ধরুন পিকে, অন্য দিকে by শাহনওয়াজ আলি রায়হান

এমনিতেই বেশ কিছু দিন ধরে একটা মেরুকরণ চোখে পড়ছিল৷ বিশেষ করে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার বেশ কিছু মাস পূর্ব হতেই সোসাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে হিন্দুত্ববাদী ও তাদের বিরোধীদের দড়ি টানাটানি যেন দেশটাকে ভার্চুয়ালি ভাগ করে রেখেছে৷ সেই একই রকম পার্টিশন কিছুটা হলেও খাগড়াগড় পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে৷ কে সন্ত্রাসী আর কে সাম্প্রদায়িক- এই নিয়ে চলছে বিতর্ক৷ হিন্দুত্ববাদীদের সংখ্যালঘু বিদ্বেষের প্রতিক্রিয়ায় ইদানীং ফেসবুকে একটা মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার উত্থানও চোখে পড়ছে৷ প্রথমটি যতটা উস্কানিমূলক, দ্বিতীয়টি ততটাই প্রতিক্রিয়াশীল৷ এরই মধ্যে ভিনগ্রহ থেকে পিকে'র আগমন৷ ইতিমধ্যেই সে চোখে আঙুল দিয়ে আসমুদ্রহিমাচল প্রসারিত ধর্মের নামে অধর্মের জালটি (নাকি জালি? নেটওয়ার্কও বলা চলে!) দেখিয়ে নিজ গ্রহে পাড়ি দিয়েছে৷ আর আমরা? যারা এই বিশাল সৃষ্টিজগতের ছোট্টো একটি গ্রহের এক কোণে মন্দির-মসজিদ ভেঙে, গির্জা পুড়িয়ে বসবাস করি? অনেক ভারতবাসীই পিকে-তে যে ভাবে এই মুহূর্তে দেশের ধর্মীয় মানচিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাতে নারাজ৷ এদের বেশির ভাগই যে হিন্দু তা নয়৷ বরং হিন্দুত্ববাদী৷ তবে এরই মাঝে মুচকি হাসি কিছু মুসলিমের ঠোঁটের কোণেও দেখতে পাচ্ছি৷ প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন পিকে-কে৷ ভাবখানা এমন 'মুশরিকদের (পৌত্তলিক) বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে আমির৷ খাসা ফিলিম৷' এ কথা ঠিকই যে ১৫৩ মিনিটের এই ছবিটির অধিকাংশটাই হিন্দু সম্প্রদায় ধর্মের নামে যে বাড়াবাড়িগুলো করেন তা নিয়ে৷ বাকি সম্প্রদায়েরগুলো ছুঁয়েই বেরিয়ে গিয়েছেন নির্দেশক৷ এতে গবাক্ষ দিয়ে দেশের যে মেঘলা ধর্মীয় আকাশ হিরানি দেখিয়েছেন, তাতে অনেক কিছুই ধরা পড়েনি৷ পড়লে কোনো মুসলিমেরই মুচকি হাসি বা আত্মতৃপ্তির আকাশ থাকত না৷ বরং আত্মসমীক্ষা করত৷ নাহ্, কোনো রাষ্ট্র বা গণমাধ্যমের সুরে সুর মিলিয়ে সন্ত্রাস বা মৌলবাদের কথা বলছি না৷ সেটা যতটা না অভ্যন্তরীণ তার চেয়ে বেশি বাহ্যিক- ভূ-রাজনীতির সঙ্গেই সেটির যোগাযোগ বেশি৷ ছোটোবেলায় এই মুসলিম সমাজের ভেতর চোখ খুলে থেকে বড়ো হওয়া পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতাগুলির সম্মুখীন আমাদের হতে হয়- তার কথা বলছি৷ পশ্চিমবঙ্গে কোনো গ্রামে একটা মুসলিম পরিবারের শিশু যখন বড়ো হয়, তখন সে দেখে প্রতি রমজান মাসে মা-খালারা কোরান