হরতাল-অবরোধে বিপর্যস্ত পণ্য পরিবহন, কূটনীতিকদের জানালেন ব্যবসায়ীরা

বিরোধী জোটের টানা হরতাল-অবরোধে দেশের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ক্রসরোডে রয়েছে। গত ৫ই জানুয়ারি থেকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় শিশুসহ ৮৮ জন সাধারণ মানুষ মারা গেছে। ২০০ মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। ৫ হাজার যানবাহনে আগুন দেয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতির কারণে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। সব মিলিয়ে গত ৪৪ দিনে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
গতকাল দেশের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) ঢাকায় নিযুক্ত ২৮ দেশের কূটনীতিকদের নিয়ে এ বৈঠক করেন। বৈঠকে এসব তথ্য জানান সংগঠনটির সভপাতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ। এতে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভারত, কানাডা, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, আফগানিস্তান, ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, মরক্কো, নেদারল্যান্ডস, ফিলিপাইন, ইরান, ফিলিস্তিন, ভ্যাটিকান, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতসহ অর্ধশত কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধি ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা। বৈঠকে কূটনৈতিক ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে চলমান সঙ্কট ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।
বৈঠকে এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরামউদ্দিন আহমেদ চলমান হরতাল-অবরোধ ও সহিংস কর্মসূচিতে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এক দশক ধরে আমরা ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি। মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি যখন নিম্নমুখী ছিল, একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল। এ সময় আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন, স্থিতিশীল এক্সচেঞ্জ রেট, নিম্নমুখী মূল্যস্ফীতি, অভ্যন্তরীণ চাহিদা ভাল ছিল। তিনি বলেন, দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সহিংস কর্মসূচির কারণে সেই অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশে দৈনিক ২৭০০ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। পাশাপাশি এ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে বলে কূটনৈতিকদের আশ্বাস দেন তিনি।
কিন্তু এতে আশস্ত হতে পারেননি কূটনীতিকরা। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে সাফ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বিভাজিত রাজনীতি বিরাজ করেছে। যদিও এটা কারও কাম্য নয়। এ অবস্থায় এ দেশে বিনিয়োগ করা নিয়ে শঙ্কাবোধ করছেন তারা। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে হলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বৈঠকে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টফিন্সে ব্লুম বার্নিকাট চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রাস্তায় যে সন্ত্রাস চলছে এটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। শান্তিপূর্ণ রাজনীতির চর্চা হওয়া দরকার। সব পক্ষকে এখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই চলমান সঙ্কটের সমাধান করতে পারবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমরা পুরোপুরি আশাবাদী যে বাংলাদেশ এবং এর প্রাজ্ঞ নাগরিকরা এ সঙ্কটের সমাধান করতে পাররেন। বাংলাদেশে অত্যন্ত সক্রিয় এবং চিন্তাশীল নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ রয়েছেন। তারা সবাই মিলে এ সঙ্কটের উত্তোরণ ঘটাতে পারবেন। নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, সব মার্কিন কূটনীতিকের দায়িত্ব হলো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে কাজ করা। আমরা বাংলাদেশে সেটা করছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হওয়ায় মার্কিনিরা গর্বিত বলে তিনি উল্লেখ করেন।
রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজেন্ডার এ. নিকোলেভ বলেন, বাংলাদেশে যে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এর দায়-দায়িত্ব কে নেবে এটি বলা যাবে না। তবে সরকারকে দেশের জনগণ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জানমালের নিরাপত্তা দিতে হবে। তিনি চলমান সহিংসতা ও সন্ত্রাসের দ্রুত অবসান হওয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। আমরা সেজন্য কাজও করছি। তবে এ দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে হলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ঢাকায় নবনিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার বেনায়ু পিয়ের ল্যারামি বলেন, রাজনৈতিক সংঘাত সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত। এ পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশব্যাপী চলমান এ সহিসংতার শেষ হওয়া প্রয়োজন। কারণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি হয় গণতন্ত্র, শান্তি ও সুশাসনের ওপর ভিত্তি করে।
বৈঠকে জাপানের রাষ্ট্রদূত শিরো সাদোশিমা এবং ঢাকায় নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি ইয়ান-ইউং উভয়ই বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, বাংলাদেশকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.