাজেই নোটের দাবিদার সে-ই। ঝগড়ায় ক্লান্ত হয়ে অবশেষে তারা দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিল, তারা মিথ্যা কথা বলার প্রতিযোগিতা করবে। মিথ্যা কথা বলে যে জয়ী হবে, টাকাটা সে পাবে। ওই রাস্তা দিয়ে তখন যাচ্ছিলেন চার্চের এক যাজক। দুই বন্ধুকে অনর্গল মিথ্যা বলতে শুনে তিনি ছুটে এলেন। বললেন, জানো তোমরা, এ অনর্গল মিথ্যা বলার জন্য তোমাদের নরকে যেতে হবে। টম ও ডিক জানতে চাইল, ছোটখাটো মিথ্যা বলার জন্যও কি নরকে যেতে হবে? এ রকম ছোটখাটো মিথ্যা তো আমরা সব সময়ই বলে থাকি। কেন, আপনি বলেন না? যাজক দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, না। জীবনে একটি মিথ্যা কথাও বলিনি আমি। এটা শোনার পর টম ও ডিক তাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে একশ ডলারের নোটটা তার পায়ের কাছে রেখে বলল, ফাদার, এতক্ষণ ধরে আমরা যা বলতে পারিনি, আপনি তাই বলেছেন। সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথাটা বলার জন্য এ নোটটি আপনার-ই প্রাপ্য ফাদার। তো আমাদের অতিমাত্রায় পলিটিক্যাল বুদ্ধিজীবী এবং কিছু মিডিয়া হল চার্চের ওই ফাদার।
বেশির ভাগ ভোটারের পছন্দের তালিকায় এখন সরকারপক্ষ যেমন নেই, বিরোধীপক্ষও নেই। মুশকিল হল আস্থা রাখা যায় এমন তৃতীয় পক্ষও নেই। যে কারণে অসহায়ের মতো তারা একবার এ দলের দিকে ঝোঁকেন, আরেকবার ঝোঁকেন ওই দলের দিকে। ক্ষমতাসীনদের কাছে মানুষের দাবি বেশি থাকায় ক্ষোভটা তাদের দিকে গিয়েই পড়ে বেশি। তিক্ত অভিজ্ঞতা চাপা পড়ে যায় বর্তমানের তীব্র ক্ষোভের মধ্যে। গত শতকের নব্বইয়ের পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে জনগণের এ ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। দুই দলের মধ্যে আদর্শিক দূরত্ব একটুখানি থাকলেও তাদের ক্ষমতাচারের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই। ক্ষমতাসীন হয়ে দুই দলই প্রায় একই আচরণ করে জনগণের সঙ্গে। অদ্ভুত কাণ্ড, ক্ষমতার বাইরে গেলেও তাদের ক্ষমতাচারণের প্যাটার্নও একইরকম। দলীয় মুখপত্র ধরনের মিডিয়ার অভিযোগ, কেন দুই দলকে সমান পাল্লায় মাপা হচ্ছে? এখন দল দুটি যদি তাদের আচরণ, তৎপরতা ইত্যাদি দিয়ে টুইন হয়ে যায় তো আমাদের কী করার আছে। তাদের আচরণের সাদৃশ্যের কারণে পাঁচ বছর অন্তর ভোটেরও ট্রান্সফর্মেশন হয়। নেতিবাচক ভোটের মাধ্যমে দুই দলেরই দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা। ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়ার দাবির ব্যাপারে কিছু বলার নেই। যেখানে খুব বেশি কথা বলার আছে, সেখানে না বলাটাই প্রতিবাদ। মুশকিল হল, এখন যারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিশ্বাসী এবং পুনরুদ্ধারের বিরোধী, ক্ষমতার পালাবদলে এ পরিস্থিতি কি আলাদা হয়ে যাবে? রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন হবে কি? জানি এ প্রশ্ন অন্তত লাখবার তোলা হয়েছে। প্রশ্ন হিসেবে এটি খুবই মনোটোনাস। কিন্তু আমাদের বুকের মধ্যে যে অপমানের চিতা জ্বলছে, তাও তো নেভানো দরকার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যালাইড ফোর্স জার্মান নারীদের ধর্ষণ করতে পারে, এ আশংকায় এক যাজক পরামর্শ দিয়েছিলেন- তুমি যদি ধর্ষণ এড়াতে না পারো, তাহলে এটা উপভোগ করো। ভারতের বিদগ্ধজন খুশবন্ত সিং এ কথার পুনরাবৃত্তি করে ব্যাপক তোপের মুখে পড়েছিলেন। এ উপমহাদেশের সংবেদনশীল সামাজিক কনটেক্সটে খুশবন্ত সিংয়ের এ বক্তব্য বিশাল তোলপাড় তৈরি করবে এবং তিনি ধর্ষণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এমন অভিযোগই করা হবে, এ হয়তো নিয়ম। কিন্তু প্রতীকী অর্থে আমরা কিন্তু প্রায় সব ধরনের ধর্ষণই এক রকম অনিবার্য বলে উপভোগই করি। অযোগ্য ব্যক্তির অধীনে থেকে বিবিধ কায়দায় তেল দিয়ে সুবিধা আদায় করে নিই। নিজের দুর্নীতিকে জায়েজ করার জন্য সব রকম দুর্নীতির পক্ষে গলা ফুলিয়ে সমর্থন জানাই। টেলিফোনে আড়িপাতা হচ্ছে, অনলাইন-অফলাইনে ঈগলের মতো নজরদারি (যেন মুনকার-নাকির চব্বিশ ঘণ্টা ঘাড়ের ওপর বসে নিজের অজান্তে লিখে যাচ্ছে আমলনামা)। নিরাপত্তার নামে স্বাধীনতাকে বিক্রি করা- তাও মেনে নিয়েছি। বিভিন্ন বাহিনীর গ্রেফতার বাণিজ্যকে মেনে নিয়েছি তাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস হিসেবে (সরকারি ডাক্তাররা ২ ঘণ্টা হাসপাতালে রোগী দেখবেন, বাকি সময়টা নিজের চেম্বারে)। প্রায় সব বাহিনীকে সানন্দে আমরা এ প্রাইভেট প্র্যাকটিসের স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছি। মন্দের ভালো এবং মন্দের মন্দ এ দ্বিদলীয় চক্রের খপ্পরে পড়ে আমরা ভুলতেও বসেছি সত্যিকারের ভালো কী। পারফেক্ট ভালো বলে যে কিছু হতে পারে তা কল্পনা করতেও অক্ষম এখন আমরা। দলের অভ্যন্তরে তৃণমূল থেকে শীর্ষবিন্দু পর্যন্ত সব পর্যায়ে নেতৃত্ব বাছাইয়ে গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে হয়তো এ মন্দের ভালো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হতো। কিন্তু সে কথাও তো বলা হয়েছে ঢের। কেউ কি তা শুনল? দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার অভাবে জনবিচ্ছিন্নতা আর তারপরই নিয়মমাফিক চলে আসে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন- এ একঘেয়ে চক্রের মধ্যেই আছি আর কী! গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবর্তে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় মনে মনে সবাই খুশবন্ত সিংয়ের কথাই মেনে নিচ্ছি, শুধু মুখে স্বীকার করছি না। এই যা তফাৎ।

No comments

Powered by Blogger.