রাজস্বে কৃচ্ছ্রসাধন বনাম ইউরোপীয় সমাজ by কামাল দারভিস

গত পাঁচ বছরে ইউরোজোন কোনো প্রকাশ্য জনমত ছাড়াই রাজস্ব খাতে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি খুব কঠোরভাবে বজায় রেখে চলেছে। কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এর সামাজিক প্রভাব মারাত্মক হওয়া সত্ত্বেও তারা এটা চালিয়ে গেছে। না, সেটা শুধু ভূমধ্যসাগরের প্রান্তিক অঞ্চলেই নয়, ইউরোপের মূল ভূখণ্ড ফ্রান্সেও তার প্রভাব দেখা গেছে। ইউরোজোনের নেতারা তাঁদের নীতি নিয়ে পুনরায় চিন্তা না করলে গ্রিসের বিপ্লবী সিরিজা পার্টির সাফল্য ইউরোপের অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক ভাঙনের পথে আরও এক পদেক্ষপ হিসেবে প্রতীয়মান হতে পারে। অথবা তা ইউরোপের অর্থনৈতিক কৌশলের বাস্তবানুগ ও মঙ্গলকর দিক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।
অবশ্যই, বিপর্যয়কর ঋণ পুনঃ অর্থায়ন ঠেকানো এবং বিনিয়োগকারী ও ভোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে রাজস্ব খাতের ভারসহতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সরকারি সেবার ওপর নির্ভর না করার মতো সম্পদশালী হলে সে রাষ্ট্র রাজস্ব খাতে এমন কৃচ্ছ্রসাধন করতে পারে। অথবা সে দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্বের পঙ্কে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে (ধনীদের হাতে আছে সংবাদমাধ্যম। জনমত নির্ধারণ ও আন্তদেশীয় পুঁজি সঞ্চালনের ক্ষমতাও তাদের হাতে)।
লাখো শ্রমিকের চাকরির সম্ভাবনা নেই, বিশেষ করে তরুণদের, ফলে রাজস্ব খাতের ভারসহতা তাঁদের একমাত্র অগ্রাধিকার হতে পারে না। বেকার ভাতা কমানো হলে তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি ভুগতে হবে। আর শিক্ষা খাতে বাজেট হ্রাস করা হলে তাঁদের সন্তানেরা এর ভুক্তভোগী হবে। তারা ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে কমজোর হয়ে পড়ে।
গ্রিসকে কৃচ্ছ্রসাধনের কারণে চূড়ান্তভাবে ভুগতে হয়েছে। পেনশন ব্যাপক হারে কমানোর কারণে বয়স্ক মানুষ শেষ জীবনটা মর্যাদার সঙ্গে কাটাতে পারছেন না। যাঁরা কর দেন, তাঁদের ওপর বিশাল বোঝা চাপানো হয়েছে। আর যে ধনীরা বহু আগে বিদেশে টাকা গচ্ছিত রেখেছেন, তাঁরা তাঁদের দায় এড়িয়েই চলছেন। স্বাস্থ্যসেবায় ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। অনেক ক্যানসার রোগীই জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে।
তার পরও গ্রিসের ঋণদাতারা এসব উপেক্ষা করে চলছে। এটা পরিষ্কারভাবেই টেকসই নয়। আইএমএফের ইউরোপ বিভাগের সাবেক পরিচালক রেজা মোঘাদাম এ বিষয়টি চিহ্নিত করে গ্রিসের ঋণ মওকুফের আহ্বান জানান। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্যে বিশ্বাসযোগ্য কাঠামোগত সংস্কারের ঐকমত্যে পৌঁছানো সাপেক্ষে তিনি এ আহ্বান জানিয়েছিলেন।
দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সমাজের টেকসই হওয়া জরুরি। ডিজিটাল অর্থনীতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো করে শিশুদের গড়ে তোলার উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা না থাকলে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না। একইভাবে, অসমতা, দারিদ্র্য ও সামাজিক হতাশার কারণে সমাজে চরমপন্থী রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটলে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যায় না। যেমন, গ্রিসের ফ্যাসিস্ট গোল্ডেন ডন পার্টি বা ফ্রান্সের অতি দক্ষিণপন্থী ইউরোপবিরোধী জাতীয় ফ্রন্ট, তাদের নাকি ২৫ শতাংশ ভোটারের সমর্থন আছে, এ নিয়ে তারা আবার গর্বও করে।