খতম দিচ্ছেন, আব্বা-চাচা তারাবি পড়তে যাচ্ছেন৷ সেই নামাজে পুরো রমজান মাসে সম্পূর্ণ ত্রিশ পারা কোরান পড়া হয়৷ দাদা-দাদি বা অন্য কেউ মারা গেলে সে দেখে চল্লিশ দিনের মাথায় কিছু মাদ্রাসার লোকজনকে ডেকে এনে টাকা পয়সা দিয়ে কোরান পড়ানো হচ্ছে৷ কাউকে জিনে ধরেছে? পাড়ার মৌলানা কোরানের আয়াত লিখে যে তাবিজ বিক্রি করেন, সেটা কিনে শরীরে বাঁধলেই নাকি সব ছু-মন্তর৷ রাত-বিরেতে বাঁশবাগানের দিকে প্রকৃতির ডাকে গেলেও তখন আর কেউ ধরবে না৷ বেচারা শিশুটির মাথায় ঢোকে না যে, পৃথিবীতে সব বই-ই তো মানুষ বুঝে পড়ছে, অথচ এই কোরানটি কেন না বুঝেই সবাই কত তাড়াতাড়ি আদ্যোপান্ত রিডিং দিয়ে শেষ করা যায়- সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত? আজকাল তো আবার পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো মসজিদে রমজানের তিন তারাবি-তেই কোরান পড়া শেষ৷ মসজিদ কমিটিগুলোর মধ্যে কম্পিটিশন কে কত টাকা দিয়ে মাওলানা-ক্বারী এনে তাড়াতাড়ি তারাবিহ-তে কোরান পড়ে শেষ করতে পারে? এদের পেছনে নামাজ পড়লে কোন ভাষায় কী পড়া হচ্ছে কিচ্ছু বোঝা যায় না৷ অর্থ অনুধাবন দূরস্থান! তবু মসজিদ কমিটির সিদ্ধান্ত৷ কোনো প্রশ্ন নয়! মালদহের মতো বাঙালি মুসলিম অধ্যুষিত এক জেলায় এক বার জুম্মার নামাজের শেষে মসজিদটির ইমাম সাহেবকে প্রশ্ন করলাম, 'আচ্ছা মাওলানা সাহেব, এই মসজিদে যারা নামাজ পড়েন তাদের অধিকাংশই তো বাঙালি৷ তা আপনি জুম্মার খুত্বা (বক্তব্য) উর্দুতে না দিয়ে বাংলাতে দিলেই তো পারেন, আমাদের বুঝতে সুবিধা হয়৷' আমি কী প্রশ্ন করেছি সেটা বড়ো নয়৷ কেন ইমাম সাহেবকে প্রশ্ন করার আস্পর্ধা দেখিয়েছি সেটাই তখন মুখ্য! বকা খেয়ে চুপ করে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলাম৷ কে বোঝাবে ওনাকে যে, ইসলামে কোনো যাজকতন্ত্র নেই৷ বা উর্দু উত্তর ভারত ও পাকিস্তানের মুসলিমদের ভাষা, ইসলামের নয়৷ এই ইমাম বা মসজিদ কমিটিগুলিকে কিছুতেই বোঝানো যায় না যে, মসজিদে নারীদের প্রবেশে কোনো অসুবিধা নেই৷ বরং হজরত মুহম্মদের (সা.) জমানায় নারী-পুরুষ উভয়ে মসজিদে নামাজ পড়তেন৷ আজও একত্রে হজের সময় কাবা প্রদিক্ষণ করেন, নামাজ পড়েন৷ পিকে যদি জুম্মার দিন এই মসজিদগুলোতে নামাজ পড়তে যেত তবে মওলানা সাহেবদের মুখে বিভিন্ন পির-আওলিয়ার কেরামতির গালগপ্পো শুনে নির্ঘাৎ প্রশ্ন করত- এমন মায়ের পেট থেকে কোরান মুখস্ত বা মরা মানুষকে জিন্দা করা তো স্বয়ং হজরত মুহম্মদের (সা. )জীবদ্দশায় নজির নেই- আপনারা পেলেন কোথা থেকে? অথবা, যে নবি নিজেই তার কবরকে উপাসনাস্থল বানাতে অনুগামীদের নিষেধ করে গেছেন, তার অনুসারীদের মধ্যে থেকে এত ভুরি-ভুরি পীরবাবা কেন? মদিনাতে স্বয়ং হজরত মুহম্মদের (সা.)