এক কৃতিমান মানুষকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল
ইসলামের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের
৩০ বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষে ২৭ অক্টোবর ২০১৪ সোমবার আরসি মজুমদার
আর্টস মিলনায়তনে কেন্দ্রের প্রাক্তন সভাপতি ও পরিচালকদের সম্মাননা প্রদান
করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। ছবিতে এমিরিটাস অধ্যাপক
আনিসুজ্জামানকে সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে।
আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। তার ছাত্র না হয়েও আমি তাকে শিক্ষক হিসেবে মান্য করি। তিনি সার্বিক অর্থেই একজন শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। তিনি জ্ঞান সাধনা করেছেন সারা জীবন। প্রজ্ঞার সঙ্গে নীতি-নিষ্ঠার একটি সংযোগ ঘটিয়েছেন। তিনি সজ্জন ও রুচিশীল মানুষ, স্নিগ্ধ তার ব্যক্তিত্ব। তিনি বন্ধু ও ছাত্রবৎসল এবং তার আছে রসবোধ। পরিবারের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ এবং দেশের প্রতিও।
আমাদের দীর্ঘদিনের জাতিগত সংগ্রাম ও রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে ড. আনিসুজ্জামান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে শুরু হয়, তাতে তিনি ছিলেন সম্মুখসারিতে। তার কণ্ঠে জাতির বিবেকের কণ্ঠই শুনতে পাই। শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে তার যে ব্যাপক পরিচিতি দেশে ও বিদেশে- তার মূলে আছে তার নিষ্ঠা ও নিরন্তর চর্চা। তার লেখালেখিকে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি- গবেষণা ও সৃজনশীলধর্মী। গবেষণা কাজে তার বিষয়বস্তু ভাষার ইতিহাস ছাড়িয়ে সংস্কৃতি-পঠন পর্যন্ত বিস্তৃত।
মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন ও বই লিখেছেন। পুরনো বাংলা গদ্য নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ আছে, সে রকম আরেক গ্রন্থ আছে সাহিত্য ও সমাজে বাঙালি নারীর অবস্থান নিয়ে। ২০১২ সালে প্রকাশিত তার ‘ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য’ নামের গ্রন্থটি আমার বিবেচনায় তার একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা। ইংরেজিতেও তিনি লিখেছেন এবং বই সম্পাদনা করেছেন। সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ নিয়ে তার যে গ্রন্থটি ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়, তা তাকে আমাদের দেশে সংস্কৃতি-পঠনের ক্ষেত্রে একজন পথিকৃতের মর্যাদা দিয়েছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থ, প্রবন্ধ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি বিদ্বৎসভায় বক্তৃতা দিয়েছেন, সভা-সেমিনারে আলোচনা করেছেন, যার বিষয়বস্তু সাহিত্য থেকে সংস্কৃতি ও ইতিহাস পর্যন্ত বিস্তৃত। এসবের অনেকই লিপিবদ্ধ হয়নি, যদি হতো তাহলে জাতি এসব বিষয়ে আরও প্রজ্ঞাবান পর্যবেক্ষণের উদাহরণ পেত।
তার সৃজনশীল লেখালেখির মধ্যে প্রধান হচ্ছে তার আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘কাল নিরবধি’ ও ‘বিপুলা পৃথিবী’। তার স্মৃতিশক্তি এতটাই প্রখর যে, দিনপঞ্জি না লিখেও দীর্ঘদিন আগে ঘটা কোনো ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ অথবা কোনো ব্যক্তিগত আলাপচারিতার নিখুঁত বর্ণনা তিনি উল্লিখিত দুই লেখায় দিয়েছেন, যাতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের এবং তার পরের বাংলাদেশের সমাজ চিত্রের একটা বিশ্বস্ত প্রতিফলন আমরা পাই।
ড. আনিসুজ্জামান তার সব লেখায় বিষয়বস্তুর প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে পারদর্শিতার সঙ্গে ভাষার কুশলী প্রকাশের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। ফলে তার লেখা একদিকে যেমন পাণ্ডিত্যপূর্ণ, অন্যদিকে তেমনি মনোগ্রাহী। তার পর্যবেক্ষণের দৃষ্টি প্রখর, ইতিহাস ও জীবনের সত্যের প্রতি তার নিষ্ঠা অবিচল।
তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন, কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন। সর্বশেষ ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেছে। এর মাধ্যমে তার প্রতি যেমন সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে, তেমনি সম্মান জানানো হয়েছে আমাদের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যকে। আজ তার ৭৮তম জন্মবার্ষিকী। আমরা প্রার্থনা করি তিনি সুস্থ থাকবেন এবং দীর্ঘজীবী হবেন। যাতে তিনি জাতির পদপ্রদর্শকের ভূমিকায় দীর্ঘদিন থাকতে পারেন।
ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : লেখক; অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.