সাধারণত প্রতিকূল সময়ের সহজ শিকারে পরিণত হয় সংখ্যালঘু ও অভিবাসীরা। জোসেফ স্টিগলিৎজ সম্প্রতি বলেছেন, জার্মানিতে সে সময় বেকারত্বের হার ৩০ শতাংশ না হলে হিটলার ক্ষমতায় আসতে পারত না। যখন বড় বড় শহর দ্বারা ঘেরাও ঘেটোগুলোতে থাকা মানুষ চরমপন্থার শিকার হয় বা সহিংসতার প্রতি প্রলুব্ধ হয়, তখন এই আর্থসামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই যায়।
করপোরেটরা যতই লাভ করুক না কেন, এসব মৌলিক সামাজিক বিষয়াদি আমলে নেওয়া না হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে। রাজস্ব খাতে কিছুটা সতর্ক হতেই হবে। সরকারি বা বেসরকারি খাত যদি ঋণের টাকা ও নতুন ছাপানো টাকা মুক্তভাবে ব্যবহার করতে চায়, তাহলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। গরিবেরা আরও আঘাত পাবে। কিন্তু সামাজিক ভারসহতা একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মসূচির অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া উচিত, অনুচিন্তা নয়।
ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ হচ্ছে, সামাজিক ভারসহতা নিয়ে শুধু কথার তুবড়ি ছোটানো ও চরম কৃচ্ছ্রসাধনের অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন। টিকে থাকতে সক্ষম এমন একটি সামষ্টিক অর্থনীতির কাঠামো নির্মাণ করা যেমন জরুরি, তেমনি এর মধ্যে ‘মিতব্যয়িতার স্ববিরোধ’ (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে খাটো করে মন্দার সময় বেশি বেশি সঞ্চয়ের প্রবণতা) হ্রাসে অপরিবর্তনীয় নীতি সংযোজন করাও দরকার। যখন সমন্বিত চাহিদা সমন্বিত সরবরাহের চেয়ে কম হয়, তখন সরকারি ব্যয় বাড়াতে হয়।
সরকার এখন ব্যাষ্টিক অর্থনীতিতে মনোনিবেশ করেছে, এই দৃষ্টিভঙ্গি খুব সংকীর্ণ। তার উচিত, একই গুরুত্ব দিয়ে সমাজের সবচেয়ে কমজোর অংশের জীবিকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও গৃহায়ণ নিশ্চিত করে এমন সামাজিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। আর নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সামাজিক কর্মসূচির সক্ষমতা বাড়ানো উচিত। উদ্বিগ্ন নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা দরকার।
ইউরোপীয় কমিশন ও আইএমএফ তাদের ভুল স্বীকার করেছে। শুধু গ্রিসবিষয়ক সামষ্টিক অর্থনীতির পূর্বাভাসের অপর্যাপ্ততাই নয়, সামাজিক ভারসহতা আমলে না নেওয়াসহ এ কর্মসূচি যে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দেয়নি, এসবই তারা স্বীকার করে নিয়েছে। তার পরও কিছু কারণে গ্রিসের ঋণদাতারা নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করে ঋণছাড়, নিম্ন রাজস্ব উদ্বৃত্ত, কাঠামোগত সংস্কার প্রভৃতি আমলে নেওয়ার মতো কর্মসূচি প্রণয়নে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যে কর্মসূচি প্রবৃদ্ধি বাড়াবে ও সামাজিক অখণ্ডতা বজায় রাখবে। এটা চলতে পারে না।
গত পাঁচ বছর আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনের বিষয়টিতে প্রাধান্যে চলে এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা আরও দূর অস্ত বলে মনে হচ্ছে। ব্যাসেল ২ আর্থিক সংস্কার বাস্তবায়নে নীতিপ্রণেতারা যে পরিমাণ শ্রম ও সম্পদ বিনিয়োগ করেন, সামাজিক ভারসহতা অর্জনেও একই পরিমাণে তা বিনিয়োগ করা উচিত। ইউরোপের ভবিষ্যৎ ও তার বৈশ্বিক ভূমিকা এর ওপরই নির্ভর করছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
কামাল দারভিস: তুরস্কের সাবেক অর্থমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.