কবরে গিয়ে কোনো কিছু চাওয়া যায় না৷ কারণ ইসলাম বলে, দোয়া একমাত্র আল্লাহ-র সামনেই হতে হবে৷ কিন্ত্ত পিকে এই মাজারগুলিতে গেলে স্পষ্ট দেখতে পেত বউয়ের বাচ্চা না হওয়া থেকে এসএসসি-তে তিন বারের ব্যর্থ প্রচেষ্টা- না জানি কত শত সমস্যা নিয়ে প্রতি দিন ভারতের হাজার হাজার মাজারে (যার অধিকাংশই ভণ্ড পীরদের) লাখ লাখ লোক ভিড় জমাচ্ছে৷ যে চাদরটি দোকান থেকে কিনে এনে কবরে চাপাচ্ছে, সেটিই ক্ষণিকের মধ্যে আবার দোকানে চলে যাচ্ছে৷ এই যে মহরমের দিন নৃশংস ভাবে নিজ শরীর কেটে রাস্তায় তাজিয়া বের করা হয়, এটা জায়েজ আছে ইসলামে? কোরান অনুযায়ী শরীর তো মানুষকে আমানত হিসেবে দেওয়া হয়েছে, যার আসল মালিক আল্লাহ৷ তা মানুষ কোথায় অধিকার পেল নিজ হাতে সেই শরীরকে রক্তাক্ত করার? তাবিজ-ঝাড়-ফুঁক-মাজার-চাদর ব্যবসার মতো এই সব মহরমের আহাজারির উল্লেখ কোরান-হাদিস-নবির জীবনে কোথাও নেই৷ তবু এগুলি এমন ভাবে শেকড় গেড়ে রেখেছে মুসলিম সমাজে যে, পাঠ্যপুস্তকে মুসলমানদের একটি বড়ো ধর্মীয় উত্সব মহরম (যদিও শোকের!) বা চলচ্চিত্রের সেই বহুল পরিচিত দৃশ্য- (আদতে স্টিরিওটাইপ) ময়ূর-পেখমের পাখা নিয়ে মাজারের পাণ্ডা কবরে হাওয়া করছে আর পাশ থেকে আগরবাতির ধোঁয়া৷ বিগত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় দেখা যাচ্ছে, ইদের সময় বেশ কিছু ক্লাবের ঈমান জেগে উঠছে এবং প্রতিবেশী হিন্দু পাড়ার ক্লাবগুলির অনুকরণে তারাও শুরু করছে চাঁদার জুলুম, রাতভর মাইক, ভাড়া করে আনা নর্তকীর উদ্দাম নৃত্য৷ কিছু পয়সা বাঁচিয়ে তাতে মদ্যপান৷ প্রতিবাদ করলেই বরুণ বিশ্বাস৷ ডান-বাম কোনো সরকারই মুসলিমদের জন্য কিছু তোষণমূলক নীতিগ্রহণ ছাড়া উন্নয়নের ব্যাপারে তেমন কিছুই করেনি৷ করলে সাচার কমিটিকে কষ্ট করে এত বড়ো রিপোর্ট বানাতে হতো না৷ কিন্ত্ত মুসলমান সমাজ নিজেদের উন্নয়নের ব্যাপারে কী করেছে? ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো যাকাত৷ কোরানে যেখানেই নামাজ পড়ার কথা এসেছে, সেখানেই যাকাতেরও কথা বলা হয়েছে৷ ভারতীয় ধনাঢ্য মুসলমানরা যদি বাৎসরিক উদ্বৃত্ত সম্পদের আড়াই শতাংশ যাকাত গরিবদের প্রতি নিয়ম করে দান করত তবে মুসলিম সমাজে দারিদ্রের হার অনেকটাই কমানো যেত৷ সেটা তো হয়নিই, উপরন্ত্ত পূর্বের দানকৃত ওয়াকফ সম্পত্তি লুটেপুটে খেয়েছে৷ আর খেয়েছে হালওয়া রুটি৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার না, ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করব, সারা বছর নামাজ যাকাত কিছুই নেই- আর শবে-বরাতের রাতে হালওয়া রুটি, কবরে কবরে গিয়ে