রানা প্লাজা দুর্গতদের ক্ষতিপূরণ দিতে ১০ লাখ মানবাধিকারকর্মীর পিটিশন

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দু’বছর হতে চললো। এখনও ওই ভবনে কাজ করানো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের অনেকে দুর্ঘটনার শিকার পরিবারগুলোকে কোন ক্ষতিপূরণ দেয়নি। স্মরণকালের ভয়াবহতম ওই শিল্প দুর্ঘটনায় ১১৩৪ জন শ্রমিকের প্রাণহানি হয়েছিল। এছাড়া আহত হন শ’ শ’ কর্মী। এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকৃতি জানানো একমাত্র বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হলো ইতালির বেনেটন। প্রতিষ্ঠানটিকে ক্ষতিপূরণ দিতে অনুরোধ জানাতে মানবাধিকতার কর্মীরা একটি অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন। অনলাইন আওয়াজ (আধু) পিটিশন নামের ওই আবেদনে ইতিমধ্যে প্রায় ১০ লাখ মানবাধিকার কর্মী সই করেছেন। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। ২১ শতকের ভয়াবহতম ওই দুর্ঘটনার পর ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে রানা প্লাজা কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি দুর্ঘটনার শিকারদের জন্য ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনে রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড গড়ে তোলে। এ তহবিলের পেছনে সমর্থন রয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম অর্গানাইজেশনের (আইএলও)। দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে টার্গেট অর্থ ৩ কোটি ডলার সঠিকভাবে বণ্টনের লক্ষ্যে স্কিমটি ‘রানা প্লাজা অ্যারেঞ্জমেন্ট’ নামের একটি প্রক্রিয়া গড়ে তোলে। এর লক্ষ্য, দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি, পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দাবি, তা প্রদানের মাত্রা এবং চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে সহায়তা করা। ১৬ই ডিসেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত ওই তহবিলে ২ কোটি ১০ লাখ সংগ্রহ হয়েছে। এখনও টার্গেট অর্থ পূরণে বাকি রয়েছে ৯০ লাখ ডলার। মানবাধিকার কর্মীরা অনুরোধ জানাচ্ছেন ওই অর্থের অন্তত কিছু অংশ বেনেটন প্রদান করুক। লেবার বিহাইন্ড দ্য লেবেল (এলবিএল) নামক এনজিও’র প্রচারণা পরিকালক আইলোনা কেলি বলেন, ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট’ গঠনের পর থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ড, সরকার ও জনগণ প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন রানা প্লাজা ধসের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত। শুধুমাত্র যা প্রয়োজন তা হলো ব্র্যান্ডগুলোর তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসা। তিনি আরও জানান, ক্ষতিপূরণ না দেয়ার দলে অপেক্ষাকৃত ছোট অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। যেমন জেসি পেনি। তিনি সংশ্লিষ্ট সকল ব্র্যান্ডকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে যারা ইতিমধ্যে অর্থ অনুদান দিয়েছেন তাদেরকেও আরও বেশি সহায়তার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ওয়ালমার্ট যেমন ১০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এটা শুনতে অনেক বেশি মনে হয় কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির বাৎসরিক শত কোটি ডলার মুনাফা বিবেচনায় এটা ততটা বেশি নয়। কেলি আরও বলেন, এ তহবিলটা ঠিক দান করা নয়। এটা হলো আয়ের ক্ষতি এবং চিকিৎসা ব্যয়ের ক্ষতিপূরণ দেয়া। ক্ষতিপূরণতো তাদের প্রাপ্য। আর এটা লজ্জাজনক যে, ওই ট্র্যাজেডির দুই বছর পূর্তি হতে ১০ সপ্তাহ বাকি আছে কিন্তু ক্ষতির শিকারদের তাদের প্রাপ্যের জন্য বলতে গেলে ভিক্ষা করতে হচ্ছে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বিশ্বের একাধিক ব্র্যান্ড, খুচরা ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ট্রেড ইউনিয়ন ‘বাংলাদেশ অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি’ নামক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির অধীনে ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে পাঁচ বছরের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বেনেটন ‘অ্যাকর্ড’-এ স্বাক্ষরকারী একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের দাবি এ ইস্যু তাদের প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট বাস্তব তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আইবিটি ইউকে’র সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রতিষ্ঠানের এক মুখপাত্র বলেন, অ্যাকর্ডের অংশ হিসেবে আমরা দীর্ঘমেয়াদে অবদান রাখতে পারবো এবং বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পে কর্মীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশের স্থায়ী উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। তিনি বলেন, আমাদের মতো স্বাক্ষরকারী প্রতিষ্ঠানের সুদৃঢ় ভূমিকার বদৌলতে এখন পর্যন্ত ১১০০ কারাখানা পর্যবেক্ষণ করেছে অ্যাকর্ড এবং আরও অনেক কারখানায় তা করা হবে। এছাড়া আমরা বাংলাদেশ ভিত্তিক এনজিও ব্র্যাক-এর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দুর্ঘটনার শিকার ২৮০ ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের সহায়তা দিয়েছি। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবাসহ স্থিতিশীল একটি ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনে দরকারী সবকিছু নিশ্চিত করা হয়েছে। সহায়তার মধ্যে অঙ্গ প্রতিস্থাপনও করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ব্রাকের সঙ্গে অংশীদারিত্বে ক্ষতির শিকার ব্যক্তিরা কোন আর্থিক অনুদান না পেলেও বেনেটনের ব্যাখ্যা হলো, ওই কার্যক্রমে মাঠপর্যায়ে কাজ হচ্ছে। বেনেটন বলছে, রোজিনা বেগম নামক দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া এক কর্মী ওই কার্যক্রমে উপকৃত হয়েছে। প্রোস্থেটিক বাহু দিয়ে তার হাত প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সে চলমান সাইকো-সোশ্যাল এবং চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি আরও বলেছে, এছাড়াও নিজের ছোট্ট একটি ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য তাকে আর্থিক অনুদান দেয়া হয়েছে এবং ফিক্সট ডিপোজিট স্কিম থেকে প্রতিমাসে কিছু অর্থ সে পায় যা দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহে তাকে সাহায্য করে। এদিকে এলবিএল এবং আওয়াজ পিটিশনে স্বাক্ষরকারী প্রায় ১০ লাখ মানবাধিকার কর্মী বিশ্বাস করেন, বেনেটন দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া কয়েকজনকে কিছু সহায়তা দিলেও তা ক্ষতিপূরণের বরাবর হতে পারে না। এলবিএল এর ইন্টারন্যাশনাল সলিডারিটি অ্যান্ড পলিসি কো-অর্ডিনেটর সামান্থা মাহের বলেন, বেনেটন যেটার বর্ণনা দিয়েছে সেটা একটা এনজিও স্কিম যা প্রশিক্ষণ এবং উপার্জনক্ষম কর্মকাণ্ড দিয়ে থাকে। ক্ষতিপূরণ আর এটা এক বিষয় নয়। রোজিনার বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, আমি রোজিনার সঙ্গে দেখা করিনি, কাজেই তার বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না, কিন্তু একটি প্রোস্থেটিক অঙ্গ ক্ষতিপূরণের সমান হতে পারে না। একইভাবে সমান হতে পারে না সাইকোলোজিক্যাল কাউন্সিলিং। এটা হলো চিকিৎসা সেবা। এমনটি ব্যবসা সংক্রান্ত ঋণও একই বিষয় নয়। এ কারণেই আমরা যুক্তি তুলে ধরছি যে, এমন স্কিম ক্ষতিপূরণ অনুদানের সমকক্ষ হতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.