ধূপকাঠি জ্বালানো- এটা কোন ইসলাম? কোরানে বিভিন্ন নবির আন্দোলনের কথা এসেছে৷ যেমন শোয়েব নবি ক্রয়-বিক্রয়ের সময় মাপে কম দেওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন বা মুসা নবি (মোজেস) ফ্যারাওয়ের অপশাসন থেকে ইসরাইলিদের স্বাধীন করার ব্যাপারে৷ কই কাটরা মসজিদ বাবরি মসজিদ ইরাক-আফগানিস্তান-গাজা-কার্টুন সংরক্ষণ ছাড়া কোনো দিন তো জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সমগ্র রাজ্যবাসীর কোনো জ্বলন্ত সমস্যায় মাওলানা-উলেমাদের শহিদ মিনারে জমায়েত হতে দেখলাম না? হ্যাঁ, কেউ কেউ হয়তো নন্দীগ্রামের উদাহরণ তুলে ধরবেন৷ কিন্ত্ত সেখানেও তো একটা বড়ো অংশ ভুক্তভোগী মুসলিমরা ছিলেন বলে৷ যে কোরান নিজেকে 'হুদাল্লিন্নাস' (মানবতার পথপ্রদর্শক), হজরত মুহম্মদকে (সা.)রহমাতুল্লিন আলামিন (সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য করুণা) বলে, তার অনুসারীরা শুধু নিজেদের সম্প্রদায়গত স্বার্থে পথে নামবে, আর অন্য সময় চুপ থাকবে- এটা রং নাম্বার নয়? এই উত্তর-আধুনিক যুগে ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের ধারণা অনেকটাই ইউরোপের ধর্মসংস্কার (রিফর্মেশন) আন্দোলন পরবর্তী প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টিয় মতের ধাঁচে গড়ে ওঠা৷ যদিও মধ্যযুগে পাশ্চাত্যে ধর্মকে যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, প্রাচ্যে তা হয়নি৷ তার পরও উপনিবেশিকতাবাদের দৌলতে জীবনের আর পাঁচটা ময়দানের মতো ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও পাশ্চাত্যের অনুকরণেই তৈরি, যদিও পৃথিবীর প্রায় সব নামি ধর্মই প্রাচ্যে জন্ম ও বিকাশ লাভ করেছে৷ এদের মধ্যে নানা বিষয়ে বিস্তর মতভেদ থাকলেও মূল্যবোধ, ন্যায়, সুবিচার বিভিন্ন বিষয়ে আশ্চর্যজনক মিল৷ ইসলাম হোক বা হিন্দুধর্ম অথবা বৌদ্ধ-জৈন কি খ্রিস্টান- মিথ্যা বলা সব ধর্মেই পাপ, চুরি পাপ, হত্যা পাপ, আবার মা-বাবার সেবা, প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার, সত্য বলা, দান করা সবই পুণ্য৷ পিকে চলচ্চিত্রটি কিছুটা হলেও সেই 'মিন' (mean ) আঁকড়ে গোঁড়ামিতে না থেকে 'এন্ড'-এর (end) দিকে এগিয়ে যেতে আহ্বান জানিয়েছে৷ এতে হিন্দু ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে, রাজনীতি করে তাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে৷ তারা ক্ষুণ্ণ হয়েছেন৷ ক্যামেরার লেন্স একই প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিত৷
শাহনওয়াজ আলি রায়হান: ভারতীয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক

No comments

Powered by Blogger.